নতুন শিক্ষাক্রম, পথের শেষে কী
প্রতি বছর পুকুর খনন করা হয়, তবুও থাকে না পানি। প্রায়শ রাস্তা সংস্কার করা হয়, তবুও বেশিরভাগ রাস্তা এবড়ো-থেবড়ো। রাস্তার পৃষ্ঠদেশ সমান ও মসৃণ হওয়া কতোটা জরুরি, গাড়ি হাঁকেন যারা সেটা তাদের বোঝার কথা নয়। রিকশায় যারা যাতায়াত করেন তারা বিষয়টি অনুধাবন করেন। সরকার তো ঠিকই টাকা ঢালছেন, পুকুর খননে-রাস্তা সংস্কারে সরকার বাহাদুর তো ঠিকই প্রকল্পের পর প্রকল্পের তুবড়ি ছোটাচ্ছেন, কিন্তু কাজের কাজ কেন হচ্ছে না, সেসব নিয়ে জোরদার কোনো প্রশ্ন নেই, নেই কোনো গবেষণা ও জবাবদিহির সংস্কৃতি।
শিক্ষার ব্যাপারটাও কি পুকুর কিংবা রাস্তার মতো! এখানেও কি প্রকল্প মুখ্য হয়ে ওঠে আর প্রাপ্তিটাকে রাখা হয় গৌণতার শিকেয় তুলে? তা না হলে, শিক্ষায় সংস্কার ঠিকই হয়, নতুন শিক্ষাক্রমও আসে, কিন্তু পথের শেষে গিয়ে শিক্ষায় প্রাপ্তিটা কি আশানুরূপ, নাকি বড়োই হতাশাজনক- বেদনাহত হওয়ার মতো করুণ এক বাস্তবতা? কোনো শিক্ষাক্রমই ততটা খারাপ নয়, যতটা খারাপ হয়ে আমাদের কাছে দৃশ্যমান হয়, অর্থাৎ সুফলটা আমরা ঘরে তুলতে পারি না।
সমস্যাটা কোথায়? কেনো পূর্বতন শিক্ষাক্রমে সুফল মিললো না? এসব নিয়ে নেই কোনো প্রশ্ন বা জবাবদিহির বালাই এবং প্রত্যেকটা জায়গা ধরে অনুসন্ধান ও গবেষণা। নতুন শিক্ষাক্রম প্রণয়নের আগে এ ব্যাপারে তালাশ করার কোনোপ্রকার বিকল্প থাকতে পারে না। কারণ এর মধ্য দিয়ে যে ক্ষতিটা সাধিত হলো, তার দায় কে নেবে? কেউ নেবে না। নেয়ার জন্য যে বেদনা থাকা দরকার তা নেই সংশ্লিষ্ট অনেকেরই। কারণ তাদের ছেলেমেয়েরা পড়েন দেশের বাইরে। শুধু সমাজের ওপর তলার সরকারের বাইরের শ্রেণী-পেশার মানুষ নন, সরকারি চাকরিজীবীরাও তাদের ছেলেমেয়েদের দেশের বাইরে লেখাপড়া করানোতে স্বস্তি-স্বচ্ছন্দবোধ করেন। কারণ তারা ভালো করেই জানেন দেশের প্রচলিত শিক্ষাক্রম যেমন মোটেই আন্তর্জাতিক মানের নয়, তেমনি এর প্রায়োগিক দিকেও রয়েছে বিস্তর গোঁজামিল এবং অন্তসারশূন্যতার ছড়াছড়ি। ফলে, যে ধরনের শিক্ষাক্রমই দেশে জারি থাকুক না কেনো তাকে আন্তর্জাতিক মানের করে তোলা এবং তুলনামূলক বাস্তবতা অনুধাবন ও যথাসাধ্য বাস্তবায়ন প্রচেষ্টাও তাদের নেই। এ কারণে শিক্ষাক্রম আসে, শিক্ষাক্রম যায়, কিন্তু শিক্ষার মানের কোনো হেরফের হয় না, উল্টো অবনমন ঘটে।
সকরুণ এই বাস্তবতায় নতুন শিক্ষাক্রমে আশবাদী হওয়ার মতো অনেক কিছু থাকলেও, পথের শেষে কী মিলবে সেটা নিয়ে রয়েছে বড়ো প্রশ্ন; হতাশার জায়গাও। এ কারণে নতুন শিক্ষাক্রম শুধু প্রণয়ন করলেই হবে না, বাস্তবায়নের চ্যালেঞ্জটাকে নিতে হবে গুরুত্বের সঙ্গে।
নতুন শিক্ষাক্রম যখন ঘোষিত হচ্ছে, তখন দেশের শিক্ষার মান আন্তর্জাতিক স্কেলের মানদণ্ডে শোচনীয় বলতে হয়। শিক্ষার মান দক্ষিণ এশিয়ায় ভারত ও শ্রীলঙ্কার ২০ দশমিক ৮, পাকিস্তানের ১১ দশমিক ৩, বাংলাদেশের ২ দশমিক ৮ শতাংশ মাত্র। নতুন শিক্ষাক্রম কি দেশের শিক্ষার মানের এই বাস্তবতা পরিবর্তনে কোনো ভূমিকা রাখবে। বর্তমানে যেটা চালু রয়েছে সেটাই কেন ব্যর্থ হলো, তা কি আমরা জানি? এ জন্য কি কেবলই শিক্ষাক্রমই দায়ী ছিল, নাকি শিক্ষাক্রমের চেয়েও শুভঙ্করের মস্তো বড়ো ফাঁকি লুক্কায়িত ছিল শিক্ষাসংশ্লিষ্ট অন্য কোথাও। এ প্রসঙ্গের অবতারণা এই কারণে যে, আমেরিকার এক গবেষণা বলছে শিক্ষার ৮০ শতাংশ মান নির্ভর করে যোগ্য শিক্ষকের ওপর, বাকী সব গৌণ। শিক্ষককে ৮০ শতাংশ ক্রেডিট দিয়ে অবশিষ্ট ২০ শতাংশের ক্ষেত্রে ওই গবেষণায় উল্লিখিত হয়েছে অনুকূল পরিবেশ ও অবকাঠামোগত সুযোগ-সুবিধার কথা। এই যদি হয় গবেষণালব্ধ ফল, তাহলে নতুন শিক্ষাক্রম কি দেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় বড়ো কোনো সুফল বয়ে আনতে পারবে, নাকি কিছুদিন পর আমরা আবার নতুন শিক্ষাক্রমের দ্বারস্থ হবো? কেননা বর্তমান শিক্ষাক্রম নিয়েও একদা একই স্বপ্ন দেখানো হয়েছিল।
নতুন শিক্ষাক্রম শুরুর আগে ফায়সালা হওয়া উচিত ছিল সৃজনশীল পদ্ধতি কেনো ব্যর্থ হলো। অথচ এই পদ্ধতি শুরুর আগে কম আগডুম বাগডুম করা হয়নি। সৃজনশীল পদ্ধতির মধ্যে সৃজনশীলতার বিন্দুও যে নেই সেটা বুঝতেই আমাদেরকে প্রায় তিন দশক পাড়ি দিতে হলো। সৃজনশীল পদ্ধতির নামে আমরা ত্রিশ বছর ধরে যে স্রেফ তামাশা করে আসছি তার দায় কে নেবে?
পিএসসি-জেএসসি-জেডিসিও নিয়ে আওয়াজ ও কসরত হয়েছে আটের দশকের প্রারম্ভিকলগ্নে। আসিতেছে-আসিতেছে করে যদিও এলো মাত্র কয়েক বছর হলো, এখন আবার তার যাওয়ার পালা নিশ্চিত করা হয়েছে। শিক্ষাক্রম কি ছেলের হাতের মোয়া? খেললে খেলো, না-খেললে না-খেলো। শিক্ষাক্রম তেমনটাই হওয়া উচিত ক্ষমতার পালাবদলের সঙ্গে তার কোনো পরিবর্তন ঘটবে না। তেমন শিক্ষাক্রম করতে হলো যেরূপ নিষ্ঠায় এর পরিকল্পনা ও গবেষণা প্রয়োজন, তা আমরা আদতে করছি তো?
নতুন শিক্ষাক্রমে পরীক্ষা পদ্ধতি, বইয়ের ধরণ এবং বই পরিবর্তনের পাশাপাশি আরও যে কয়েকটি বিষয় গুরুত্ব পেয়েছে তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো-
এক. ২০২৩ সাল থেকে তৃতীয় শ্রেণী পর্যন্ত কোনো বার্ষিক পরীক্ষা থাকবে না। চতুর্থ ও পঞ্চম শ্রেণী থেকে মূল্যায়ন করা হবে নির্দিষ্ট কয়েকটি বিষয়ের ওপর। এতে ১০০ মার্কের মধ্যে ৬০ নাম্বার হবে শ্রেণীকক্ষে আর ৪০ নাম্বার হবে বার্ষিক পরীক্ষায়।
দুই. দশম শ্রেণীর পাঠ্যক্রমের ওপর হবে এসএসসি পরীক্ষা। নবম দশম শ্রেণীতে মানবিক, বিজ্ঞান, বাণিজ্য বিষয়ের মতো কোনো বিভাজন থাকবে না। শিক্ষার্থী কোন বিভাগে পড়বে সেটা নির্ধারিত হবে একাদশ শ্রেণীতে গিয়ে। এইচএসসির ফল নির্ধারিত হবে একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণীর বার্ষিক ফল একত্র করে।
তিন. ২০২৩ সাল থেকে ধাপে ধাপে নতুন শিক্ষাক্রমের কাজ শুরু হবে এবং ২০২৫ সাল থেকে পুরোপুরি বাস্তবায়ন করা হবে। এ সব সময়মতো বাস্তবায়ন করার লক্ষ্যে নতুন বছর থেকে প্রাথমিক ও মাধ্যমিকের ১০০টি করে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান পাইলটিং করা হবে।
নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়ন কীভাবে হবে এবং কতটুকু সফল হবে এখন সেটাই দেখার বিষয়। শিক্ষাক্রম নিয়ে আমাদের অতীত অভিজ্ঞতা যেহেতু সুখকর নয় তাই প্রশ্ন জারি রেখেই নতুন শিক্ষাক্রম নিয়ে আশাবাদী হতে হচ্ছে। ইউনেসকোর শিক্ষাক্রম নিয়ে চমৎকার একটা পর্যবেক্ষণ রয়েছে, তাদের দাবি হলো যে দেশের শিক্ষকের মান যতটা ভালো সে দেশের শিক্ষা ব্যবস্থাপনা ততটা উন্নত। তাহলে নতুন শিক্ষাক্রম নিয়ে খুব বেশি আশাবাদী হওয়ার যৌক্তিক কোনো কারণ রয়েছে কি?
এমনি দেশে এরূপ বিশ্বাস রয়েছে যে, পাকিস্তান আমলের চেয়ে ব্রিটিশ আমলের শিক্ষাব্যবস্থা ভালো ছিল। তারপর বলা হয়, বাংলাদেশ আমলের চেয়ে পাকিস্তান আমলের শিক্ষাব্যবস্থা ভালো ছিল। এই বিশ্বাসের পক্ষে-েবিপক্ষে নানা যুক্তি-তর্ক হাজির করা গেলেও, সমাজ থেকে এই ধারণা উড়িয়ে দেওয়া সম্ভব হয়নি। কারণ আমরা তেমন কোনো উল্লেখযোগ্য শিক্ষাব্যবস্থা সমাজের সামনে হাজির করতে পারিনি।
অথচ ব্রিটিশ-পাকিস্তান আমলের তুলনায় শিক্ষার প্রসার ঘটেছে জ্যামিতিক হারে। আজ থেকে শতবর্ষ আগে ১৯২১ সালে যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা হয় তখন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে কলেজের সংখ্যা ছিল মাত্র ২০টি। এর মধ্যে পশ্চিমবঙ্গে ছিল ১১টি আর সেই সময়ের পূর্ববঙ্গ অর্থাৎ আজকের বাংলাদেশে ছিল ৯টি। সুতরাং স্কুল কলেজ সংখ্যায় যেমন বেড়েছে, তেমনি তার অবকাঠামোগত উন্নয়নও হয়েছে। শিক্ষকের সংখ্যা বাড়ার পাশাপাশি আরও সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করা হয়েছে। কিন্তু শিক্ষার মান বাড়েনি তো বটেই, উল্টো অবনমন হয়েছে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান যদি শিক্ষার মান বাড়াতে না পারে, আন্তর্জাতিকভাবে নিজেকে উপস্থাপন করতে না পারে, তার শনৈ শনৈ আর সব উন্নয়নে কী-বা যায় আসে?
সুতরাং, নতুন শিক্ষাক্রম শুরুর এই শুভলগ্নে আমাদের মনোযোগ দিতে হবে একেবারে গোড়ায়। কেন শিক্ষার মানে আমরা দক্ষিণ এশিয়ায় এতোটা পিছিয়ে তা খতিয়ে দেখতে হবে। এ জন্য কারা দায়ী আর কাদের খাসলতের কারণে শিক্ষায় প্রাপ্তি অশ্বডিম্বতুল্য সেটাও তালাশ করতে হবে। ভাবতে হবে রিচার্ড ফাইনম্যানের শিক্ষা পদ্ধতির কথা। শিক্ষা যেন কেবলই তথ্য হয়ে না ওঠে, তা যেন শিক্ষার্থীদের কাছে জ্ঞান হিসেবে ধরা দেয় সেদিকে ফেরাতে হবে দৃষ্টি। বিনিয়োগ করতে হবে ব্যবস্থাপনাগত ত্রুটি দূর করতে। তা না হলে শিক্ষাক্রম আসবে যাবে কিন্তু পথের শেষে গিয়ে দেখা মিলবে শোচনীয় এক বাস্তবতার। যে বাস্তবতায় বলবে শিক্ষার আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে দক্ষিণ এশিয়ায় আমরা শুধু পিছিয়ে নয়, মারাত্মকভাবে পিছিয়ে, যা লজ্জারই নয় কেবল, আন্তর্জাতিক যে কোনো প্রতিযোগিতা থেকে ছিটকে পড়ার জন্য বড়ো রকমের এক অশনী সংকেত।
এস এম সোলায়মানের ‘ইংগিত’ নাটকের কাহিনি অনেকেরই জানা। সেখানে দেখা যায়, একজন লোক গাছের নিচে চাপা পড়ে মুমূর্ষু অবস্থায় রয়েছেন। নানা প্রকারের তদন্ত কমিটি আসছে যাচ্ছে কিন্তু কেউই লোকটাকে উদ্ধারের কথা ভাবছে না, উদ্ধারও করছেন না। সবাই খালি বুলি আওড়াচ্ছেন আর সিস্টেমের কথা বলছেন। আমাদের শিক্ষার ব্যবস্থাও এখন মুমূর্ষু প্রায়, তাকে উদ্ধার করতে হলে প্রথমে দূর করতে হবে এর ব্যবস্থাপনাগত ত্রুটি,তারপর অন্যকিছু। শিক্ষার মান পরিবর্তিত হবে তখনই যখন এর ভেতরের ভূত তাড়ানো সম্ভব হবে। সর্ষের ভেতরে ভূত রেখে এর শুদ্ধি অভিযান কখনো কি সফল হবার?
তাই রাজনৈতিক দুবৃত্তায়ন থেকে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোকে মুক্ত করা অপরিহার্য। শিক্ষক নিয়োগ করতে হবে প্রতিষ্ঠান ও শিক্ষার্থীর স্বার্থে যোগ্য ও মেধাবী ব্যক্তিকেই। এসবে যদি মনোযোগ দেওয়া সম্ভব হয় তবেই সুফল আসবে নতুন শিক্ষাক্রমে, তা না হলে পথের শেষে যে লাউ সেই কদুর পুনরাবৃত্তি ঘটবে কেবল।
লেখক: সাংবাদিক, লেখক ও গবেষক
ঢাকা/তারা
আরো পড়ুন