ঢাকা     শনিবার   ২৭ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৪ ১৪৩১

বিদ্যুতের আলোয় অগ্রযাত্রা

রশীদ মামুন || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৪:৪৪, ২৯ আগস্ট ২০২০   আপডেট: ০৮:৪৪, ২৯ আগস্ট ২০২০
বিদ্যুতের আলোয় অগ্রযাত্রা

ফরিদপুরের ভাঙ্গার মেয়ে রূপা। আজ আকাশ ছোঁয়ার স্বপ্ন দেখেন। লেখাপড়া করার পাশাপাশি গড়ে তুলেছেন শিশুদের জন্য পোশাক তৈরির কারখানা। সেখানে এই শিক্ষার্থী অন্য নারীদেরও কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করেছেন। এই তো ক’বছর আগেও যে নারী সন্ধ্যা হতেই কুপি নিভিয়ে ঘুমিয়ে পড়তেন, বিদ্যুতের আলো পেয়ে তিনি এখন উদ্যোক্তা!

এভাবে ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ পৌঁছে দেওয়াতে নীরবে এক অর্থনৈতিক বিপ্লব ঘটে গেছে। বদলে যাওয়া সেই বাংলাদেশের গল্প লিখে চলেছে বিদ্যুৎ বিভাগ। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বৃহস্পতিবার গণভবন থেকে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে আরও ৩১ উপজেলায় শতভাগ বিদ্যুতায়নের উদ্বোধন করেন। একই সঙ্গে দুটি বিদ্যুৎকেন্দ্র, গ্রিড উপকেন্দ্র এবং সঞ্চালন লাইনেরও উদ্বোধন করেন। ভিডিও কনফারেন্সে প্রধানমন্ত্রী দেশের একেবারে প্রান্তিক মানুষের সঙ্গে কথা বলেন। তাদের খোঁজখবর নেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে স্বাস্থ্যবিধি মেনে সুরক্ষিতভাবে চলাচলের পরামর্শ দেন।

ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে এ অনুষ্ঠানে যোগ দিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, বিদ্যুৎ উৎপাদনে খরচ কিন্তু অনেক বেশি হয়। আমরা কিন্তু এখনও ভর্তুকি দিয়ে যাচ্ছি। অর্থাৎ উৎপাদনের খরচ যেটা হয়, তার থেকে কম পয়সায় গ্রাহকদের আমরা বিদ্যুৎ সরবরাহ করছি। সেই ক্ষেত্রে আমি গ্রাহকদের কাছে অনুরোধ করবো যে- আপনারা বিদ্যুৎ ব্যবহারের ক্ষেত্রে অবশ্যই মিতব্যয়ী হবেন, সাশ্রয়ী হবেন। অহেতুক বিদ্যুৎ আপনারা অপচয় করবেন না। আর বিদ্যুৎ ব্যবহারে সচেতন হলে বিদ্যুতের বিল কম আসবে, তাতে গ্রাহকই লাভবান হবে বলে মন্তব্য করেন সরকারপ্রধান।

অগ্রযাত্রার এই ইতিহাস খুব বেশি দিনের নয়। সরকার দায়িত্ব গ্রহণ করে ২০০৮ সালে। অর্থাৎ ১২ বছর বা প্রায় যুগ পেরিয়ে আসার এই ক্ষণে দাঁড়িয়ে অতীত স্মৃতি হাতড়ালে দেখা যাবে খোদ রাজধানীতে দিনে-রাতে ১২ থেকে ১৬ ঘণ্টা লোডশেডিং হতো। প্রতি ঘণ্টায় একবার করে কখনওবা তার চেয়ে বেশি লোডশেডিং হতো। খোদ রাজধানীর যদি এই হাল হয় তাহলে দেশের অন্য জায়গার অবস্থা আর মনে করার দরকার নেই। একটাই কারণ, চাহিদার অর্ধেক বিদ্যুৎও উৎপাদন করতে পারত না পিডিবি। মানুষের ভোগান্তির চেয়ে শিল্পায়ন পিছিয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে কর্মসংস্থানে বড় ধাক্কা লেগেছিল। মানুষের আর্থ-সামাজিক অবস্থার বিপর্যয়ের মধ্যে দেশে চরম এক নৈরাজ্যকর অবস্থা সৃষ্টি হয়েছিল। বেকারত্ব, ক্ষুধা আর চরম আইনশৃঙ্খলার অবনতি থেকে বাংলাদেশকে টেনে তুলেছে সরকার।

গত এক দশকে একটু একটু করে অবকাঠামো উন্নয়ন আর মানুষের দোরগোড়ায় বিদ্যুৎ পৌঁছে দেওয়ায় প্রতিবেশী দেশ ছাড়াও পৃথিবীতে ঈর্ষণীয় উন্নয়নের রোল মডেলে রূপান্তরিত হয়েছে বাংলাদেশ। পরিবেশ বিপর্যয়, ক্ষুধা, দারিদ্র্যের জাল ছিন্ন করে বেড়েছে মাথাপিছু আয়। বৈশ্বিক মহামারির এই ভয়ঙ্কর থাবার মধ্যেও বাংলাদেশের জিডিপি ৫ দশমিক ৬ এ উন্নীত হয়েছে। বিশ্ববাসীর কাছে এখন উন্নয়ন বিস্ময়ের নাম আজ বাংলাদেশ। অনুষ্ঠানের পরতে পরতে সেই কথাই তুলে ধরা হয়েছে।

সেই শিক্ষার্থী রূপার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে বিদ্যুৎ কীভাবে সামাজিক পরিবর্তন ঘটিয়েছে। বিষয়টি তুলে ধরতে গিয়ে অনুষ্ঠানের এক ভিডিও বার্তায় বলা হয়, ফরিদপুরের ভাঙ্গা উপজেলায় অনেক প্রবাসী রয়েছেন। করোনার কারণে অনেকেই দেশে চলে আসতে বাধ্য হয়েছেন। এখন তাদের ফিরে যাওয়ার পালা। গ্রামে বসেই সাইবার ক্যাফেতে অনলাইনে ফ্লাইটের আপডেট যেমন তারা নিচ্ছেন, তেমনি নিজের টিকেট অনলাইনে নিজেই কাটছেন। এখানে অনেক শিক্ষার্থী অনলাইনে ক্লাস করছেন। উপকারভোগীরা বলছেন, নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ পাওয়াতে তাদের জীবনচিত্র পাল্টে গেছে।

উত্তরের জেলা নওগাঁর ধামুড়হাট উপজেলার আদিবাসী নারীরা এখন স্বাবলম্বী। বিদ্যুতের আলো পাওয়াতে দিনের কাজের পাশাপাশি রাতে বাঁশ বেতের কুটির শিল্পের কাজ করছেন তারা। এ যেন তাদের জীবনে নতুন দিনের দিশা দেখিয়েছে। একই উপজেলার মৎস্যচাষী মেহেদী বলেন, মাত্র আট মাস আগেও এখানে বিদ্যুৎ না থাকায় অক্সিজেনের অভাবে আড়াই লাখ টাকার মাছ মরে গিয়েছিল। এখন বিদ্যুৎ দিয়ে যান্ত্রিক উপায়ে অক্সিজেন তৈরি করে তিনি মাছ চাষ করছেন। বেড়েছে মাছের আবাদ আর মুনাফা। এ সময় নোয়াখালীর গীতিকবি বেলাল হোসেন বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে লেখা ‘যে কারিগর দেশ বানাইছে সেই কারিগর নেই’ গানটি গেয়ে শোনান। জেলার মনিপুর পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী শুভশ্রী রায় বলেন, এখন নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সুবিধা পাওয়াতে করোনাকালীন শিক্ষা কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, আমি জানি সব শিক্ষার্থীর এখন কষ্ট হচ্ছে। এখন সকলের কাছে বই রয়েছে। লেখাপড়াটা করুক। সামনে পরীক্ষা। পরীক্ষা তো নেওয়া সম্ভব হবে না। কি করা যায় সেটিই চিন্তা করা হচ্ছে।

অনুষ্ঠানে একজন গৃহিণীসহ জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি বক্তৃতা করেন। এরপর গোপালগঞ্জ জেলার সঙ্গে ভার্চুয়ালি সংযুক্ত হন প্রধানমন্ত্রী। সেখানে নতুন একটি সঞ্চালন লাইন চালু হওয়াতে গোপালগঞ্জে সরবরাহ বাড়ায় প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ জানান আদনান নামের ১০ম শ্রেণীর এক শিক্ষার্থী। প্রধানমন্ত্রী এর জবাবে বলেন, আমরা পায়রা থেকে এই বিদ্যুৎ নিয়ে এসেছি। পায়রা একটি দ্বীপ ছিল। পায়রা নামটি আমার দেওয়া। সেখানে আমরা পায়রা বন্দর নির্মাণ করেছি। এছাড়া সেখানে একটি তাপ বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করেছি।

এরপর পটুয়াখালী জেলার সঙ্গে সংযুক্ত হন প্রধানমন্ত্রী। স্থানীয় জেলা প্রশাসক জানান, অবহেলিত এ অঞ্চলে সরকার ব্যাপক উন্নয়ন করেছে। উপকারভোগীদের মধ্যে একজন কৃষক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ধন্যবাদ জানান। এরপর কুমিল্লার সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী সংযুক্ত হলে জেলা প্রশাসক শুরুতে জেলার বর্তমান অবস্থা তুলে ধরেন। সেখানে কুমিল্লার একজন ইমাম বলেন, এক সময় বিদ্যুতের জন্য মিছিল হতো। এখন সেখানে দেশের সব মানুষের ঘরে বিদ্যুৎ রয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর বলিষ্ঠ নেতৃত্বে এই সফলতা উল্লেখ করে ইমাম আরো বলেন, না চাহিতে মোরে যা দিয়েছো এর বিনিময়ে কি দেব তোমারে? প্রধানমন্ত্রী ইমামের এই বক্তব্যের জবাবে দেশের সব মানুষের জন্য দোয়া চান।

প্রধানমন্ত্রী মানিকগঞ্জের সঙ্গে সংযুক্ত হলে সেখানকার একজন শিক্ষিকা বলেন, মানিকগঞ্জে শতভাগ বিদ্যুতায়ন শিক্ষার অগ্রসরতায় কাজ করবে। বর্তমান করোনা পরিস্থিতিতে অনলাইন ক্লাস করতে বিদ্যুতের প্রয়োজন হয়। বছরের শুরুর দিনেই শিক্ষার্থীদের হাতে বিনামূল্যে বই তুলে দেওয়া ছাড়াও নারী শিক্ষায় প্রধানমন্ত্রীর যুগান্তকারী পদক্ষেপে তিনি কৃতজ্ঞতা জানান।

ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে এ অনুষ্ঠানে উল্লেখিত প্রতিটি জেলার স্থানীয় সংসদ সদস্য, জেলা প্রশাসক, পুলিশ সুপার ছাড়াও জেলা পর্যায়ের কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।

ঢাকা/তারা

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়