ঢাকা     বুধবার   ০১ মে ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৮ ১৪৩১

ঘটনা সত্য: দায়িত্বহীনতার অপরাধের ক্ষমা নেই

আজমাল হোসেন মামুন || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৭:২৬, ২৯ জুলাই ২০২১  
ঘটনা সত্য: দায়িত্বহীনতার অপরাধের ক্ষমা নেই

প্রতিবন্ধী সন্তান সৃষ্টিকর্তার অভিশাপ নয়। কারো পাপের ফসলও নয়। তারা সমাজেরই অংশ। যদিও বিভিন্ন কারণে যুগ যুগ ধরে তারা পিছিয়ে পড়া ও ক্ষমতাবঞ্চিত জনগোষ্ঠী হিসেবে বিবেচিত। তবে এ বিষয়গুলো নিয়ে কাজ করে এমন সংগঠন এবং কিছু ব্যক্তি মানুষ প্রতিবন্ধীদের অধিকার আদায়ে সোচ্চার ভূমিকা পালন করছে। রাষ্ট্র তাদের সহায়তা করছে।

বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার প্রতিবন্ধী জনগোষ্ঠীর জীবন মান রক্ষার্থে বাংলাদেশ প্রতিবন্ধী কল্যাণ আইন, ২০০১ প্রণয়ন করে। শুধু তাই নয়, বাংলাদেশ প্রতিবন্ধী ব্যক্তির অধিকার সংক্রান্ত জাতিসংঘ সনদ অনুসমর্থন করে। পাশাপাশি প্রতিবন্ধী ব্যক্তির অধিকার ও সুরক্ষা আইন-২০১৩ প্রণয়ন করেছে সরকার। সেখানে ১২ ধরনের প্রতিবন্ধী ব্যক্তির উল্লেখ রয়েছে।

অটিজমসহ এনডিডি (নিউরো-ডেভেলপমেন্টাল ডিজঅর্ডার) আক্রান্তদের চিকিৎসাসহ যাবতীয় অধিকারের সুরক্ষা আইনের আওতায় আনতে ২০১৩ সালে ‘দ্য ন্যাশনাল নিউরো ডেভেলপমেন্টাল ডিজঅর্ডার প্রটেকশন ট্রাস্ট অ্যাক্ট’ করা হয়। অটিজম আক্রান্ত শিশুদের দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে বিনামূল্যে থেরাপিউটিক, কাউন্সেলিং এবং অন্যান্য সেবা, সেবা সহায়ক উপকরণ দেয়ার ব্যবস্থাও করা হয়েছে। সরকারিভাবে প্রতিবন্ধী সেবা ও সাহায্য কেন্দ্র চালু আছে প্রতিটি জেলায়।

এ সবই প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের অধিকার রক্ষায় এক যুগান্তকারী মাইলফলক। তথ্য ও প্রযুক্তির যুগে আমাদের দেশের প্রতিবন্ধী ব্যক্তিরাও এগিয়েছে। বিসিএস ক্যাডারসহ বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে তারা কাজ করছে। আইনজীবী, সাংবাদিক, শিক্ষক এবং উদ্যোক্তাসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে তারা অবদান রাখতে শুরু করেছে।

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং তাঁর মেয়ে সায়মা ওয়াজেদ (পুতুল) এর আন্তরিকতায় অটিজম বিষয়ে সরকারি ও বেসরকারি সংস্থার উদ্যোগে উন্নয়নমূলক কর্মসূচি গ্রহণ করার মাধ্যমে পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীদের মূল স্রোতধারায় আনার প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। এমনকি এই কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা কর্তৃক ‘এক্সিলেন্স অ্যাওয়ার্ড’ লাভ করেছেন বাংলাদেশ সরকারের স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের নিউরো ডেভেলপমেন্ট ডিজঅর্ডারস অ্যান্ড অটিজম সংক্রান্ত জাতীয় উপদেষ্টা কমিটির সভাপতি সায়মা ওয়াজেদ।

বর্তমানে প্রতিবন্ধিতা বিষয়ে গবেষণা, সচেতনতা ও কাজের পরিধি অন্য যে কোনো সময়ের তুলানায় বৃদ্ধি পেয়েছে। তারপরও সমাজের এক শ্রেণীর মানুষের কাছে এখনও যে বিষয়টি অভিশাপের অন্ধকার সমতুল্য সেটা নগ্ন হয়ে ধরা পড়েছে এবারের ঈদে প্রচার হওয়া একটি নাটকে। এবং এ কারণেই উপরে এ বিষয়ে এতগুলো কথা বলা।

সম্প্রতি ‘ঘটনা সত্য' নাটকটি প্রচার করার মাধ্যমে প্রতিবন্ধী ব্যক্তি এবং তাঁদের অভিভাবকদের হৃদয়ে আঘাত দেওয়া হয়েছে। যেখানে রাষ্ট্র প্রতিবন্ধীদের উন্নয়নে, যাতে তারা সমাজের মূল অংশে যুক্ত হতে পারে, অবদান রাখতে পারে এ বিষয়ে নিরলসভাবে কাজ করছে, তখন তাদের নেতিবাচকভাবে উপস্থাপন করা শুধু ভুলই নয়, অন্যায়ও বটে। নাটকটিতে ভুল বার্তা দেওয়ার মাধ্যমে অপমান করা হয়েছে প্রতিবন্ধী ব্যক্তি এবং তাদের অভিভাবকদের।

নাটকটি চ্যানেল আইয়ে প্রচারের পর প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান সেন্ট্রাল মিউজিক অ্যান্ড ভিডিও (সিএমভি)-র ইউটিউব চ্যানেলে প্রকাশ করে গত ২৪ জুলাই। মঈনুল সানুর চিত্রনাট্যে নাটকটি নির্মাণ করেন রুবেল হাসান। প্রধান দুই চরিত্রে অভিনয় করেছেন আফরান নিশো ও মেহজাবীন চৌধুরী। এরা দুজনই এ সময়ের আলোচিত টিভি তারকা।

নাটকটি প্রচারের পরপরই সমালোচনার ঝড় ওঠে। বুঝতে পেরে নাটকসংশ্লিষ্ট সবাই ক্ষমা চেয়েছেন। ইউটিউব থেকে নাটকটি সরিয়েও নিয়েছেন তারা। কিন্তু তার আগে যতটুকু আঘাত দেয়ার তা তারা দিয়ে ফেলেছেন। এটি যে অজ্ঞাতসারে বা ভুলক্রমে হয়েছে এমন যুক্তিও মেনে নেয়া যায় না। কেননা একটি নাটকের সঙ্গে অনেকগুলো লোক, প্রতিষ্ঠান জড়িত থাকে। তাদের অবশ্যই সামাজিক দায়বদ্ধতা রয়েছে। তারা জেনেবুঝেই চিত্রনাট্য রচনা করেছেন। প্রযোজক সেটি অনুমোদন দিয়েছেন। অভিনেতারা স্ক্রিপ্ট অনুযায়ী সংলাপ বলেছেন। এমনকি সম্পাদনার টেবিলেও সংলাপটি কারো দৃষ্টিগোচর হয়নি!

নিঃসন্দেহে এটি দায়িত্বহীনতা। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সমালোচনার ঝড় ওঠার পরেই পরিচালকের মনে হয়েছে তিনি ‘ভুল’ করে ফেলেছেন! অ্যাডভোকেট রেজাউল করিম নামে সুপ্রিম কোর্টের একজন শারীরিক প্রতিবন্ধী তরুণ আইনজীবী এ কারণে মামলা করার প্রস্তুতি নিয়েছেন বলে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে জানিয়েছেন। প্রতিবন্ধী ব্যক্তিসহ বিভিন্ন মানুষ সাধুবাদ জানিয়েছেন তাঁকে।

প্রতিবন্ধী অধিকার ও সুরক্ষা আইন, ২০১৩ এর ৩৭ ধারায় স্পষ্ট উল্লেখ আছে: ‘কোনো ব্যক্তি পাঠ্যপুস্তকসহ যে কোনো প্রকাশনা এবং গণমাধ্যমে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে প্রতিবন্ধী ব্যক্তি বা প্রতিবন্ধিতা সম্পর্কে নেতিবাচক, ভ্রান্ত ও ক্ষতিকর ধারণা প্রদান বা নেতিবাচক শব্দের ব্যবহার বা ব্যবহারের মাধ্যমে ব্যঙ্গ করিলে উহা এই আইনের অধীন অপরাধ হইবে এবং তিনি উক্ত অপরাধের জন্য অনধিক ৩ (তিন) বৎসরের কারাদণ্ড বা অনধিক ৫ (পাঁচ) লক্ষ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হইবেন।’

এ ধারায় নাটকটির শিল্পী কলাকুশলীরা অপরাধ করেছেন। এই অপরাধ অবহেলা করার সুযোগ নেই। প্রত্যেক মানুষ সৃষ্টিকর্তার চোখে সমান। মহান আল্লাহ পবিত্র কোরআন শরিফে ইরশাদ করেছেন' আমি মানুষকে সুন্দরতম আকৃতিতে সৃষ্টি করেছি।’ পবিত্র হাদিস শরিফে ধর্ম ভিরু নাক কাটা গোলাম দেশের আমীর বা বাদশাহ হলে তাকে মান্য করতে বলা হয়েছে। এখান থেকে স্পষ্ট প্রমাণিত হয় যে, সৃষ্টিকর্তার কাছে সুস্থ বা প্রতিবন্ধী উভয়ই সমান।

পরিশেষে শুধু এটুকু বলবো, ‘ঘটনা সত্য' নাটক নির্মাণ ও অভিনয়ের মাধ্যমে সবচেয়ে অসহায় ও সুবিধাবঞ্চিত প্রতিবন্ধী জনগোষ্ঠী সম্পর্কে যে ভুল ও অবৈজ্ঞানিক বার্তা দেওয়া হয়েছে তা যেন আর কোনো নাটক, চলচ্চিত্র, সংগীত, সাহিত্যে স্থান না পায়। এ ক্ষেত্রে টেলিভিশনের প্রিভিউ কমিটিও দায় এড়াতে পারেন না। যাই হোক, সৃজনশীলতার চর্চার ক্ষেত্রে সবাইকে আরো সচেতন হতে হবে। কেননা সামাজিক দায়বদ্ধতা তাদের তো রয়েছেই বরং অন্যদের চেয়ে একটু বেশিই রয়েছে বলে আমি মনে করি।

লেখক: শিক্ষক, ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক

ঢাকা/তারা

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়