‘নমিনেশন হয়েছে মানে চাঁদাবাজি শেষ!’
জব্বার আল নাঈম || রাইজিংবিডি.কম
‘নমিনেশন হয়েছে মানে চাঁদাবাজি শেষ। আমার নমিনেশন হয়েছে মানে রাস্তা ক্লিয়ার থাকতে হবে। আজ থেকে অন্যায়, চাঁদাবাজ, দখলবাজ ও সন্ত্রাসীদের পালানোর সময় শুরু।’
এই উচ্চারণ নিছক কোনো নির্বাচনী স্লোগান নয়; এটি একযোগে রাজনৈতিক ঘোষণাপত্র, নৈতিক অবস্থান এবং প্রতিরোধের ভাষা। কচুয়ার ময়দানে দাঁড়িয়ে সাবেক শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী ড. আ ন ম এহসানুল হক মিলনের এই উচ্চারণ জুলাই জাগরণ-পরবর্তী বাংলাদেশে নতুন করে আশার আলো জ্বালিয়েছে। দীর্ঘদিন ধরে যে রাজনীতি সাহসী উচ্চারণ থেকে বঞ্চিত ছিল, যে রাজনীতি নৈতিক দৃঢ়তা হারিয়ে কেবল আপস আর সুবিধাবাদের পথে হেঁটেছে, সেই রাজনীতিতে এই বক্তব্য চোর, দখলদার, চাঁদাবাজ, টেন্ডারবাজদের একপ্রকার হুঁশিয়ারির পাশাপাশি ঝাঁকুনিও দিয়েছে।
জুলাই গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশের নতুন প্রজন্ম কিংবা সর্বস্তরের মানুষ রাজনীতি থেকে সবচেয়ে বেশি যা প্রত্যাশা করে, তা হলো—স্পষ্টতা, সাহস এবং ন্যায়বোধ। ড. মিলনের বক্তব্য এই তিনটিরই সমন্বয়। তাই এই উচ্চারণ শুধু বিএনপির কর্মী-সমর্থকদের নয়, বরং দীর্ঘদিন ধরে রাজনীতির প্রতি অনাস্থায় ভোগা সাধারণ মানুষকেও আশান্বিত করেছে, জুলাই পরবর্তী প্রজন্মকেও আশান্বিত করেছে। কারণ ইতিহাস বলে, শব্দই শক্তি, আর সাহসী শব্দ রাজনীতিতে আস্থা তৈরি করে। ক্লিন ইমেজধারী রাজনীতিকরা যখন দৃঢ়ভাবে অন্যায়ের বিরুদ্ধে অবস্থান নেন, তখন রাজনীতিতে সাহসী যুবকদের পদচারণা বাড়ে, মেধাবীরা সামনে আসার অনুপ্রেরণা পান।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে ২০০১–২০০৫ সময়টি বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। এ সময়ে বিএনপি রাষ্ট্রক্ষমতায় থেকে এমন কিছু কাঠামোগত সংস্কার বাস্তবায়ন করেছিল, যার প্রভাব আজও রাষ্ট্রের বিভিন্ন খাতে দৃশ্যমান। আইনশৃঙ্খলা রক্ষা, সন্ত্রাস দমন, যোগাযোগ অবকাঠামোর সম্প্রসারণ, তথ্যপ্রযুক্তিতে উন্মুক্ত প্রবেশাধিকার, র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন গঠন, দুর্নীতি দমন কমিশন প্রতিষ্ঠা, প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়—এ উদ্যোগ রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে নতুন মাত্রা যোগ করে। একইসঙ্গে যৌতুক ও এসিড সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে কঠোর আইন, পলিথিন ব্যাগ নিষিদ্ধকরণ, টু-স্ট্রোক বেবিট্যাক্সি বন্ধের মতো সিদ্ধান্ত পরিবেশ ও সামাজিক নিরাপত্তার প্রশ্নে বিএনপির অবস্থান স্পষ্ট ছিল।
তবে এই সময়ে সবচেয়ে স্থায়ী ও প্রভাবশালী অর্জন ছিল শিক্ষা সংস্কার। এর নেপথ্য কারিগর ছিলেন তৎকালীন তরুণ শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী আ ন ম এহসানুল হক মিলন। তার নেতৃত্বে শিক্ষা খাতে যে পরিবর্তন, পরিবর্ধন আসে, সেগুলো কেবল প্রশাসনিক নয়, বরং মানসিক ও সাংস্কৃতিক রূপান্তরের সূচনা। তিনি শিক্ষাকে দেখতেন জাতি গঠনের মূল হাতিয়ার হিসেবে, যেখানে শৃঙ্খলা, নৈতিকতা ও মেধা একসঙ্গে বিকশিত ও প্রস্ফূটিত হয়।
০২.
শিক্ষা মানুষকে সভ্যতা দিয়েছে, আধুনিক করেছে। তাই শিক্ষার গুরুত্ব অপরিসীম। পবিত্র কুরআনের প্রথম বাণী ‘ইকরা’ অর্থাৎ পড়। এই বাণী পরিষ্কার করেছে, শিক্ষা বা জ্ঞান অর্জনের গুরুত্ব। তাইতো ম্যাকাডুগাল বলে গিয়েছেন, ‘শিক্ষা হলো আচরণের বিজ্ঞান’। শিক্ষা উপেক্ষা করা যায় না, বরং এর জন্য অপেক্ষা করে আয়ত্ত্ব করতে হয়। আর ভারতবর্ষের অহিংস আন্দোলনের পুরোধা মহাত্মা গান্ধী বলেছেন, ‘শিক্ষার লক্ষ্য হলো দেহ, মন, আত্মার সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ গুণগুলোর সু-সামঞ্জস্য ও বিকাশ সাধন’। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেন, ‘শিক্ষা হলো তাই যা আমাদের কেবল তথ্য পরিবেশনই করে না বরং বিশ্বসত্তার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে আমাদের জীবন গড়ে তোলে।’ আর মহান দার্শনিক এরিস্টটল বলেন, ‘শিক্ষার শেকড়ের স্বাদ তেঁতো হলেও এর ফল মিষ্টি’। শিক্ষা নিয়ে লড়াই সংগ্রামরত ড. মিলন যেন এরই পরিপূরক।
নব্বইয়ের দশকে মার্কিন নাগরিকত্ব ত্যাগ করে দেশে ফেরা মিলন ছিলেন এক ব্যতিক্রমী তরুণ নেতা। মেধা, সাহস ও কর্মোদ্যমে সমকালীন রাজনীতির তুলনায় তিনি আলাদা ছিলেন। তার কাছে শিক্ষা মানে শুধু পাঠ্যপুস্তক নয়, শিক্ষা নাগরিক চরিত্র গঠনের প্রক্রিয়া। এই দর্শনের বাস্তব প্রয়োগ দেখা যায় পরীক্ষাব্যবস্থায় তার কঠোর অবস্থানে। কারণ, তিনি জানতেন এই ভাগ্যরেখা বদলের জন্য শিক্ষা ও শিক্ষার গুণগত মান পরিবর্তন ও সংস্কার অপরিহার্য।
২০০২ সালে এসএসসি পরীক্ষার্থী হিসেবে পুরো জাতির মতো আমিও ‘মিলনভীতি’তে ভুগেছি। পরীক্ষা কেন্দ্রে হঠাৎ হেলিকপ্টারে নেমে পড়া, নকল ধরিয়ে দেওয়া, শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের বহিষ্কার—এসব তখন রীতিমতো কিংবদন্তি। যদিও সব কেন্দ্রেই তিনি যাননি, কিন্তু তার উপস্থিতির সম্ভাবনাই পরীক্ষাব্যবস্থায় শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনে। এই ভীতিই জন্ম দেয় দায়িত্ববোধের, দায়িত্ববোধ জন্ম দেয় মেধার অবাধ প্রবাহ।
এই কঠোরতার ফলে জন্ম নেয় শিক্ষায় নকলমুক্ত নতুন বাংলাদেশ বিনির্মাণের স্বপ্ন—যা দেশের শিক্ষা ও পরীক্ষাব্যবস্থায় যুগান্তকারী পরিবর্তন আনে।
জিপিএ পদ্ধতির প্রবর্তন, মেয়েদের অবৈতনিক শিক্ষা বিস্তার, দরিদ্র ও মেধাবী শিক্ষার্থীদের জন্য বৃত্তি বৃদ্ধি, শতাধিক উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা—সব মিলিয়ে ওই সময়টিকে নিঃসন্দেহে বাংলাদেশের শিক্ষাক্ষেত্রে নবজাগরণের কাল বলা চলে। তাই শিক্ষা উন্নয়নের প্রসঙ্গ এলেই ২০০১–২০০৫ অনিবার্যভাবে প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠে।
সবচেয়ে বিস্ময়কর বিষয় হলো, মিলনের শিক্ষা সংস্কার কর্মসূচি রাজনৈতিক বিভাজনের ঊর্ধ্বে উঠে প্রশংসিত হয়েছিল। আওয়ামী লীগের অনেক নেতাও তার উদ্যোগের প্রশংসা করেছিলেন। কারণ, তার প্রতিটি সিদ্ধান্ত ছিল তথ্য-উপাত্তনির্ভর, বাস্তবমুখী, নীতিগতভাবে দৃঢ় যা কোনো দলের ম্যানিফেস্টো ছিল না, বরং ছিল বাংলাদেশকে এগিয়ে নেওয়ার অদম্য ইচ্ছা। তিনি প্রমাণ করেছিলেন, একজন প্রতিমন্ত্রীও চাইলে একটি খাতে মৌলিক পরিবর্তন আনতে পারেন।
০৩.
‘মিলন’ শব্দের আভিধানিক অর্থ সংযোগ এবং বাস্তবেও তিনি ছিলেন ছাত্র, শিক্ষক ও অভিভাবকের সংযোগসেতু। তার বিশ্বাস ছিল, একটি জাতির ভাগ্য শ্রেণিকক্ষেই নির্মিত হয়। শ্রেণিকক্ষ আলোকিত হলে সমাজ আলোকিত হয়, দেশ আলোকিত হয়। এই সহজ সত্যটাই তিনি নীতিতে ও প্রয়োগে দেখিয়েছেন।
আজকের বাস্তবতা ভিন্ন। ফ্যাসিস্ট সরকার পতনের পর ছয়টি শিক্ষানীতি ইন্টেরিম বাতিল করেছে, নতুন শিক্ষানীতির কথা বলা হলেও এখনও কার্যকর শিক্ষা কমিশন গঠিত হয়নি। উল্টোপাল্টা শিক্ষাক্রম, সময়মতো বই না পাওয়া, শিক্ষার্থীদের বিভ্রান্তি—সব মিলিয়ে শিক্ষাব্যবস্থায় অন্ধকার ঘনীভূত। এই অন্ধকার দূর না হলে জাতি আবারও পথ হারাবে। পথ হারিয়ে পথে ফেরাটা সহজ নয়। ফলে জাতিকে পথে ফেরানোই এখন শিক্ষিত ও সচেতন নাগরিকের চাওয়া এবং প্রচেষ্টা হওয়া উচিত।
এই প্রেক্ষাপটে এহসানুল হক মিলনের মতো নেতৃত্বের প্রয়োজন রয়েছে। আমরা বিভিন্ন ক্ষেত্রে সংস্কারের কথা বলছি। যে কোনো সংস্কারের জন্য সততা ও রাজনৈতিক দৃঢ়তা একে অপরের পরিপূরক। নীতির দৃঢ়তা থাকলে পরিবর্তন সম্ভব। সেই পরিবর্তন স্থায়ী হবে তখনই যখন নেতৃত্ব হবে জনমুখী ও সাহসী। শুধু শিক্ষা নয়, সব সেক্টরে অনিয়ম, দুর্নীতি ও স্বেচ্ছাচারিতা রুখে দিতে আজ আবারও ‘মিলনভীতি’ প্রয়োজন। কারণ, এহসানুল হক মিলন এমন একজন ‘ব্যক্তি’, যিনি নিজেকে ব্যক্ত করতে পারেন, সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারেন, সিদ্ধান্ত দিতে পারেন। এর প্রমাণ আমরা অতীতে পেয়েছি।
‘নমিনেশন হয়েছে মানে চাঁদাবাজি শেষ’—এই উচ্চারণ যদি বাস্তবে রূপ নেয়, তবে শুধু একজন প্রার্থী নয়, পুরো রাজনৈতিক সংস্কৃতি বদলে যাবে। সাধারণ মানুষের আস্থা বাড়বে, জাতি হিসেবে বাঙালি সমৃদ্ধশালী হবে। এগিয়ে যাবে মানুষ এবং বাংলাদেশ।
লেখক: কবি ও কথাসাহিত্যিক
ঢাকা/তারা//