ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ১২ ডিসেম্বর ২০২৪ ||  অগ্রহায়ণ ২৮ ১৪৩১

আরজ আলী মাতুব্বরের বসতভিটায়

ফয়সাল আহমেদ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৬:৫৩, ১৭ ডিসেম্বর ২০২২   আপডেট: ১৬:৫৫, ১৭ ডিসেম্বর ২০২২
আরজ আলী মাতুব্বরের বসতভিটায়

“জ্ঞানচর্চার ক্ষেত্রে শুধু আপন বিশ্বাসই নয়, সকল মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়া উচিত। সকল ধ্যান-ধারণা সম্পর্কে সম্যক জ্ঞান লাভ করা দরকার প্রতিটি জ্ঞান পিপাসু মানুষের। শুধু সীমাবদ্ধ পরিমন্ডলে আবদ্ধ হলে চলে না। সীমানাকে অতিক্রম করে যেতে হবে ক্রমান্বয়ে। এর মধ্যেই ক্রমশ অতিক্রম করা যাবে নিজেকে।” (আরজ আলী মাতুব্বর)

আমার দীর্ঘ প্রতীক্ষিত একটি ভ্রমণে কিছুক্ষণের মধ্যে যাত্রা করবো। আজ যাচ্ছি দার্শনিক ও ‘বাংলার সক্রেটিস’ বলে পরিচিত আরজ আলী মাতুব্বরের বসতভিটায়। বরিশালের  লামচরি গ্রামে। গত ৩দিন থেকে আমি দক্ষিণের যাত্রী হয়ে খুলনা ভ্রমণ শেষে বরিশালে এসেছি। উঠেছি লঞ্চঘাটসংলগ্ন রিচমার্ট হোটেলে। 

এবার আমি প্রথমে ঢাকা থেকে খুলনা যাই- একা। এবারকার ভ্রমণে সঙ্গী নেই। একা হলেও কোথাও আমার একাকিত্ব অনুভব হয়নি। যেখানেই গিয়েছি ঘনিষ্ঠ কাউকে না কাউকে পেয়েছি। না পেলেও নতুন পরিচয়ের মানুষ ঘনিষ্ঠ হয়ে গিয়েছে। একা ভ্রমণে এই অভিজ্ঞতা হয়। খুলনা-বরিশাল রুটে বাস পেতে বেশ বেগ পেতে হয় আমার। অনেক সময় ক্ষেপণ শেষে খুলনার জিরো পয়েন্ট থেকে পিরোজপুরগামী একটি বাসে উঠি এই শর্তে যে বরিশালগামী কোনো বাস পেলে তারা আমাকে ঐ বাসে উঠিয়ে দেবে। 

তখন বাজে দুপুর দেড়টা। আজই আরজ মঞ্জিলে যেতে চেয়েছিলাম। কিন্তু অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে সম্ভব হবে না। খুলনা থেকে বরিশাল চমৎকার যাত্রা শুরু হয়েছিল আমার। একেবারে সামনের সিটে বসে আছি। কিন্তু বিধি বাম! খানজাহান আলী সেতু পার হয়ে কাটাখালি নামক স্থানে আসার পর বাসটির মবিল লিক হয়ে পড়তে শুরু করে রাস্তায়। বাসের নিচে শুয়ে লিক সারানোর চেষ্টা করছে ড্রাইভার। আমি সহকারীকে বলি, অন্য বাসে তুলে দিতে। সে আশ্বস্ত করে। এর মধ্যে একজন তরুণের সাথে কথা হয়। সেও বরিশাল যাবে। একটি বাস এসে থামে। সহকারী খানিকটা অনিচ্ছ সত্ত্বেও আমাদের বাসটিতে তুলে দেয়। 

বাসের তীব্র গতি ভীতি জাগায় মনে। যেনো নেচে নেচে হেলে দুলে ছুটেছে বরিশালের পথে। তরুণ চালকের সঙ্গে অতি উৎসাহী কিছু যাত্রীও আনন্দে নাচছে! প্রতি মুহূর্ত শঙ্কায় কাটে কখন জানি এই আনন্দ-নৃত্য প্রলয় নৃত্যে রূপ নেয়! পাশের সিটের  তরুণটির নাম আবির। বাগেরহাটের মংলায় বাড়ি। বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ে পাবলিক এডমিনিস্ট্রেশনে পড়ে। দ্রুতই ভাব জমে উঠে আমাদের। পথিমধ্যে আবিরের গ্রামের কথা, পরিবারের কথা, পানীয় জলের সংকটের কথা, শিক্ষার কথা কত বিষয় যে আসে। আবির আমাকেও প্রশ্ন করে অনেক কিছু জানতে চায়। ভালো লাগে আবিরের সহজ সরল আচরণ এবং অনিসন্ধিৎসু মনের পরিচয় পেয়ে।

ইতোমধ্যে আমরা একে একে বাগেরহাট জেলাশহর, পিরোজপুর, ঝালকাঠি পার হয়ে বরিশাল এসে পৌঁছাই। বরিশালের রুপাতলী বাসস্ট্যান্ডে নেমে একটি রেস্তোরাঁয় চা-টা খেয়ে আমরা একজন আরেকজনের কাছ থেকে বিদাই নিই। আবির চলে যায় বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ে তার হলের উদ্দেশ্যে। আবির আমাকে খুব অনুরোধ করে তার বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে রাত্রিযাপনের জন্য। হলে রুম খালি আছে। আমারও ইচ্ছে করছিল বেশ। কিন্তু শরীরের ক্লান্তিটা এতটা ছিল যে একটু বিশ্রাম জরুরি হয়ে পড়ে। ফলে আমি একটু ভিন্ন কথা বলে আবিরের কাছ থেকে বিদায় নিই। বলি, আমার একজন বড় ভাই আছেন বরিশালে, দেখি তিনি কি করেন। ছিলেন কলেজ শিক্ষক মফিজ ভাই। দুর্গাপুজোর ছুটিতে তিনি তার গ্রামে আছেন। আবিরকে বলি, কাল আরজ আলী মাতুব্বরের বাড়ি লামচরি যাবো। তুমি আগ্রহী হলে চলে এসো। আবির জানায়, সে সকালেই চলে আসবে।

লঞ্চঘাটের ঠিক সামনেই হোটেল। একটি অটো নিয়ে চলে আসি লঞ্চঘাটে। পথিমধ্যে সন্ধ্যা রাতের বরিশাল শহর ভালোই লাগে। ঠিক হোটেলের সামনেই নামি। রুমে উঠে রুম পছন্দ হয়। জানালার পর্দা সরাতেই বিশাল আলো ঝলমল ঢাকাগামী লঞ্চ দেখতে পাই। একটু পরেই সবগুলো লঞ্চ ঢাকার উদ্দেশ্যে ছেড়ে যাবে। তখন সুনসান নীরবতা বিরাজ করবে ঘাটে। প্রচন্ড ক্লান্ত শরীর নিয়েও লঞ্চ ঘাটে চলে আসি। খানিক্ষণ টার্মিনালে হাঁটাহাটি করি। অপেক্ষমান বিশাল বিশাল লঞ্চের স্টাফদের কাছে জানতে চাই পদ্মাসেতু হওয়ার পর যাত্রী কী পরিমাণ কমেছে ইত্যাদি প্রসঙ্গ। রাতে হালকা খাবার খেয়ে শুয়ে পড়ি। সকালে ঘুম থেকে জেগে কীর্তনখোলার তীর ধরে খানিকক্ষণ হেঁটে বেড়াই।

সকাল ১০টায় আবির চলে আসে। আবিরকে নিয়ে রওয়ানা হয়ে যাই লামচরির উদ্দেশ্য। আলফা (মাহেন্দ্র) নামক বাহনে চড়ে বসি আমি ও আবির। এই আলফাতে শেয়ারে চড়ে লামচরি আসতে হয়। তারপর কীর্তনখোলার পাড় ধরে ১ কিমি ভাঙ্গাচোরা রাস্তা হেঁটে পার হয়ে আসতে হয় আরজ মঞ্জিলে। এর মধ্যে একটি নয়, দুটি এক বাঁশের সেতু পার পার হতে হয় আমাদের।

পথিমধ্যে সাক্ষাৎ হয় স্থানীয় প্রাইমারি স্কুল শিক্ষক গিয়াসউদ্দিন ভাইয়ের সঙ্গে। তিনিও আমাদের সঙ্গী হলেন। তিনি জানান, লামচরিসহ অনেক গ্রাম কীর্তনখোলার ভাঙনে খুবই ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় আছে। মাঝে মাঝেই নদী এসে ঢুকে গেছে একেবারে পথের ভেতরে। এক সময় পথ শেষ হলো। আমরা পৌঁছে গেলাম আরজ দুয়ারে। আমরা ঢুকেই দেখি একটি সমাধি। আরজ আলীর সমাধি! কিন্তু আমরা তো জানি, তিনি মরণোত্তর দেহ দান করে গেছেন বরিশাল মেডিকেল কলেজে! আরজ আলী মাতুব্বরের নাতি স্বভাব কবি শামীম মাতুব্বর অনেক আড্ডা ও গল্পে সেই রহস্যের কিনারা করেন। 

এটি আসলে আরজ আলী মাতুব্বরের প্রতিকী কবর বলা যায়। মজার বিষয় হলো, আরজ আলী নিজেই তার কবর খনন ও পাকা করে রাখেন। অবশ্য শুরুতে একজন রাজমিস্ত্রী এনে কবর তৈরি ও পাকা করাচ্ছিলেন। কিন্তু রাজমিস্ত্রী যখন জানতে পারে কবরটি যার, তিনি স্বয়ং তার সামনে দাঁড়িয়ে আছেন, রাজমিস্ত্রী ভয়ে যন্ত্রপাতি ফেলেই পালিয়ে যায়! শামীম মাতুব্বরের কাছে এই গল্প শুনে আমরা সবাই হেসে উঠি। আবশ্য এই কবরে তিনি তাঁর দাঁত ও নখ প্রতিকী দাফন করে রাখেন।

আরজ আলী মাতুব্বরের সারাজীবনের সম্পদ তাঁর গ্রন্থাগারটি বড়ো অযত্ন অবহেলায় দেখতে পেলাম। শামীম মাতুব্বরও স্বীকার করলেন। আসলে আরজ মঞ্জিলকে পূর্ণাঙ্গ রূপ দিতে নিয়মিত অর্থ সহায়তা প্রয়োজন। বাঙালির অহঙ্কার করার মতো খুব বেশি কিছু নেই এ কথা বলা সঙ্গত নয়। আসলে অহঙ্কার করার মতো আমাদের অনেক কিছুই আছে। কিন্তু আমরা আসল না চিনতে পেরে নকল জিনিসের পেছনে দৌড়াই। লম্ফঝম্ফ করি।

"জ্ঞানের কোনো ডিগ্রী নাই। জ্ঞান ডিগ্রীবিহীন ও সীমাহীন। সেই অসীম জ্ঞানার্জনের মাধ্যম স্কুল-কলেজ কিংবা বিদ্যালয় নয়, তা হচ্ছে লাইব্রেরী।"

কথটি আরজ আলীর এবং তা সুন্দর একটি ব্যানারে লাইব্রেরীর পাশের কক্ষে টানানো। এই লামচরি গ্রাম থেকে চৌদ্দ মাইল দূরে বরিশাল পাবলিক লাইব্রেরীতে হেঁটে যেতেন প্রতিদিন। আর হাঁটার সঙ্গী হতেন তাঁর এই নাতি শামীম মাতুব্বর। এমন জ্ঞানতৃষ্ণা ছিল বলেই তিনি সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছেন ‘সত্যের সন্ধান’ এবং ‘সৃষ্টি রহস্য’র মতো অনন্য সাধারণ দুটি গ্রন্থ। এছাড়া আরজ রচনা সমগ্র পাঠ করলে তাঁর বহু  বিচিত্র জ্ঞানের সন্ধান মেলে। আরজ আলীর লেখার পদ্ধতি সক্রেটিয়ান। প্রশ্নের মধ্যে দিয়ে তিনি দর্শন চর্চা করেছেন। বিজ্ঞান ও যুক্তির উপর দাঁড়িয়ে তিনি অনুসন্ধান করেছেন সত্যের সন্ধান। বিপুল বিষয়ে জ্ঞানই শুধু নয়, তাঁর জ্ঞান চর্চার পদ্ধতিও অনুসরণীয়।
ইতোমধ্যে শামীম মাতুব্বর আমাদের তাঁর মুদি দোকান থেকে হালকা খাবার ও চা দিয়ে আপ্যায়ন করান। আমাদেরও ফেরার সময় হলো। যদিও মন চাইছিল আরো দীর্ঘ সময় কাটিয়ে যাই প্রিয় দার্শনিকের স্মৃতির আঙিনায়। বিদায় নেয়ার পূর্বে আরজ আলী মাতুব্বর যে ঘরে থাকতেন বাড়ির ভেতরে আমি, আবির ও গিয়াসউদ্দিন ভাই ঘুরে আসি। অর্থাভাবে এটিও যথাযথভাবে নির্মাণ ও সংরক্ষণ করা যাচ্ছে না। অনেকেই আশ্বাস দিয়েছেন। কিন্তু কেউ কথা রাখেনি।

শামীম মাতুব্বর ভাইয়ের দোকানে আসি। তিনি তাঁর দোকান বন্ধ রেখে আমাদের সময় দেয়ায় ধন্যবাদ জানাই। তিনি জানান, ডিসেম্বরে আরজ মেলা আবার শুরু করতে চান। মূলত বইমেলা হলেও এটি গ্রামীণ মেলায় রূপ নেয়। বিদায় নিয়ে আমরা বরিশাল শহরের পথে ফিরতি পথে হাঁটতে থাকি। গিয়াসউদ্দিন ভাই অনেকটা পথ আমাদের সঙ্গে এসে বলেন কাছেই তার বাড়ি। তার বাড়িতে যেতে আমন্ত্রণ জানান। আমি তাঁর আন্তরিকতায় ধন্যবাদ জানাই। এরপর আমি ও আবির নানা কথায়, কৌতূহলী প্রশ্নে এবং বিচিত্র চিন্তায় বরিশালের পথে যাত্রা করি। সংশয় না রেখে বলি, একজন শক্তিশালী চিন্তকের চিন্তা, জীবন ও কর্মের রেশ ছিলো আমাদের মস্তিষ্কজুড়ে।
আজ আরজ আলী মাতুব্বরের জন্মদিনে আমাদের শ্রদ্ধাঞ্জলি।

তারা//


সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়