ঢাকা     সোমবার   ২২ ডিসেম্বর ২০২৫ ||  পৌষ ৭ ১৪৩২

Risingbd Online Bangla News Portal

শ্রীমঙ্গলে চা জাদুঘরে একদিন

সুমন্ত গুপ্ত || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৮:২৭, ২৪ মে ২০২৩   আপডেট: ১৮:৩৪, ২৪ মে ২০২৩
শ্রীমঙ্গলে চা জাদুঘরে একদিন

কয়েক শতকের পুরনো দ্রব্যাদি

ধূলি-ধোঁয়ার শহর ছেড়ে স্বস্তির বাতাস নিতে চায়ের দেশ শ্রীমঙ্গল ঘুরতে যাওয়ার পরিকল্পনা ছিল অনেক দিনের। ব্যস্ত দিনের ফাঁকে কখনো সময় মেলে তো সঙ্গী মেলে না। আবার কখনো সঙ্গী মেলে তো সময় মেলে না। এরই মধ্যে ব্যাটে-বলে মিলে যাওয়ায় স্থির হলো একদিনের জন্য শ্রীমঙ্গল ভ্রমণের দিন। 

সিলেট থেকে শ্রীমঙ্গল যাতায়াতে সময় লাগে ২ ঘণ্টা ৩০ মিনিটের কাছাকাছি। তাই সক্কাল সক্কাল বের হবার পরিকল্পনা করলাম আমরা। কারণ যত আগে পৌঁছাতে পারবো তত বেশি ঘুরে দেখতে পারবো। ঘড়ির কাঁটায় সকাল সাতটা হবে আমাদের চার চাকার পাইলট পলাশ ভাইয়ের ফোন। শীতের সকাল তাই ঘুম থেকে উঠতে মন চাইছিল না। শেষ পর্যন্ত অন্য ভ্রমণ সঙ্গীদের ফোনে ঘুম থেকে উঠতেই হলো। উঠেই ঝটপট তৈরি হয়ে নিলাম। আমরা ছুটে চললাম শ্রীমঙ্গল পানে। আমার সাথে ভ্রমণসঙ্গী হিসেবে আছে সৃজন, অনিক, অর্চি, কৃপা, অর্পা।

পুরনো ফ্রিজ। বিদ্যুৎ ছাড়া চলতো এই ফ্রিজ

সকালবেলা সবাই গাড়িতে উঠেই  ঝিমুতে লাগলো। সূর্য দেবকে সঙ্গী করে আমরা এগিয়ে চলছি মহাসড়ক পেড়িয়ে। সূর্যদেবের আভায় উষ্ণতা ছোঁয়ায় অন্য রকম লাগছিল। ঘড়ির কাঁটার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে আমরা পৌঁছলাম শ্রীমঙ্গল শহরে। আমরা এসে দাঁড়ালাম চা জাদুঘরের প্রবেশ দ্বারে। জনপ্রতি ২০ টাকা করে টিকিট কিনে এগিয়ে চললাম। মৃদুমন্দ বাতাস বইছে। পাখিদের কিচিরমিচির বেশ ভালোই লাগছিল। আমরা পদব্রজে এগিয়ে চললাম। প্রথম কক্ষে আমরা প্রবেশ করলাম। প্রথমটিতেই রয়েছে চা বোর্ডের প্রথম বাঙালি চেয়ারম্যান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ব্যবহার করা চেয়ার-টেবিল। শূন্য চেয়ার-টেবিলের পেছনে টাঙানো সাদা পাঞ্জাবি-পাজামা পরা জাতির পিতার আপাদমস্তক প্রতিকৃতি। কক্ষটিতে রয়েছে বঙ্গবন্ধুর চা পান করার ছবিসহ আরও বেশ কিছু স্থিরচিত্র। 

বলে রাখা ভালো  ১৯৫৭ সালের ৪ জুন প্রথম বাঙালি হিসেবে দেশের চা বোর্ডের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব নেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ১৯৫৮ সালের ২৩ অক্টোবর পর্যন্ত তিনি এ দায়িত্বে ছিলেন। বোর্ড চেয়ারম্যান থাকাকালীন ‘চায়ের রাজধানী’খ্যাত মৌলভীবাজারে শ্রীমঙ্গল নন্দরানী চা বাগান পরিদর্শনে আসেন বঙ্গবন্ধু। মিটিং করেন বাগান কর্মকর্তাদের সঙ্গে। সেই মিটিংয়ে বঙ্গবন্ধু যে চেয়ারে বসেছিলেন, যে টেবিলটি তার সামনে রাখা ছিল, সেগুলো এখন দেশীয় চা শিল্পের ইতিহাসের অংশ হয়ে স্থান নিয়েছে শ্রীমঙ্গলের ‘টি রিসোর্ট অ্যান্ড মিউজিয়ামে’।

কয়েক শতকের পুরনো দ্রব্যাদি 

পাশের কক্ষেই দেখতে পেলাম চা-গাছ ব্যবহার করে তৈরি করা আসবাবপত্রের। চা জাদুঘরের এ কক্ষটিতে আরও দেখতে পেলাম লালচান্দ চা বাগান থেকে সংগৃহীত পুরোনো আমলের চা শুকানো যন্ত্রের অংশবিশেষ। কোদালা, বারমাসিয়া ও কর্ণফুলী চা বাগান থেকে সংগৃহীত চা-বাগানের আগাছা পরিষ্কার করার কাঁটা কোদাল ও রিং কোদালও এ কক্ষেই সংরক্ষিত। ব্রিটিশ আমলে চায়ের চারা রোপণের গর্ত ও চা-গাছ উপড়ানোর জন্য ব্যবহৃত প্লান্টিং হো, কোদালা চা বাগানের শ্রমিক সুদর্শনের সংগৃহীত চা গাছ ছাঁটাইয়ের কাজে ব্যবহৃত কমলদা, ব্রিটিশ আমলে চা গাছ ছাঁটাইয়ের কাজে ব্যবহৃত প্রুনিং দা, মাটি কোপানো ও চা গাছের শিকড় কাটার জন্য ব্যবহৃত রিং কোদাল। ১৯৬০ সালে শ্রমিকদের নাম-পদবি ও মজুরি হারসহ বিভিন্ন তথ্যসমৃদ্ধ শাহবাজপুর চা বাগানের ব্যবহত সার্ভিস বুক এ কক্ষটিতে সংগ্রহে রাখা হয়েছে। 

এ ছাড়াও রয়েছে লোহার পাপস, চা-শ্রমিকদের জন্য ব্যবহৃত বিশেষ রূপা ও তামার মুদ্রা। ব্রিটিশদের গুনতির কাজে ব্যবহৃত হাড়ের ছড়ি, লাঠি, শ্রমিকদের পূজা-অর্চনায় ব্যবহৃত কষ্টিপাথরের প্লেট, ব্যবস্থাপক বাংলোয় ব্যবহৃত প্রাচীন বেতারযন্ত্র, কলের গান রেকর্ডসহ চা পাতা সংগ্রহে চয়ন যন্ত্র ও বাগানের নারী শ্রমিকদের ব্যবহৃত রুপার গহনা সংগৃহীত হয়েছে কক্ষটিতে।

পুরনো কম্পিউটার 

তৃতীয় কক্ষে রয়েছে চা শিল্পে ব্যবহৃত ব্রিটিশ আমলের টারবাইন পাম্প, লিফট পাম্প, হস্তচালিত নলকূপ, বাগানের সীমানা ও জমি পরিমাপের জরিপ শিকল, সিরামিকের পানির ফিল্টার, সিরামিক জার, ঊনিশ শতকের প্রাচীন বৈদ্যুতিক পাখা, পুরোনো রেডিও টেলিফোন সেট, প্রুনিং দা, টাইপ রাইটার, প্রাচীন পিএইচ মিটার ও চা প্রক্রিয়াকরণ সামগ্রী। আছে তীর-ধনুক, দেয়ালঘড়িসহ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে লাউয়াছড়া বনে বিধ্বস্ত হওয়া একটি যুদ্ধবিমানের অংশবিশেষও। দীর্ঘদিন মাটির নিচে থেকে কাঠ পাথরে রূপান্তরিত চার খণ্ড জীবাশ্ম ঠাঁই করে নিয়েছে কাচের ফ্রেমে। রয়েছে নেপচুন চা বাগান থেকে সংগৃহীত কেরোসিনের কুপি দিয়ে চালিত মাঝারি ফ্রিজ, মাথিউড়া চা বাগান থেকে পাওয়া হাতে ঘোরানো টেলিফোন সেট এবং বাগানের হিসাবরক্ষকদের ব্যবহৃত ক্যাশ বাক্স।

অবিভক্ত ভারতের এ অঞ্চলে চা-শিল্পের যাত্রা শুরু ঊনিশ শতকের গোড়ার দিকে। ১৮২৮ সালে চট্টগ্রামের কোদালায় চা বাগান করার উদ্যোগ নেওয়া হয়। বর্তমানে যে স্থানটিতে চট্টগ্রাম ক্লাব ঠিক সেখানেই প্রথম পরীক্ষামূলকভাবে চা গাছের চারা রোপণ করা হয় ১৮৪০ সালে। তবে বাণিজ্যিকভাবে প্রথম চা-শিল্পের যাত্রা শুরু সিলেটে। ১৮৫৪ সালে সিলেট শহরের উপকণ্ঠে প্রতিষ্ঠিত হয় মালনিছড়া চা বাগান। সেখান থেকে দেশীয় চা শিল্পের গোড়াপত্তন। এর ১৭০ বছর পরের ইতিহাস একেবারেই ভিন্ন। বর্তমানে কর্মসংস্থান সৃষ্টি, রপ্তানি আয়, গ্রামীণ দারিদ্র্য দূরীকরণসহ জাতীয় অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে চা-শিল্প। এ শিল্পের বহুমুখী বিকাশও ঘটছে উত্তরোত্তর। ঘড়ির কাঁটা এগিয়ে চলছে তার গতিতে এবার আমাদের বিদায় নেবার পালা । কিভাবে একটি ঘণ্টা সময় কাটিয়ে দিলাম টের পেলাম না। আমাদের ইতিহাস, অতীত, ঐতিহ্য অক্ষিপটে ভেসে উঠেছিল।

বঙ্গবন্ধুর ব্যবহৃত চেয়ার-টেবিল

চা জাদুঘর প্রতিদিন সকাল ১০টা থেকে বিকাল ৪টা পর্যন্ত খোলা থাকে। এখানে প্রবেশ টিকেটের মূল্য জনপ্রতি ২০ টাকা।

কীভাবে যাবেন

ঢাকা থেকে ট্রেন এবং বাসে চড়ে সিলেটের শ্রীমঙ্গল যেতে পারবেন। কমলাপুর রেলওয়ে ষ্টেশন থেকে উপবন, জয়ন্তিকা, পারাবত বা কালনি এক্সপ্রেসে শ্রীমঙ্গল যাওয়া যায়। শ্রেণিভেদে ভাড়া পড়বে ২২০ থেকে ১০০০ টাকা। চাইলে হানিফ, এনা, শ্যামলী এবং সিলেট এক্সপ্রেসের মতো বাসেও শ্রীমঙ্গল যেতে পারবেন। শ্রীমঙ্গল হতে ইজিবাইক বা অটোরিকশা নিয়ে ৪ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত চা জাদুঘর ঘুরে আসতে পারবেন।

কোথায় থাকবেন

চা জাদুঘরের পাশেই রয়েছে চা বাগান ঘেঁষা আধুনিক সুযোগ-সুবিধা সম্পন্ন টি রিসোর্ট। অগ্রিম বুকিং দিয়ে এখানে থাকা যায়। এছাড়া কম খরচে রাত্রি যাপনের জন্য শ্রীমঙ্গলে হোটেল মেরিনা, টি হাউজ রেস্ট হাউজ, প্যারাডাইস লজ, হোটেল মহসিন প্লাজা, হোটেল আল রহমানের মতো বেশকিছু আবাসিক হোটেল রয়েছে।
 
 

তারা//

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়