ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

জগৎজ্যোতি দাস: প্রতারিত এক বীরযোদ্ধা

আরিফ রহমান || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০১:৫২, ১১ ডিসেম্বর ২০১৯   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
জগৎজ্যোতি দাস: প্রতারিত এক বীরযোদ্ধা

একাত্তরে এই বাংলায় লক্ষ লক্ষ মানুষ অকাতরে প্রাণ দিয়েছেন। স্বাধীনতার প্রায় অর্ধ-শতক অতিক্রান্ত হতে চলল। যে কারণে স্বাধীনতা প্রাপ্তির বিষয়টি উদযাপনের তো বটেই, পাশাপাশি অনেক বেশি বেদনার। দু’বছর পরেই ত্রিশ লক্ষ মানুষের মর্মান্তিক হত্যাকাণ্ডের পঞ্চাশ বছর পূর্তি হবে। মনে পড়লেই বেদনায় মুষড়ে পড়ি। যাদের বলিদানে এই বাংলা, সেই মানুষগুলো স্বাধীনতা দেখে যেতে পারলেন না!

তাই এই শহীদদের যখন অপমান হয়, তখন জীবিত নাগরিকের দায় সেই শহীদের হয়ে কথা বলা। আজ সেই ঠেকে যাওয়া জায়গা থেকেই কথা বলতে এসেছি। বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধকালীন ঘোষিত প্রথম বীরশ্রেষ্ঠ শহীদ জগৎজ্যোতি দাস। কিন্তু স্বাধীনতার পর বীরশ্রেষ্ঠদের তালিকা থেকে তাঁর নাম উধাও হয়ে যায়! আজ আসুন বিজয়ের মাসে একেবারে গোড়া থেকে জানি দাস পার্টির দুর্ধর্ষ গেরিলা নেতা ভাটি অঞ্চল সুনামগঞ্জের বাইশ বছর বয়সী যুবক জগৎজ্যোতি দাস সম্পর্কে।

জগৎজ্যোতি, অন্য বানানে জগতজ্যোতি দাসের জন্ম ১৯৪৯ সালের ২৬ এপ্রিল। তিনি ছিলেন হবিগঞ্জ জেলার আজমিরীগঞ্জ উপজেলার জলসুখা গ্রামের জীতেন্দ্র দাসের কনিষ্ঠ পুত্র। শৈশব থেকে জ্যোতি শান্ত স্বভাবের হলেও ছিলেন প্রতিবাদী, জেদি, মেধাবী ও সাহসী। স্কুল জীবনেই আইয়ুববিরোধী আন্দোলনে অংশ নিয়েছিলেন। ১৯৬৮ সালে ম্যাট্রিক পাস করার পর সুনামগঞ্জ কলেজে ভর্তি হয়ে ছাত্র ইউনিয়নে (মেনন গ্রুপ) যোগ দেন এবং তেজোদীপ্ত, বিপ্লবী ও স্পষ্টভাষী ছাত্র নেতা হিসেবে দ্রুত পরিচিত হয়ে ওঠেন ।

১৯৬৯ সালে আইয়ুববিরোধী আন্দোলনে অংশ নিয়ে বিশেষ দায়িত্ব পালনে ভারতের গৌহাটির নওপং কলেজে ভর্তি হন। সেখানে অবস্থানকালে অনেকগুলো অঞ্চলের ভাষা আয়ত্ত করেন এবং ধীরে ধীরে নকশালপন্থীদের সঙ্গে জড়িত হন। সেখান থেকেই অস্ত্র গোলাবারুদ সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা নিয়ে আবার দেশে ফিরে আসেন।

দুই.

১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর হামলা ও হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর শপথ নেন জগৎজ্যোতি। যোগ দেন ভারতের মেঘালয় রাজ্যের ইকো-১ ট্রেনিং ক্যাম্পে। বাংলার ভাটি অঞ্চল সুনামগঞ্জ-কিশোরগঞ্জ-নেত্রকোনা এবং হবিগঞ্জের হাওরাঞ্চল নিয়ে গঠিত হয় মুক্তিযুদ্ধের ৭ নং সেক্টর। এ সেক্টরের কমান্ডারের দায়িত্ব পান তৎকালীন মেজর শওকত আলী। ৫ নং সেক্টরকে কয়েকটি সাব-সেক্টরে বিভক্ত করা হয়। এর মধ্যে টেকেরঘাট সাব-সেক্টরের দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রয়াত মুক্তিযোদ্ধা সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের অধীনে জগৎজ্যোতি বিভিন্ন আক্রমণে অংশগ্রহণ করে সফল্য পান।

নেতৃত্বের গুণাবলীর কারণে ধীরে ধীরে প্রশিক্ষিত চৌকস যোদ্ধাদের নিয়ে দাসের নেতৃত্বে গঠিত হয় গেরিলা দল। নাম দেয়া হয় ফায়ারিং স্কোয়াড ‘দাস পার্টি’। জগৎজ্যোতির শেষ যুদ্ধের অন্যতম সাথী আবদুল কাইয়ুমের বয়ানে জানা যায়, দাস পার্টি নামটি জনগণের দেয়া নাম নয়, দাস পার্টির অফিসিয়াল দলিল ছিল এবং পার্টি কমান্ডার হিসেবে জগৎজ্যোতি স্বীকৃতি পেয়েছিলেন।

জগৎজ্যোতি ইংরেজি, হিন্দি, গৌহাটির আঞ্চলিক ভাষায় পারদর্শী হওয়ার সুবাদে ভারতীয় মিত্র বাহিনীর সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ সহজতর হয়। ফলে দাস পার্টির জন্য তিনি আধুনিক অস্ত্র ও গোলাবারুদ সংগ্রহে সমর্থ হন। দাস পার্টির উল্লেখযোগ্য একটি অপারেশন ছিল পাকবাহিনীর বার্জ আক্রমণ। ১৯৭১-এর ১৬ অক্টোবর পাকবাহিনীর সেই বার্জটিতে আক্রমণ চালিয়ে নিমজ্জিত করে। দাস বাহিনীর গেরিলা অভিযানের মাধ্যমে পাকিস্তানী শত্রু ঘাঁটি ধ্বংস শুরু করে। পরবর্তীতে পাহাড়পুর অপারেশন, বানিয়াচংয়ে কার্গো বিধ্বস্ত করা, বানিয়াচং থানা অপারেশনসহ বেশ  কটি ছোট-বড় অপারেশন দাস পার্টির যোদ্ধারা সফলভাবে সম্পন্ন করে।

বদলপুর অপারেশন ছিল মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে একটি বিশাল সাফল্য। জগৎজ্যোতির দল আজমিরীগঞ্জ, মারকুলি, গুঙ্গিয়ারগাঁও প্রভৃতি অঞ্চলে শত্রু ঘাঁটি ধ্বংস করে। বদলপুরে শত্রুসেনারা দাস পার্টির প্রতিরোধের মুখে শক্তি বৃদ্ধি করতে বাধ্য হয়। গুলি ছোড়ার জন্য হেলিকপ্টারও ব্যবহার করা হয়। রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে জগৎজ্যোতির পাশে ছিলেন সহযোদ্ধা  ইলিয়াস।

দাসপার্টির অব্যাহত অভিযানের মুখে পাকিস্তানিরা ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে শেষ পর্যন্ত নৌচলাচল বন্ধ ঘোষণা করতে বাধ্য হয়। জগৎজ্যোতি যোগ্য নেতৃত্ব দিয়ে দিরাই, শাল্লা, রানীগঞ্জ ও কাদিরগঞ্জ এলাকায় সফল অভিযান চালিয়ে অসংখ্য রাজাকার সদস্যদের আটক করে। গেরিলা যুদ্ধবিদ্যায় তিনি ছিলেন পারদর্শী। একক চেষ্টায় মাত্র একটি হালকা মেশিনগান নিয়ে তিনি জামালগঞ্জ থানা দখল করে নেন। মাত্র এক সেকশন (১০-১২ জন) গেরিলা যোদ্ধা নিয়ে তিনি শ্রীপুর ও খালিয়াজুরী শত্রু মুক্ত করেন। মুক্তিযুদ্ধকালে বিস্তীর্ণ ভাটি অঞ্চলে জগৎজ্যোতি ও তার দাসপার্টি পাকিস্তান সেনাবাহিনী ও রাজাকারদের কাছে মূর্তিমান এক আতঙ্কের নাম ছিল।

মুক্তিযুদ্ধের এ স্বল্পতম সময়ে যার নেতৃত্বে এতগুলো বীরত্বপূর্ণ সফল অভিযান পরিচালিত হয়েছিল, সেই জগৎজ্যোতি দাস জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত শত্রুর বিরুদ্ধে লড়াই করে দেশের জন্য নিজেকে আত্মোৎসর্গ করেন ১৯৭১ সালের নভেম্বরের ১৬ তারিখ। ন্যাশনাল গ্রিডের বিদ্যুৎ লাইন ধ্বংসের উদ্দেশে ৩৬ জনের একটি দল নিয়ে তিনি নৌকাযোগে খালিয়াজুরী থেকে বাহুবলের দিকে রওনা দেন। খুব ভোরে রওনা হয়ে সকাল আনুমানিক নয়টার সময় বদলপুর ইউনিয়ন পরিষদের কাছে পৌঁছে তারা দেখেন, কয়েকটি নৌকা করে একদল রাজাকার ওই এলাকায় চলাচল করে এমন জেলেদের নৌকা থেকে চাঁদা তুলছে। জগৎজ্যোতি মুহূর্ত দেরি না করে অস্ত্রহাতে ঝাঁপিয়ে পড়ে বেশ কয়েকজন রাজাকারকে হত্যা করেন। তাদের এ আকস্মিক আক্রমণে জীবিত রাজাকারেরা নৌকা নিয়ে পালিয়ে যেতে থাকে। জগৎজ্যোতি তার দলের অধিকাংশ সদস্যকে পেছনে রেখে মাত্র বারোজন নিয়ে তাদের তাড়া করেন। রাজাকারের দল নদীর ওপর তীরে নৌকা রেখে শুকিয়ে যাওয়া বিল পেরিয়ে জলসুখার দিকে পালিয়ে যায়।  জগৎজ্যোতি নদীর তীরে নৌকা রেখে শুকনো বিলের ওপর দিয়ে রাজাকারদের বেশ কিছুদূর ধাওয়া করে ধরতে না পেরে নিজেদের নৌকায় ফিরে আসতে থাকেন। ঠিক তখনই ওৎ পেতে থাকা পাকসেনারা দুদিক থেকে ঘিরে বিরামহীন গুলিবর্ষণ করতে থাকে। এভাবেই জগৎজ্যোতি ও তার দল দিনের ঝকঝকে আলোয় বিলের মাঝখানে পাকসেনাদের ফাঁদে পড়ে যান।

ওদিকে বদলপুরে রেখে আসা মূল দলও তাদের সাহায্যে এগিয়ে আসতে পারছে না। কারণ পাকসেনাদের অন্য একটি দল গানবোট নিয়ে তাদের মূল দলের ওপর অনবরত গুলিবর্ষণের মাধ্যমে আটকে রেখেছে। দাসপার্টি ও পাকসেনা উভয় পক্ষের মধ্যে তখন আক্রমণ-প্রতিআক্রমণ চলতে থাকে। প্রচণ্ড গুলি বর্ষণকালে দাসপার্টির একে একে সাতজন গুলিবিদ্ধ হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। এদিকে যুদ্ধের রসদ কমে এলে জগৎজ্যোতি বিনোদবিহারীসহ আরও দুজন মুক্তিযোদ্ধাকে বদলপুর মূল দল থেকে গোলাবারুদ আনতে পাঠিয়ে দেন। বেলা গড়িয়ে যায়; কিন্তু গোলাবারুদ নিয়ে ওরা আর ফিরে আসে না। জগৎজ্যোতিরা সংখ্যায় তখন মাত্র দুজন- জগৎজ্যোতি ও ইলিয়াস। গোলাবারুদও তখন ফুরিয়ে আসছে। বিকাল সাড়ে তিনটা। সময় ফুরিয়ে আসছে। জগৎজ্যোতি একটা এলএমজি হাতে শত্রুর ওপর গুলিবর্ষণ করে যাচ্ছেন। এমন সময় শত্রুর একটা বুলেট ইলিয়াসের বুকের বামপাশে এসে আঘাত করে পিঠ দিয়ে বেরিয়ে যায়। জগৎজ্যোতি মাথার গামছা দিয়ে ইলিয়াসের জখমের জায়গাটি শক্ত করে বেঁধে দেন যাতে রক্তক্ষরণ কম হয়।

একপর্যায়ে তিনি ইলিয়াসকে বলেন- তিনি কভার ফায়ারিং দিচ্ছেন ইলিয়াস যেন ফিরে যায়। ইলিয়াস জ্যোতিকে একা রেখে চলে যেতে অস্বীকার করেন এবং যুদ্ধ চালিয়ে যান। থেমে থেমে শত্রুর ঝাঁকে ঝাঁকে গুলি তাদের মাথার ওপর দিয়ে চলে যাচ্ছে। জগৎজ্যোতি তখন হিসাব করে দেখেন সন্ধ্যা পর্যন্ত যদি টিকে থাকা যায় তাহলে অন্ধকারে মিশে গিয়ে তারা শত্রুর নিশানা থেকে বেরিয়ে যেতে সক্ষম হবেন। কিন্তু সেই পরিকল্পনা আর সফল হয়নি। যুদ্ধের এক পর্যায়ে ম্যাগাজিন লোড করে শত্রুর অবস্থান দেখতে মাথা উঁচু করার মুহূর্তেই একটি গুলি জগৎজ্যোতির চোখ বিদ্ধ করে। মেশিনগান হাতে উপুড় হয়ে পাশের বিলের পানিতে নিশ্চল হয়ে ঢলে পড়েন জ্যোতি।

সন্ধ্যার অন্ধকার যেন আরও অন্ধকার হয়ে নামে ইলিয়াসের চোখে। নিজেকে সামলে নিয়ে তিনি খুব সাবধানে দলনেতা জগৎজ্যোতি দাসের নিথর দেহটি বিলের কাদা পানির ভেতর যতটুকু সম্ভব পুঁতে ফেলেন, যাতে মৃতদেহ পানিতে ভেসে উঠে শত্রুর হাতে না পড়ে। এরপর ইলিয়াস খুব সতর্কতার সঙ্গে সে স্থান ত্যাগ করে শত্রুর ফায়ারিং রেঞ্জ থেকে নিরাপদ দূরত্বে সরে যান। হানাদার বাহিনীর কাছে ত্রাস সৃষ্টিকারী অকুতোভয় বীর মুক্তিযোদ্ধা জগৎজ্যোতির এভাবেই জীবনাবসান ঘটে। জীবনের অবসান ঘটলেও জ্যোতির ওপর পাকসেনা ও তাদের দোসরদের আক্রোশ তখনও কমেনি।

পরদিন ভোরে জগৎজ্যোতির মৃতদেহ কাদা পানির ভেতর থেকে ভেসে উঠলে রাজাকাররা সে দেহ খুঁজে পায় এবং টেনেহিঁচড়ে নৌকার সম্মুখভাগে তুলে নিয়ে সাধারণ মানুষের ভেতর আতঙ্ক সৃষ্টির জন্য জলসুখা থেকে আজমিরীগঞ্জের ঘাটে ঘাটে তার মৃতদেহ প্রদর্শন করে তারা পাশবিক উল্লাস করতে থাকে। এভাবে তারা আজমিরীগঞ্জ বাজারে পৌঁছায়। সেদিন ছিল হাটবার। বাজার ভর্তি মানুষ। রাজাকাররা তখন শত শত মানুষের সামনেই বাজারের ঠিক মাঝখানে একটি বৈদ্যুতিক খুঁটির সঙ্গে ঝুলিয়ে পেরেক মেরে জগৎজ্যোতির মৃতদেহ বেঁধে অত্যাচার শুরু করে। এভাবে মারতে মারতে তারা ক্ষতবিক্ষত করে ফেলে জগৎজ্যোতির লাশ। রাজাকার সদস্যরা থুথু ফেলে তার দেহে। তারা জগৎজ্যোতির লাশের ওপর শুধু অত্যাচার করেই বসে থাকেনি বরং তার মা-বাবাকে ধরে এনে তাদের সন্তানের বীভৎস লাশ দেখিয়ে সনাক্ত করতে বলে। দাসের পরিবার সনাক্ত করতে অস্বীকৃতি জানান। হয়তো তারা ভেবেছিলেন সনাক্ত করলে রাজাকারেরা তার পরিবারের অন্য সদস্যদেরও হত্যা করবে।

পরিবার সনাক্ত না করলেও পাশবিক উল্লাস কমে না। কারণ রাজাকারেরা তো দাসকে ঠিকই চেনে। তারা ফটোগ্রাফার এনে ছবি তুলে রাখে মৃতদেহের। ২৩ বছর বয়সী জগৎজ্যোতি দাস এতোবড় ত্রাস হয়ে উঠেছিলেন যে পাকিস্তানিরা তাঁর মৃতদেহের পর্যন্ত ছবি তুলে রেখেছিল!

এভাবে সারা দিন তাঁর মৃতদেহের সঙ্গে অমানবিক আচরণ করে এবং একসময় ক্ষতবিক্ষত জগৎজ্যোতিকে ভেড়ামোহনার পানিতে ভাসিয়ে দেয়। জগৎজ্যোতির বীরত্বপূর্ণ যুদ্ধের কাহিনী সিলেটের সেই অঞ্চলের মানুষের কাছে এখনো মুখে মুখে ফেরে।

তিন.

যুদ্ধ ক্ষেত্রে জ্যোতির শহীদ হবার সংবাদ স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র, অল ইন্ডিয়া রেডিওসহ বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রচারিত ও প্রকাশিত হয়। সেই সাথে তার বীরত্বগাঁথা তুলে ধরা হয় বিভিন্ন প্রচার মাধ্যমে। অস্থায়ী বাংলাদেশ সরকার তাকে সর্বোচ্চ মরণোত্তর পদক প্রদানের ঘোষণা করেন। প্রথম ব্যক্তি হিসেবে জগৎজ্যোতিকে মুক্তিযুদ্ধে অবদানের জন্য সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় পদক প্রদানের ঘোষণা সে সময় স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে প্রচারিত হয়। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের সংগঠক বেলাল মোহাম্মদ লিখেছেন:

‘বীরগতিপ্রাপ্ত জগৎজ্যোতিকে বীরশ্রেষ্ঠ খেতাব দেওয়ার ঘোষণা দেওয়া হয়েছিল একাধিকবার এবং তার বীরত্বগাঁথা প্রচার হচ্ছিল সম্মানের সঙ্গে। অল ইন্ডিয়া রেডিওসহ বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রচারিত ও প্রকাশিত হয় জগৎজ্যোতির বীরত্বগাঁথা। অস্থায়ী বাংলাদেশ সরকার তাঁকে সর্বোচ্চ মরণোত্তর পদক প্রদানের ঘোষণা দিয়েছিলেন। প্রথম ব্যক্তি হিসেবে জগৎজ্যোতিকে মুক্তিযুদ্ধে অবদানের জন্য সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় পদক প্রদানের ঘোষণা সে সময় স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে প্রচারিত হয়েছিল। কিন্তু স্বাধীনতার পরে প্রতিশ্রুতি থেকে ফিরে আসেন বাংলাদেশ সরকার, কোন এক অজ্ঞাত কারণে। ১৯৭২ সালে জগৎজ্যোতিকে বীরবিক্রম খেতাবে ভূষিত করা হয়।’

এ প্রসঙ্গে স্মরণ করা যায় আরেক অকুতোভয় যোদ্ধা মাহবুবুর রব সাদীর কথা। হবিগঞ্জ জেলার এই তরুণ মুক্তিযুদ্ধে তাঁর বীরত্বপূর্ণ অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ প্রাপ্ত বীরপ্রতীক খেতাব অবলীলায় প্রত্যাখ্যান করে জাতীয় দৈনিকে বিবৃতি দিয়েছিলেন। তিনি ৪নং সেক্টরের সাবসেক্টর কমান্ডার ছিলেন। তাঁর নেতৃত্বে ছিল জালালপুর সাবসেক্টর। ১৯৭২ সালে খেতাব ঘোষিত হওয়ার পরই তিনি খেতাব প্রত্যাখ্যান করে সংবাদপত্রে বিবৃতি দেন। যদিও সে বিবৃতি ছাপা হয়নি সে সময়। ১৯৯২ সালে ২৩তম স্বাধীনতা দিবসের প্রাক্কালে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া পদক বিতরণ করলে, তিনি তা গ্রহণ করেননি। এই বিষয়ে দৈনিক ‘আজকের কাগজ’ পত্রিকায় দেওয়া একটি সাক্ষাৎকারে সাদী বলেন, ‘বীরশ্রেষ্ঠ খেতাব পেয়েছেন যে সাতজন, তাঁদের সবাই সামরিক বাহিনীর সদস্য। তাহলে কি সামরিক বাহিনীর সদস্যের বাইরে অন্য একজনও মুক্তিযুদ্ধে এমন মাত্রার বীরত্ব প্রদর্শন করেননি? আমি নিজে অন্তত তিনজনের কথা জানি, যাঁদের বীরশ্রেষ্ঠ খেতাব পাওয়া উচিত বলে মনে করি। এরা হলেন আমার সাব-সেক্টরের দ্বিতীয় কমান্ডার শহীদ নিজাম উদ্দিন বীরউত্তম, তাঁর গাইড রফিক বীরপ্রতীক ও ৫নং সেক্টরের জগৎজ্যোতি দাস।’

সাদী সেই সাক্ষাৎকারে আরো বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধে যারা বিভিন্ন পদক পেয়েছেন, তাঁদের বীরত্ব ও অবদানকে খাটো করি না। কিন্তু অন্য যারা আরও বেশি বীরত্ব ও অবদান রেখেও যথাযথ মূল্যায়ন পাননি, তাঁদের আত্মার প্রতি সম্মান দেখাতেই আমি খেতাব ও পদক বর্জন করি।’

দুর্ধর্ষ দাস পার্টির কমান্ডার এই তরুণ মাত্র ২২ বছর বয়সে যা করে দেখিয়েছিলেন সেটা পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল। আমরা বলতেই পারি, জগৎজ্যোতি দাস বাংলার যীশু। যীশু খৃষ্টকে যেমন জনসম্মুখে ক্রুশবিদ্ধ করা হয় তেমনি জগৎজ্যোতি দাসকেও জনসম্মুখে খুঁটির সাথে পেরেক মেরে নির্যাতন করা হয়। তাঁর মৃতদেহকে অসম্মান করা হয়। বাংলাদেশ দাসকে দেয়া সেই কথা মনে রাখেনি। এ ভয়াবহ অবিচার! গ্যালিলিওর প্রতি কৃত অপরাধের জন্য ভ্যাটিকান চার্চ ক্ষমা চেয়েছে গ্যালিলিওর কাছে তাঁর মৃত্যুর সাড়ে চারশ বছর পরে! ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এই সেদিন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের ছাত্রত্ব ফিরিয়ে দিয়ে ক্ষমা চাইল। আমরা প্রত্যাশা করি বাংলাদেশ যেন স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছরের ঊষালগ্নে এসে এই বাংলার বীর সন্তান বীরশ্রেষ্ঠ জগৎজ্যোতি দাসের কাছে ক্ষমা চেয়ে তার খেতাব ফিরিয়ে দেয়। 

 

সূত্র:

দাস পার্টির খোঁজে: হাসান মুরশেদ
জগৎজ্যোতি: অঞ্জলি লাহিড়ী
মাহবুবুর রব সাদী: অকুতোভয় যোদ্ধা: উজ্জ্বল দাস, প্রথম আলো
ইতিহাসের বিস্মৃত এক মুক্তিযোদ্ধা: একেএম শামসুদ্দিন, যুগান্তর
গেরিলা ১৯৭১ পেইজে দাসের মৃত্যু দিবস নিয়ে লেখার কিছু অংশ
আজমেরিগঞ্জ উপজেলার তথ্যবাতায়ন এবং উইকিপিডিয়া

লেখক: অনলাইন এক্টিভিস্ট


 

ঢাকা/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়