আমেরিকায় কলম্বাসের সঙ্গে দেখা হলো না (এক)
শিহাব শাহরিয়ার || রাইজিংবিডি.কম
স্ট্যাচু অব লিবার্টি
শিহাব শাহরিয়ার
গল্পটি এ রকম: দুই অধ্যাপক সকালবেলা আমেরিকার রাস্তায় পাশাপাশি হাঁটছেন। দুজনেই বিশ্ববিদ্যালয়ে যাচ্ছেন। এঁদের একজনের গায়ের রং শাদা, অন্যজনের শ্যামলা। হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ একজনের গায়ের সাথে আরেকজন গা লেগে গেল। তখন শাদা চামড়ার অধ্যাপক বলল, তুমি আমাকে ধাক্কা দিলে কেন? তুমি একটা অসভ্য।
উত্তরে শ্যামলা অধ্যাপক বলল, তুমিই অসভ্য, কারণ তোমার সংস্কৃতির বয়স পাঁচশ বছরের, আর আমার সভ্যতা দুই হাজার বছরের।
গল্পটি করেছিলেন প্রয়াত নন্দিত লেখক হুমায়ূন আহমেদ। যুক্তরাষ্ট্র দেখতে এতো সুন্দর কেন? একজনের এমন প্রশ্নের জবাবে আরেক নন্দিত কথাশিল্পী সেলিনা হোসেন বলেছেন, আমেরিকাকে এই সুন্দর করে গড়ে তুলতে পাঁচশ বছর সময় লেগেছে। এই আমেরিকাই ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের বিরোধিতা করেছে। কিন্তু তাদের দেশের কীর্তিমান কবি অ্যালেন গিন্সবার্গ ও জর্জ হ্যারিসন একই সময়ে বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামের পক্ষে দারুণ ভূমিকা রেখেছেন কবিতা লিখে ও গান শুনিয়ে। ‘যশোর রোড ১৯৭১’ও ‘বাংলাদেশ বাংলাদেশ বাংলাদেশ...’ বাঙালি চিরদিন স্মরণে রাখবে। যে দেশটি আবিষ্কার করেছিলেন কলোম্বাস। আটলান্টিক মহাসাগরের পাড়ের এই দেশটি পাঁচশ বছরে হয়ে উঠেছে বিশ্বের সবচেয়ে উন্নত দেশ- অর্থনীতি, তথ্য-প্রযুক্তি এবং সমরাস্ত্রেও। সেই দেশটি তৃতীয় বিশ্বের একজন নগন্য লেখক হিসেবে দেখার সাধ আমার ভেতরেও জেগে উঠল একদিন।
ঢাকাস্থ আমেরিকান দূতাবাসে ২০০৮ সালে সাক্ষাৎকার দেয়ার প্রায় এক বছর পর ভিসা পেয়ে উড়াল দিয়েছিলাম মার্কিন মুলুকে। বলছি ২৪ জুন ২০০৯ সালের কথা। যুক্তরাষ্ট্রের অভিবাসী ও সংস্কৃতিসেবি বিশ্বজিৎ সাহার মুক্তধারা ফাউন্ডেশনের আমন্ত্রণে সে বছর একসঙ্গে গিয়েছিলাম প্রায় তেরো জন। এঁদের মধ্যে ছিলেন কথাশিল্পী হাসান আজিজুল হক, কথাশিল্পী হুমায়ূন আহমেদ, কবি বিশ্বজিৎ চৌধুরী, প্রকাশক মনিরুল হক, সংস্কৃতিসেবী মহিউদ্দিন খোকন এবং আমি। দল বেঁধে যাওয়ার মজাই আলাদা। তবে হুমায়ূন আহমেদ স্ত্রী শাওনকে নিয়েছিলেন বিমানের বিজনেস ক্লাসে। সুতরাং তাঁর সঙ্গে যাবার সময় সেভাবে পরিচয় হয়নি। আমাদের দলনেতা ছিলেন হাসান আজিজুল হক। একটা কথা সবাই মানবেন যে, বাংলাদেশ থেকে বিদেশের উদ্দেশে বের হলে যাত্রা পথে দেশের শত্রুও বন্ধু হয়ে যায়, বাড়ে আন্তরিকতা। আমাদের ক্ষেত্রেও তাই-ই হলো। হাসান আজিজুল হক বাংলা সাহিত্যের প্রথিতযশা কথাশিল্পী কিন্তু তিনি যে রসিক মানুষ, বুঝলাম তাঁর সঙ্গে ভ্রমণ করে। প্রচুর অভিজ্ঞতার আলোকে তাঁর সঙ্গ দারুণ জমে উঠেছিল।
পরদিন সিলেটের বন্ধু ফয়সাল আমাকে নিয়ে গেল ম্যানহাটানে নিউইয়র্কের প্রাণকেন্দ্রে। হাডসন নদী বয়ে গেছে শহরের মাঝখান দিয়ে। নদী শাসন করে কীভাবে তীরবর্তী অঞ্চলে নান্দনিক শহর গড়ে তোলা যায় টেমসের পর এই নদী দেখে তাই মনে হলো। পৃথিবীর ব্যস্ততম ম্যানহাটান। এখানে একটু বলে রাখি, নিউইয়র্কের পাঁচটি বরো (Borough) বা অঞ্চল রয়েছে। ম্যানহাটন এরই একটি বরো- একে বিশ্ব বাণিজ্যের রাজধানী বলা হয়। আমরা হাঁটতে হাঁটতে ম্যানহাটানের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ঘেরা সেন্ট্রাল পার্কে ঢুকলাম। অনেকক্ষণ ঘুরে ঘুরে দেখলাম পার্কের মনোরম দৃশ্য। এখানে প্রতারিত হবার কোনো ভয় নেই। যে কারণে যার যার মতো করে সময় কাটাচ্ছে। কেউ হাঁটছে, কেউ বসে গল্প করছে, কেউ খেলাধুলা করছে আর সবচেয়ে মজা করছে ছেলেমেয়েরা। সাজানো সবুজ ঘাস আর গাছের নিবিড় সমারোহ থেকে বের হয়ে আমরা আবার হাঁটতে থাকলাম রাস্তা ধরে। তখন সন্ধ্যার আলো-আঁধারি। নিয়নগুলো জ্বলে উঠেছে। নির্জন ফুটপাত। এরপর গেলাম জাতিসংঘ সদর দপ্তরের সামনে। বন্ধু ফয়সল আমার অনেকগুলো ছবি তুলল।
আরো একটু বলে রাখি, আমেরিকায় হাঁটাহাঁটি করলে কোনো ক্লান্তি আসে না। বাড়তি এনার্জির জন্য রাস্তার ধারেই চা-পানের ব্যবস্থা আছে। আমরা মাঝে মাঝেই থেমে দোকানে ঢুকে চা-পান করছি। এরপর আমরা গেলাম কাঠের ঝুলন্ত সেতুতে। সেখানে দাঁড়িয়ে রাতের আলো ঝলমল নিউইয়র্ক দেখে অসাধারণ লাগল। আমার জন্য সবই নতুন, সবই আনন্দের। ঝুলন্ত সেতু থেকে সিএনএন ভবনের দিকে এগিয়ে গিয়ে দাঁড়ালাম। ভাবলাম, পরিকল্পনা ও প্রচেষ্টায় কত কিছুই না করা সম্ভব! ভাবলাম ঢাকা শহর যানজটমুক্ত ও সুন্দর করতে হলে, এই আমেরিকার মতো পরিকল্পনা করতে হবে।আমাদের শহরেও সাবওয়ে ব্যবস্থা করা জরুরি। এতে অনেক সুবিধা- সময় বাঁচবে, ভ্রমণও আরামদায়ক হবে।
যে কারণে যাওয়া সেই বইমেলার উদ্বোধন পরদিন। মুক্তধারার সামনে উদ্বোধনী পর্ব। সকালবেলা গিয়ে হাজির হলাম। ধীরে ধীরে এলো প্রবাসী অনেক বাঙালি। অনেক পরিচিত মুখ। ক’জনের কথা বলব? ফকির ইলিয়াস, লতা নাসিরউদ্দিন, নামজুন নেসা পিয়ারি, পূরবী বসু, হাসান ফেরদৌস, জ্যোতিপ্রকাশ দত্ত, সাইফুল্লাহ মাহমুদ দুলাল, অনন্ত আহমেদ প্রমুখ। সকালের নরম রোদের ভেতর জাকজমকভাবে বইমেলার উদ্বোধন হলো মুক্তধারা ফাউন্ডেশনের সামনে। তারপর র্যা লি শেষে শুরু হলো তিন দিনব্যাপী অনুষ্ঠানমালার একেকটি পর্ব। একটি পর্বে আমার কবিতা পাঠ ছিল। কবিতা পড়ে হাততালি পেলাম। বিশেষ করে দুই প্রখ্যাত কথাশিল্পী হাসান আজিজুল হক ও পশ্চিমবঙ্গের সমরেশ মজুমদার মঞ্চ থেকে নামার সময় অভিনন্দন জানালেন। গেলাম মেলার মাঠে।
বিশ্বজিৎ সাহার প্রশংসাই করতে হয়। বাংলা একাডেমির আদলে সুদূর নিউইয়র্কে বাংলা বইয়ের এই মেলা দেখে সত্যি ভালো লাগল। মেলার মাঠে দেখা হলো এক সময়কার ঢাকার পরিচিত অনেক মুখ- সাগর লোহানী, দর্পণ কবির, তমিজ উদদীন লোদী, সালেম সুলেরী প্রমুখ। সারাদিন কাটালাম বইমেলার অনুষ্ঠান ও বইয়ের স্টলে বসে, আড্ডা দিয়ে। জম্পেশ আড্ডা। সন্ধ্যায় এলেন কবি শামস আল মমীন। অনুষ্ঠান শেষে তিনি আমাকে নিয়ে গেলেন তার জ্যামাইকার বাসায়। পর পর তিন দিন তাঁর বাসায় ছিলাম। প্রতি রাতেই শিল্প, সাহিত্য আর রাজনীতি নিয়ে আড্ডা চলল। একদিন মমীন ভাই আমাকে নিয়ে গেলেন লং আইল্যান্ডে। দেখার মতো সুন্দর জায়গা! পাহাড়, সমুদ্র আর সমতলজুড়ে নান্দনিক এক স্থানের নাম লং আইল্যান্ড। আমার দেখা নিউইয়র্কের সবচেয়ে সুন্দর জায়গা এটি। দেখে সত্যি মুগ্ধ হয়েছি!
তিনদিন পর মমীন ভাই চলে এলেন ঢাকায়। আমি গিয়ে উঠলাম বন্ধু ফয়সলের জ্যাকসন হাইটের বাসায়। পরদিন ফয়সল প্রথমে আমাকে নিয়ে গেল তার ব্যবসায়িক এলাকা লিবার্টি এভিন্যুয়ে। সেখান থেকে প্যানসেলভিনিয়া ও নিউজার্সি অঙ্গরাজ্যে। আরেক বন্ধু মামুন তার গাড়ি চালাচ্ছে আর আমি চোখ মেলে দেখছি আমেরিকার সৌন্দর্য। সব সৌন্দর্যের বর্ণনা করা যায় না। পরিকল্পিতভাবে যে শহর, যে দেশ আমেরিকানরা করেছে তা অপূর্ব। গাড়ি থেকে দেখে নয়ন জুড়িয়ে যাচ্ছে। ভেতরে ভেতরে অনুভব করছি আমার স্ত্রী পুত্রদ্বয়কে।এমন দেখার সঙ্গী ওরা হলে আনন্দটা আরো বেশি হতো। যাই হোক, যেতে যেতে নিউইয়র্ক থেকে নিউ প্যানসেলভিনিয়ায় প্রবেশ করলাম। পথে কয়েকবার মামুন ভাই গাড়ি থামিয়ে হাইওয়ে কফিশপে ঢুকে প্রয়োজনীয় খাবার খাওয়ালেন। ফাঁকে ফাঁকে চলতে লাগল ক্যামেরার ক্লিক।
প্যানসেলভিনিয়াও একই সৌন্দর্যের চাদরে ঢাকা- পরিপাটি, ছিমছাম। বাড়িগুলো একই সারিতে দাঁড়িয়ে আছে। মামুন ভাই তার এক আত্মীয় বাঙালির বাসায় কয়েক মিনিট কথা বললেন। তারপর আমরা রওনা করলাম নিউজার্সির উদ্দেশে। সে আরেক রকম সুন্দর। এখানে রয়েছে আটলান্টিক মহাসাগরের নান্দনিক দৃশ্য উপভোগ করা, বালুময় সৈকত ও আটলান্টিক সিটি আনন্দ-উৎসব করার চমৎকার এক জায়গা। সেখানে আকর্ষণীয় খেলা হলো জুয়া। শুনেছি বিভিন্ন শহর থেকে এমনকি বিভিন্ন দেশের লোকজন এখানে জুয়া খেলতে আসে। কবি নির্মলেন্দু গুণও এখানে জুয়া খেলে লিখেছেন: ‘আমেরিকায় জুয়া খেলার স্মৃতি’নামে একটি বই। কিন্তু আমাদের জুয়া খেলা হলো না, তাতে কী? কিছু জায়গা তো ছুঁয়ে ছুঁয়ে যেতে পারবো? তাই-ই করলাম। স্বল্প সময়ে অল্প অভিজ্ঞতা নিয়ে সন্ধ্যার আগ মুহূর্তে ফিরে এলাম নিউজার্সি থেকে। একই পথে ফিরছি, তবে নিউইয়র্কে প্রবেশের আগে মামুন ভাই হাডসন নদীর তলদেশে নির্মিত দেড় মাইলের লিংকন টানেল দিয়ে নিয়ে গেলেন। আর দূর থেকেই দেখলাম বিখ্যাত স্ট্যাচু অব লিবার্টি। (চলবে)
রাইজিংবিডি/ঢাকা/৩০ আগস্ট ২০১৫/তাপস রায়
রাইজিংবিডি.কম
আরো পড়ুন