ঢাকা     শুক্রবার   ২৬ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৩ ১৪৩১

ক্ষণিক দাঁড়িয়ে যাও এই সমাধিস্থলে

সিয়াম সারোয়ার জামিল || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৫:৪৫, ১৫ আগস্ট ২০১৬   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
ক্ষণিক দাঁড়িয়ে যাও এই সমাধিস্থলে

সিয়াম সারোয়ার জামিল : গোপালগঞ্জের বুক চিরে চলে গেছে মধুমতি। বর্ষায় মধুমতি স্রোতস্বীনী। বাকি দশ মাস তার কোমল জলে উত্তাল তরঙ্গ থাকে না বললেই চলে। জলে ভেসে বেড়ায় ছোট-বড় রঙিন পাল তোলা নৌকা, ট্রলার। জেলেরা জাল পেতে ধরে মাছ। নদীতে নিয়ম করে জোয়ার ভাটাও নামে। দুই তীরের হাজার হাজার মানুষ এই মধুমতির ওপর নির্ভরশীল। টুঙ্গিপাড়া- সেই মধুমতির তীরেরই এক ছায়া সুনিবিড় গ্রাম। লোকে বলে `বঙ্গবন্ধুর গ্রাম।`

 

শান্ত সুন্দর নিরিবিলি পাখি ডাকা এই টুঙ্গিপাড়া গ্রামেই জন্মেছিলেন বাঙালি জাতির মহানায়ক শেখ মুজিবুর রহমান। শৈশবে এই গ্রামেই ছুটে বেড়াতেন হাটে, মাঠে, ঘাটে। কৈশরে দাপাদাপি করতেন খালে, পুকুরে, নদীতে। সবুজ মাঠে ঘুরে বেড়াতেন। কালের পরিক্রমায় তিনিই একদিন দেশবাসীর কাণ্ডারির ভূমিকায় অবতীর্ণ হলেন। জাতিকে দিলেন দিক নির্দেশনা। সেই মহানায়কের জন্মস্থান আর মাজার দেখতেই ভোরবেলা নেমেছি গোপালগঞ্জ।  বাসস্ট্যান্ডে বন্ধু সোবহান প্রস্তুত ছিল বাইক নিয়ে। অন্য বাইকে রতন আর সৌম্য। ওরা অফিসের এক প্রজেক্টে দুদিন আগেই এসেছে। আশফাক অসুস্থ, ওকে টুঙ্গিপাড়াতে হোটেলেই রেখে আসা হয়েছে। 

 

শহর থেকে ২০ কিলোমিটার দক্ষিণ-পূর্ব দিকে এগোতেই ঢুকে পড়লাম টুঙ্গিপাড়া। প্রবেশপথেই পাথরের ফলক, ‘দাঁড়াও পথিক বর যথার্থ বাঙ্গালী যদি তুমি হও ক্ষণিক দাঁড়িয়ে যাও এই সমাধিস্থলে। এখানে ঘুমিয়ে আছে, বাঙ্গালীর সর্বশ্রেষ্ঠ নেতা।` বিশাল এলাকা নিয়ে বঙ্গবন্ধুর সমাধী কমপ্লেক্স। ঘুরে ঘুরে দেখলাম পুরোটা। এতো বড় এলাকা আগে ভাবিনি! প্রধান আকর্ষণ মনে হলো- টম্ব। যেটা আসলে মূলসৌধ। গম্বুজ আকারের দৃষ্টিনন্দন এ টম্বটি সহজেই আকর্ষণ করল, জুড়িয়ে দিল প্রাণ। টম্বের ভেতরে শেখ মুজিবুর রহমানের কবর, পাশেই তার পিতা শেখ লুৎফর রহমান এবং মাতা সাহেরা খাতুনের কবর। 

 

 

বঙ্গবন্ধুর বাড়ি, বঙ্গবন্ধুর মাজার ও তার আশপাশ এলাকার ৩৮.৩০ একর জমির ওপর নদীর পাড়ে স্থাপিত হয়েছে বঙ্গবন্ধু সমাধিসৌধ কমপ্লেক্স, জানালেন মাজারের একজন তত্বাবধায়ক। কমপ্লেক্সে রয়েছে পাঠাগার ও মিউজিয়াম, গবেষণা কেন্দ্র, প্রদর্শনী হল, পাবলিক প্লাজা, প্রশাসনিক ভবন, মসজিদ, ক্যাফেটরিয়া উন্মুক্ত মঞ্চ, বকুলতলা চত্বর, লেকচার থিয়েটার, স্যুভেনির কর্নার আরও কত কী! আনমনেই নিজেকে জিজ্ঞেস করলাম- গ্রামটা এত সুন্দর কেন? ঘুরতে ঘুরতেই মনে পড়ে গেল গ্রাম নিয়ে বঙ্গবন্ধুর ভালবাসার কথা। 

 

একবার নিজ এলাকার কিছু মানুষের সঙ্গে আলাপচারিতায় বঙ্গবন্ধু একটি অনুরোধ করেছিলেন। অনুরোধটি ছিল এমন- ‘আমি মরে গেলে তোরা আমাকে টুঙ্গিপাড়ায় কবর দিবি। আমার কবরের ওপর একটি টিনের চোঙা লাগিয়ে দিবি।’ পাশে একজন তাকে প্রশ্ন করেছিল, ‘টুঙ্গিপাড়ায় আপনার কবরের কথাটি না হয় বুঝলাম, টুঙ্গিপাড়া আপনার জন্মস্থান। কিন্তু এই চোঙা লাগানোর ব্যাপারটি তো বুঝলাম না।’

 

বঙ্গবন্ধু উত্তর দিয়েছিলেন, ‘টুঙ্গিপাড়ায় শুয়ে আমি পাখির ডাক শুনব, ধানের সোঁদা গন্ধ পাব। আর চোঙা লাগাতে বলছি এজন্য যে, এই চোঙা ফুঁকে একদিন শেখ মুজিব নামের এক কিশোর ‘বাঙালি’ ‘বাঙালি’ বলতে বলতে রাজনীতি শুরু করেছিল।’

 

প্রতি বছর ১৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর জন্মদিনে এবং ১৫ আগস্ট তার শাহাদাৎ বার্ষিকী ও জাতীয় শোক দিবসে এই টুঙ্গিপাড়া গ্রাম পরিণত হয় বাঙালির তীর্থভূমিতে। শীত মৌসুমে বিদেশী ছাড়াও অনেক প্রতিষ্ঠান থেকে শিক্ষার্থীরা আসেন দর্শনে। আমরা দুটো পর্যন্ত ঘুরলাম। ক্ষুধায় পেট চো চো করছে। বুঝতে পেরে গাড়ি ঘোরালাম আমরা। হোটেল মধুমতিতে আশফাকের সাথে আলিঙ্গন করলাম। জানালা দিয়ে তাকাতেই বিস্ময়ে বাকরুদ্ধ আমি। হোটেলের গা ঘেঁষে মধুমতির শাখা ৩০-৪০ ফুট চওড়া সরু ভাগিয়া নদী। এক কথায় অসাধারণ! দু`কূল ছেপে পানি, শিশু-কিশোরদের উচ্ছল ডুব-সাঁতার, নদীর দু`পাশ হিজল গাছ। এককথায় দারুণ!

 

 

কিছুক্ষণ আড্ডা দিলাম হোটেলে। সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসছে বুঝতে পেরে বিলম্ব না করে ফরিদপুরের পথ ধরলাম। বন্ধুরা বাইকে করে বাসস্ট্যান্ড পৌঁছে দিল। ফেরার পথে বারবার মনে হচ্ছিল, টুঙ্গিপাড়া আসলে একটা স্বপ্নগ্রাম, স্বপ্নের মতো সুন্দর নিরিবিলি আর মায়াবী। এই অধমকে গ্রামটা বারবার টানছে কেন যেন!

 

কোথায় থাকবেন : থাকার জন্য মোটেল ‘মধুমতি’ বেশ ভাল। এটি পরিচালনা করে বাংলাদেশ পর্যটন কর্পোরেশন। এছাড়া জেলা পরিষদের ভিআইপি রেস্টহাউস আছে, নাম ‘বিজয়’। এছাড়া গোপালগঞ্জ জেলা শহরে হোটেল জিমি, হোটেল তাজ, হোটেল রিফাত, পলাশ গেস্ট হাউস, হোটেল সোহাগ এবং গোপালগঞ্জ সার্কিট হাউসে থাকার মনোমুগ্ধকর পরিবেশ রয়েছে।

 

কীভাবে যাবেন : ফরিদপুর থেকে অল্প কিছুক্ষণের পথ গোপালগঞ্জ। ঢাকা থেকে সরাসরি গোপালগঞ্জ হয়ে সেখানে যাওয়া যায়। খুলনা থেকে আসা যায় মোল্লাহাট হয়ে। ঢাকা থেকে যেতে হলে গুলিস্তান কেন্দ্র্রীয় বাস টার্মিনালে এসে সকাল ৭টা, সাড়ে ৭টা ও ৮টায় টুঙ্গিপাড়া এক্সপ্রেস কিংবা মধুমতি এক্সপ্রেসে চড়ে মাওয়া-ভাঙ্গা, মুকসুদপুর গোপালগঞ্জ পৌঁছানো যায়। এরপর ভ্যানে অথবা ইজিবাইকে ১৫-২০ মিনিটে টুঙ্গিপাড়া মাজার। এছাড়া ওই একই পথে গুলিস্তান থেকে বেলা দেড়টা, দুইটা বা আড়াইটায় ওই দুটি পরিবহনের গাড়ি ছেড়ে আসে টুঙ্গিপাড়ার উদ্দেশে। 

 

 

 

রাইজিংবিডি/ঢাকা/১৫ আগস্ট ২০১৬/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়