ঢাকা     শনিবার   ২৭ জুলাই ২০২৪ ||  শ্রাবণ ১২ ১৪৩১

বঙ্গোপসাগরের তীরে ফরাসি কলোনি : শেষ পর্ব  

হোমায়েদ ইসহাক মুন  || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৩:৫১, ২৩ জুন ২০২৩   আপডেট: ১৩:৫৩, ২৩ জুন ২০২৩
বঙ্গোপসাগরের তীরে ফরাসি কলোনি : শেষ পর্ব  

এখান থেকে আরুভেলি প্রায় ১০কিমি’র মতো। রাস্তা মোটামুটি ফাঁকা পেয়ে টান দিলাম। আরুভেলি মূলত একটা গ্রাম, যেখানে অরুবিন্দু আশ্রমের ভক্তরা বসবাস করে। আজ থেকে ৫০ বছর আগে দেশ-বিদেশ থেকে মানুষ এসে এই গ্রামে বসতি স্থাপন করেছে। গ্রামটিকে গুরুত্বপূর্ণ আধ্যাত্মিক স্থানে পরিণত করা হয়েছে। স্থাপন করা হয়েছে প্রাসাদ আকৃতির আধ্যাত্মিক মায়ের মন্দির যা 'মাত্রিমান্দির' নামে সুপরিচিত।

শ্রী অরুবিন্দু আশ্রমের মাতা মিরা আলফাসা মূলত এই মন্দিরের ডিজাইন এবং প্রতিষ্ঠা করেন। তাঁর সাথে ছিলেন বিখ্যাত ফ্রেঞ্চ আর্কিটেক্ট, ভাস্কর এবং শিল্পী রজার অ্যাঙার। যিনি অরুভেলি প্রজেক্ট সফল করেছেন। এই প্রজেক্টের নাম দেয়া হয়েছিল ‘সিটি অফ হিউম্যানিটি’। তাকে মাতা আলফাসা নামকরণ করেছিলেন, ‘দ্যা গ্রেটেস্ট আর্কিটেক্ট ইন দি ওয়ার্ল্ড’। 

মাতৃমন্দির এখন ইউনেস্কো ওয়ার্ল্ড হেরিটেজের একটি অংশ। এই মন্দিরকে বলা হয় ‘সউল অফ দি সিটি’। আর যে খোলা প্রান্তরে এই মন্দির স্থাপিত হয়েছে সেই স্থানকে বলা হয় ‘পিস’ বা ‘শান্তি’। মন্দিরটি দেখতে অবিকল পদ্মফুলের মতো। এটি নির্মাণ করতে ৩৭ বছরের মতো সময় লেগেছে। ১৯৭১ সালের ২১ ফেব্রুয়ারিতে অরুভেলির মাতার ৯৩তম জন্মদিনে মাতৃমন্দিরের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপিত হয়। কাজ সমাপ্ত হয় ২০০৮ সালের মে মাসে। গোল্ডেন প্লেট দিয়ে মোড়ানো বৃত্তাক্রিত এই মন্দির মূলত চারটি পিলারের  উপর স্থাপিত। এদের আবার আলাদা নামও রয়েছে- মহেশ্বরী, মহাকালী, মহালক্ষী, মহাসরস্বতী।

এই চারটি পিলার চার দিকের নির্দেশক হিসেবে কাজ করে এবং মাতৃমন্দিরের প্রধান অবকাঠামো এই চার পিলারের উপর ভিত্তি করে তৈরি করা হয়েছে। মন্দিরের ভেতরের প্রধান চেম্বারে রয়েছে জলের প্রবাহধারা এবং মেডিটেশন হল। বিশেষ অনুমতি ছাড়া হলে বাইরের লোকজন ঢুকতে পারে না। অরুভেলি গ্রামে যারা থাকে তারা সকালবেলা একবার মেডিটেশনের জন্য মাতৃমন্দিরে যায়ভ আর বিশেষ দিনগুলিতে বাইরে থেকে আসা অনুসারীরা রেজিস্ট্রেশনের মাধ্যমে সেখানে যাওয়ার অনুমতি পায়। শ্রী অরবিন্দুর অনুসারীরা কোনো নির্দিষ্ট ধর্ম পালন করে না, এখানে সবাই সমান, ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সবাই এক।  

অরুভেলির প্রবেশমুখে পার্কিং এরিয়া, এরপর হাঁটা পথে কিছুদূর এগিয়ে গেলে এক্সিবিশন সেন্টার, অফিস কক্ষ এবং সুভ্যেনির  শপ ও খাবারের দোকান। এক্সিবিশন সেন্টার পার হয়ে মাতৃমন্দির যাওয়ার জন্য টিকিট সংগ্রহ করতে হয় সবাইকে। সেখান থেকে টিকিট নিয়ে হাঁটা শুরু করলাম। সাইকেল ভাড়া নেওয়ার ব্যবস্থাও রয়েছে। খুব সুন্দর গ্রামের রাস্তা ধরে একটা পথ বানানো হয়েছে মাতৃমন্দির পর্যন্ত। একে মাতৃমন্দিরের ভিউ পয়েন্ট বলে। দুই থেকে তিন কিলোমিটারের মতো হবে। ফিরতি পথে বাসের ব্যবস্থা আছে। প্রধান ফটকে নামিয়ে দেবে বিনামূল্যে। 

গাছগাছালির মাঝখান দিকে সরু পথ চলে গেছে অনেকখানি। এরপর একটা খোলা প্রান্তে এসে প্রকাণ্ড এক বটগাছ দেখলাম। এর বয়স ১০০ বছরেরও বেশি প্রায়। মাতৃমন্দিরের পশ্চিম প্রান্তে এই বটবৃক্ষের অবস্থান। প্রখর রোদে আলো-ছায়ায় তার শাখা প্রশাখা বিস্তৃত করে দাঁড়িয়ে আছে বিশাল জায়গাজুড়ে। দেখেই মন ভালো হয়ে যায়। নানা এঙ্গেল থেকে ছবি তুলে আবার হাঁটা শুরু করলাম। কিছুক্ষণ পর পৌঁছে গেলাম মতৃমন্দিরের ভিউ পয়েন্টে। চারপাশে জলাধারের নালা বানানো হয়েছে এক প্রকার সীমানা প্রাচীরের মতো করে। এরপর আর কেউ যেতে পারবে না। মন্দিরে প্রবেশের অন্য পথ আছে যদি আগে থেকে অনুমতি নেওয়া থাকে। এই ভিউ পয়েন্টেও একটা বটগাছ আর ফলের গাছ আছে। ছায়ায় দাঁড়িয়ে চকচকে স্বর্ণালি মাতৃমন্দির দেখা যায় সুন্দরভাবে। 

অরুভেলি গ্রামে আগে থেকে বুকিং দিয়ে হোম স্টে করা যায়। তবে তা ১০ থেকে ১৫ দিনের জন্য। নানাভাবে আয়ের উপায় রাখা আছে এই আশ্রমকে কেন্দ্র করে। প্রচুর বিদেশীদের আনাগোনা এই অঞ্চলে। আমি আশ্রমের হোস্টেল খোঁজ করতে তাদের অফিসে গেলে আমাকে দুইটা হোস্টেলের নাম দিলো। যেখানে ডরমিটরির ব্যবস্থা রয়েছে। তার মধ্যে ‘ইয়োত ক্যাম্প’ হোস্টেলে যাওয়ার পর জানলাম অতিথি ভরপুর হয়ে আছে। পাঁচশ টাকায় এক রাতের জন্য একটা রুম পেয়ে গেলাম। বিকেল বেলা হাঁটতে বের হলে, হোস্টেলের গেটের বাইরে একজন বিদেশিকে দেখলাম সাইকেল থেকে নামলো। এগিয়ে গিয়ে পরিচিত হলাম। নাম আন্ড্রিউজ। বাড়ি জার্মানি। থাকে পর্তুগালে। এই হোস্টেলে উঠেছেন প্রায় সপ্তাহ হয়ে যাচ্ছে। আমার সম্পর্কেও তিনি জানতে চাইলেন, বাংলাদেশ থেকে একাই এসেছি শুনে বেশ আগ্রহ নিয়ে শুনলেন আমার কথা। এক কথায় দুই কথায় সে খবর দিলো আজ সন্ধ্যায় ক্লাসিকাল মিউজিক পারফরম্যান্স আছে আরুভেলি আশ্রমের অডিটোরিয়ামে। আজ সেতারের পরিবেশনা হবে। 

আরুভেলির অর্ধশত বার্ষিকী উপলক্ষে সাতদিনব্যপী এই ক্লাসিকাল ফেস্টিভ্যালের আয়োজন চলছে। এমনিতেই সন্ধ্যার পর তেমন কিছু করারও ছিল না। শুনে খুব উৎফুল্ল হলাম। বাইকে তেল প্রায় শেষের দিকে ছিল। আর এদিকে তেলের পাম্পও নেই কাছেপিঠে। আন্দ্রিউজ বলল তাদের বন্ধুদের বাইকে করে আমি যেতে পারবো। বেশ কিছুক্ষণ পরে সে জানালো ওরা চলে গেছে। বাইকে তেল নেওয়ার ব্যবস্থা হয়ে যাবে। আমাকে রাস্তার এক পাশে থামিয়ে কোথা থেকে এক লিটার তেল নিয়ে আসলো। আশ্রমের অডিটোরিয়ামের দিকে আমরা রওনা হলাম। এক ঘণ্টা মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনলাম সেতার পরিবেশনা। প্রতিদিনই নানা ধরনের পরিবেশনা চলছে। পরিচিত হলাম ইন্টার্ন করতে আশা স্থাপত্যকলার ছাত্র শ্রী এবং আরো বেশ কয়েক দেশের নাগরিকদের সাথে। অরুভেলিতে নানা প্রান্ত থেকে ছাত্র-ছাত্রীরা আসে নানা প্রজেক্টে কাজ করার জন্য। মাতৃমন্দির যেহেতু স্থাপত্যকলার অনন্য নিদর্শন তাই আর্কিটেকচার ডিপার্টমেন্টের ছাত্রছাত্রীদের বেশি আনাগোনা। পন্ডিচেরির ফ্রেন্স কলোনি নিয়েও নানা প্রজেক্ট করে আর্কিটেকচার ডিপাটমেন্টের ছাত্রছাত্রীরা। বাংলাদেশ থেকেও অনেকে যায় ইন্টার্ন করতে। 

আমরা রাতের খাবার খেতে খেতে বেশ গল্প করলাম। আন্দ্রিউজ খুব সাদাসিধা জীবন ধারণ করে। ইলেকট্রনিকস ডিভাইস-এ তার বেশ সেনসিভিটি রয়েছে। যোগাযোগের জন্য কেবল বেসিক ফোনটা ব্যবহার করছে ইন্ডিয়া এসে। পর্তুগালে আন্দ্রিউজ নিজ হাতে বেকারি আইটেম বানিয়ে বিক্রি করে। পরিবেশ রক্ষায় প্রত্যক্ষভাবে সে নানা ধরনের কাজ করে। দুই ঘোড়া আর এক কুকুর নিয়ে আন্দ্রিউজের বসত। 

পরদিন ঠিক সময়ে বাসস্টপেজে পৌঁছে বাইক ফেরত দিয়ে চেন্নাই শহরের পথে রওনা দিলাম। এদিকে আমার দিল্লী যাবার ট্রেনের টিকিট ওয়েটিং লিস্ট আছে ১৯ নাম্বারে। সবাই নানা ভয়ভীতি দেখাচ্ছে, টিকিট কনফার্ম হবে না। এখানে যাত্রীরা মাসখানেক আগে থেকে ট্রেনের টিকিট করে ওয়েটিং সিরিয়াল এ বসে থাকে। আমি ৫ দিন আগে টিকিট কেটে আর কি আশা করতে পারি। তবে আশা যে মানুষকে নিরাশ করে না এবং ভাগ্য যাদের ভালো তারা যে হতাশ হয় না তার প্রমাণ পেলাম যখন যাত্রার শেষ কালে এসে টিকিটটা কনফার্ম হলো। এর মধ্যে স্টেশনে গিয়ে নানা চেষ্টা চরিত্র করে ফেরত এসেছি। শিবা আমার সাথে থাকাতে বেশ সুবিধা হয়েছে সব জায়গায়। এরপর আমরা মেথিউ এর বাসায় গেলাম, ডিকাথলন এ বিকালটা কাটালাম। তার আরো বন্ধুরা এলো। খাইদাই করে বেশ ভালো একটা সন্ধ্যা কাটালাম। পরদিন ছিল সানডে, মেথিউ আমার জন্য সাউথ ইন্ডিয়ান স্টাইলে কোকোনাট ওয়েল দিয়ে চিকেন কারি রান্না করলো। নারকেল তেল দিয়ে খাবার খাওয়া আমাদের অভ্যাস নেই তাও বেশ ভালোই লাগলো। আমিও ডিম ভুজিয়া করলাম ওদের জন্য নারকেল তেল দিয়ে। ভাষা, জাতি, ধর্ম, স্থান সব কিছু ভিন্ন হলেও মানুষের সাথে সৌহার্দ্য আর বন্ধুত্বতে কিছু বাধা পায় না। অক্টোবর মাসে মেথিউ 'কুর্রগ' এ তার বোনের বিয়েতে আসার দাওয়াতও দিয়ে দিলো। সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে আবার লম্বা সফর এর জন্য ট্রেনে চেপে বসলাম, পরের গন্তব্য আসমুদ্রহিমালয়।

পড়ুন বঙ্গোপসাগরের তীরে ফরাসি কলোনি: ২য় পর্ব 

তারা//

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়