ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ১৮ ডিসেম্বর ২০২৫ ||  পৌষ ৪ ১৪৩২

Risingbd Online Bangla News Portal

ঘুরে এলাম নদী পাড়ের পান্থশালা : শেষ পর্ব

রুহুল || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১১:৩৮, ৬ অক্টোবর ২০১৬   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
ঘুরে এলাম নদী পাড়ের পান্থশালা : শেষ পর্ব

রুহুল আমিন : বৃষ্টি থামার পর আকাশ পরিষ্কার হয়ে গেল। নদীও শান্ত হল। কিন্তু আমার ইচ্ছে ছিল বেলা থাকতে থাকতে পান্থশালায় পৌঁছানোর। মাঝিকে জিজ্ঞেস করলাম কতক্ষণ লাগতে পারে। তিনি জানালেন, প্রায় আধাঘণ্টা লাগবে।

 

তখন প্রায় সোয়া ৫টা বেজে গেছে। আকাশে মেঘ সরে গেলেও সন্ধ্যার পূর্বাভাস যেন ফুটে উঠছিল আকাশে। মাঝি নৌকার ইঞ্জিন সর্বোচ্চ গতিতে দিয়ে চালাচ্ছেন। শাখা নদী থেকে ধীরে ধীরে আমাদের নৌকা বাঁক নিয়ে গ্রামের পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া উপশাখায় ঢুকে গেল।

 

আমরা ফকিরের চর এলাকায় ঢুকলাম। সূর্যাস্তের খানিক আগে আকাশের এমন নীল হওয়া বহুদিন পর দেখলাম। দেখতে দেখতে নীল আকাশ বদলে যেতে লাগল। আমরা নীল আকাশকে পেছনে ফেলে অন্ধকারে যেন ঢুকে যাচ্ছি ক্রমশ। চারদিকে আবছা অন্ধকার ছড়িয়ে পড়েছে। নীল ক্রমেই সরে গিয়ে সেখানে অন্ধকার আস্তানা গড়ল। এক সময় চারদিকের দৃশ্যমানতা খেয়ে ভুমিষ্ট হলো অন্ধকার রাতের। তখন দূর থেকে আমরা দেখছি পান্থশালার আকাশে লাল নীল বেগুনি রংয়ের শত শত বাতি। আলোকসজ্জার কারণে দূর থেকে পান্থশালাকে বন্দরের মতো লাগছিল। গ্রামীণ পরিবেশে এমন দৃশ্য খুব একটা চোখে পড়ে না। 

 

মেঘনা, বক্ষ্রপুত্র ও আঁড়িয়াল খাঁ এই তিনটি নদীর ব-দ্বীপের নাম প্রাচীন যুগে ছিল কালিদহ সাগরের চর। তারপর এর নাম হয় রায়নন্দনপুর। তারও পরে রায়পুরা নামে পরিচিতি হয় এই জনপদ। এই জনপদের পূর্ব-পশ্চিম রেখা ধরে এঁকে বেঁকে প্রবাহিত মেঘনার ঠিক পাড় ঘেষেই বিস্তার হওয়া একটি এলাকা নিয়েই সৃষ্টি হয়েছে পান্থশালা।

 

অল্প কিছুদিন আগেও এ স্থানটি ছিল প্রচণ্ড নিরিবিলি। ধুঁ ধুঁ বালুচর। দুর্গমচরাঞ্চলের বাসিন্দাদের যাতায়াতের সুবিধার্থে মেঘনা নদী পারাপারের জন্য একটি ফেরিঘাটও স্থাপন করা হয়। ওই ঘাটের নাম রাজুঘাট। রায়পুরার বর্ষীয়ান রাজনীতিক রাজি উদ্দিন আহমেদ রাজুর নাম অনুসারে রাজুঘাট করা হয়। এই ঘাটকে ঘিরেই নিরিবিলি পান্থশালা হয়ে উঠে জনবহুল বন্দরের মতো। তাই রাত নামার ঠিক পর পর একটু দূর থেকে আমাদের কাছে পান্থশালাকে ছোট কোনো বন্দরই মনে হয়েছিল।

 

ঘাটের ঠিক পূর্বপাশেই দাঁড়িয়ে আছে রাজু কটেজ। এখানে বিশিষ্ট ব্যক্তি বা নেতা-কর্মীরা বিশ্রাম নেন। রাজু কটেজের দক্ষিণ-পূর্ব পাশে ছোটদের আনন্দ পার্ক। আর ঠিক পূর্ব-উত্তর কোন ঘেঁষে নির্মিত হয়েছে পান্থশালা বিনোদন পার্ক অ্যান্ড রেস্টুরেন্ট। এই পার্কের ভেতরে মিনি চিড়িয়াখানাও নির্মিত হচ্ছে।

 

 

আমরা প্রথমে পান্থশালার ছোটদের আনন্দ পার্কে যাই। ঈদের পরের সপ্তাহ হওয়ায় রাতেও অনেক মানুষ ছিল। বিশেষ করে অনেকে পরিবারের সকলে মিলে পার্কে ঘুরতে এসেছেন। অনেকে আবার শহর থেকে ছুটিতে গ্রামের বাড়িতে গিয়ে নতুন গড়ে উঠা শিশুদের এই পার্কে বাচ্চাদের নিয়ে গেছেন। ইট-কাঠের শহরের বাইরে এই উপজেলা শহরে নদীর পাড় ঘেষে প্রকৃতির মাঝে হারিয়ে যাওয়ার ইচ্ছায় অনেকে এসেছেন। পার্কের ভেতরে নদীর পাড়ে কাটাতারের বেড়া দেওয়া হয়েছে। টিকিটের দাম ১০ টাকা। ভেতরে ছোট একটি রেস্টুরেন্টও রয়েছে। খাবারের দাম খুব বেশি না। পার্কটির ভেতরে বাচ্চাদের খেলার জন্য রয়েছে নাগরদোলা, দোলনাসহ বিভিন্ন ব্যবস্থা। এই পার্কটির সবচেয়ে সুন্দর স্থান হলো কাটাতারের বেড়ার পাশে থাকা রেস্টুরেন্টের সামনের অংশটুকু। কারণ নদীর কলকল ধ্বনি আর দক্ষিণা বাতাস যে কোনো মানুষের হৃদয় জুড়িয়ে যাবে এখানে বসলে। কর্তৃপক্ষের নিজস্ব নিরাপত্তা কর্মী রয়েছে। প্রতিদিন সকাল ১০টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত খোলা থাকে। এই পার্কটি গত রমজানের ঈদের কিছুদিন আগে উদ্বোধন করা হয়। ইতোমধ্যেই জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে।

 

আনন্দ পার্কে আমরা প্রায় আধাঘণ্টা অবস্থান করে চলে যাই পান্থশালা বিনোদন পার্ক ও রেস্টুরেন্টে। মিনি চিড়িয়াখানার নির্মাণ কাজ এখনো শেষ হয়নি। ঈদ উপলক্ষে সামনের অংশে রেস্টুরেন্ট ও কিছু বসার জায়গার ব্যবস্থা করে উদ্বোধন করা হয়েছে। ভেতরে বসার জন্য বেশ কয়েকটি ছাউনি দেওয়া হয়েছে। এখানকার রেস্টুরেন্টের ভেতরের আবহে কিছুটা শহুরে ধাঁচ লক্ষ্য করা গেছে। ইন্ডিয়ান, থাই, চাইনিজ ও দেশি-বিদেশি বিভিন্ন খাবার আছে এই রেস্টুরেন্টে। মূলফটক  দিয়ে ঢুকলে মনে হবে একটা ছোট জঙ্গলে ঢুকেছি। দুই পাশে ফুলসহ বিভিন্ন গাছপালা দিয়ে বেড়া তৈরি করা হয়েছে। ভেতরেও রয়েছে ফুলের বাগান। আবার নার্সারিও মনে হতে পারত, কিন্তু বড় বড় ছাউনির কারণে এই বিভ্রম থেকে বাঁচবে মানুষ। আমরা যখন ভেতরে ঢুকি তখনো অনেক মানুষের সমাগম দেখা যাচ্ছিল। একটা ছাউনিতে দেখলাম বেশ কয়েকজন যুবককে। কথা বলে জানলাম বন্ধুরা মিলে ঘুরতে এসেছেন তারা। বাড়ি রায়পুরার বারৈচা। পাশের আরো দুই ছাউনির নিচে দুই জোড়া কপোত-কপোতিকে দেখলাম। আর ভেতরের রেস্টুরেন্টেও বেশ কয়েকটি পরিবারকে দেখলাম।

 

এই পার্কে বিনোদনের জন্য বাগান, হর্স রাইড, নাগরদোলা, স্পিডবোট, মিনি জাদুঘর ও মিনি সিনেমার ব্যবস্থা রয়েছে। এ ছাড়া ভেতরের রেস্টুরেন্টটি পার্টি সেন্টার হিসেবেও ব্যবহার হয়ে থাকে। সেখানে বিয়ের অনুষ্ঠান, জন্মদিনের অনুষ্ঠান, বউ ভাতের অনুষ্ঠান, কমিউনিটি অনুষ্ঠান, বিজনেস পার্টি ও পিকনিকের ব্যবস্থা রয়েছে। মিনি চিড়িয়াখানা নির্মাণের কাজ শেষ না হলেও পার্টি সেন্টারের প্রায় প্রতি সপ্তাহে কোনো না কোনো অনুষ্ঠান থাকছে। উপজেলা সদরে এর আগে আনুষ্ঠানিকভাবে কোনো বিনোদন কেন্দ্র ছিল না। এই দুই পার্ক আপামর জনসাধারণের বহুদিনের প্রত্যাশা যে পূরণ করেছে তা রাত্রি বেলায় পার্ক দুটির উৎসবের আমেজই বলে দেয়। 

 

আমাদের সবার বাড়ি ফেরার ছিল অতিরিক্ত তাড়না। একে তো রাত হয়ে গেছে, সেই সঙ্গে আছে নদীতে ডাকাতের ভয়। কারণ কয়দিন পরপরই ডাকাতি হয় এই নদীতে। তাই আমরা রাত সোয়া ৮টার দিকে রওয়ানা দিলাম। মাঝি ইঞ্জিন সর্বোচ্চ স্পিডে দিয়ে বৈঠা ধরলেন। আকাশে তখন চাঁদ উঠেছে। নৌকা চলছে। মৃদু বাতাস। ছোট ছোট ঢেউ। সে কি সুন্দর দৃশ্য। নৌকা যখন শাখা নদীতে ঢুকবে হঠাৎ মাঝি বলে দেখেন মামারা যায়। আমাদের ভাগ্য ভাল যে নদীর ধার বেয়ে আমাদের নৌক চলছিল। মামা মানে ডাকাতের দল। স্পিড বোট দিয়ে ডাকাতি করে। আমি বললাম পুলিশের টহলও হতে পারে। মাঝি জানাল, পুলিশ হলে দূর থেকে টর্চ মারত। কিন্তু ডাকাতরা টর্চ মারে না। হঠাৎ আমরা সবাই নীরব হয়ে গেলাম এই কথা শুনে। যদিও আমাদের সঙ্গে তেমন কিছু ছিল না। প্রত্যেকের সঙ্গে মোবাইল আর সামান্য কিছু টাকা। তারপরও যেন চাপা উত্তেজনা আর ভয় সবাইকে ভর করল।

 

আমি অভয় দেওয়ার চেষ্টা করলাম। ভেতরে ভেতরে আমিও কিন্তু ভয় পাচ্ছিলাম। কিন্তু ভাব নিচ্ছিলাম যেন ভয়ের কিছু নাই। আমাদের নৌকা অনেকক্ষণ পাড়ের কাছ দিয়ে চলার পর নদী পাড়ি দেওয়ার জন্য মাঝি নৌকা ঘুরালেন। সোজাসুজি বৈঠা ধরলেন আর সেকেন্ডে সেকেন্ডে পেছনের দিকে তাকাতে থাকলেন। আমরা কেউ কোনো কথা বলিনি এই সময়। আমার ভেতরটা যেন শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেল। সবার চোখ পেছনের দিকে। ডাকাত আসছে কি না কা দেখতে। চাঁদের আলোতেও দেখলাম সবার চোখে আতঙ্ক। শেষের ডাকাতের এই ভয় চাঁদনি রাতের নৌকা ভ্রমণের আনন্দকে কিছুটা ম্লান করে দিল যেন। ভয় উত্তেজনা আর আতঙ্ক প্রশমিত হলো যখন আমরা আমাদের গ্রামের পাশে চলে আসলাম। সবাই যেন হাফ ছেড়ে বাঁচলাম। নৌকা থেকে যখন নামছি তখন মনে হচ্ছিল বড় বাঁচা বেঁচে গেলাম। তারপরও সবমিলিয়ে পান্থশালা ঘুরাসহ অনেকদিন পর নৌকা ভ্রমণের আনন্দে ফুরফুরে মন নিয়ে বাড়ির দিকে হাঁটা দিলাম।
 

 

রাইজিংবিডি/ঢাকা/৬ অক্টোবর ২০১৬/রুহুল/সাইফ

 

রাইজিংবিডি.কম

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়