ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ০২ মে ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৯ ১৪৩১

পঁচাত্তরের পরিস্থিতি যেন সৃষ্টি না হয়

|| রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৮:৫৫, ১৪ আগস্ট ২০১৫   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
পঁচাত্তরের পরিস্থিতি যেন সৃষ্টি না হয়

|| খান মো. শাহনেওয়াজ ||

বাঙালি জাতির জনক, অবিসংবাদিত নেতা ও হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ সন্তান শেখ মুজিবুর রহমানকে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সপরিবারে হত্যা করা হয়। স্বাধীন বাংলাদেশের মাটিতে নিজ বাসভবনে নৃশংসভাবে তার প্রাণ কেড়ে নেয় সেনাবাহিনীর একটি চক্র। পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ১৯৭১ সালে যা করতে পারেনি ঠিক সেই কাজটিই পরিকল্পিতভাবে ঠান্ডা মাথায় করেছে এ দেশের ঘাতকরা। বাংলার ইতিহাসে নিংসন্দেহে এটি কলঙ্কজনক একটি অধ্যায়।

পৃথিবীর বুকে আজকের এই স্বাধীন বাংলাদেশ সৃষ্টির জন্য আন্দোলন গড়ে তোলার ডাক দিয়েছেন শেখ মুজিবুর রহমান। এ দেশের মানুষের কাছে তার ইমেজ গড়ে উঠেছে ‘বঙ্গবন্ধু’ হিসেবে। পাকিস্তানের শাসন থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য বাঙালি জাতিকে জাগিয়ে তুলতে তিনি ডাক দিয়েছিলেন এই বলে- এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম; এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।

এই মেধাবী ও বিচক্ষণ নেতার আহ্বানে স্বাধীন হয়েছে দেশ। আমরা বিশ্ব দরবারে পরিচিতি পেয়েছি স্বাধীন জাতি হিসেবে। বাঙালির এ এক অসাধারণ প্রাপ্তি। ষড়যন্ত্রকারী একটি চক্র ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ভোরে এই মহান নেতাকে রাজধানী ঢাকায় ধানমন্ডির ৩২ নাম্বারে তার বাসভবনে গুলি করে মেরে ফেলে।    

১৫ আগস্ট, জাতীয় শোক দিবস। স্বাধীন বাংলাদেশ ও বাংলার মানুষের জন্য অত্যন্ত শোকাবহ দিন। ঘাতকরা শেখ মুজিবুর রহমানকে তো হত্যা করেছেই, তার পরিবারের সদস্যদেরকেও হত্যা করেছে। সেদিন ঘাতকদের বুলেট কেড়ে নিয়েছে তাঁর পরিবার এবং নিকট আত্মীয়সহ মোট ২৬ জনের প্রাণ। বঙ্গবন্ধুর মেয়ে শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা পশ্চিম জার্মানিতে থাকায় তারা বেঁচে গেছেন। বঙ্গবন্ধুর সন্তানদের মধ্যে সবচেয়ে ছোট ছেলে শেখ রাসেল ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ল্যাবরেটরি হাইস্কুলের চতুর্থ শ্রেণির ছাত্র। পরিবারের সবাইকে হত্যার পর তাদের লাশ রাসেলকে দেখিয়ে পরে তাকে হত্যা করা হয়। ঘাতকরা ব্রাশ ফায়ার করে রাসেলকে মেরে ফেলার পর তার নিথর দেহ মায়ের মৃতদেহের উপর শুইয়ে দিয়েছিল।

জাতীয় শোক দিবস প্রতিবছর পালন করা হয় ঠিক, কিন্তু দিবসটি কেবল বছরের একটি দিনের জন্য নয়। ইতিহাস চলে তার নিজের গতিতে সত্যকে লালন করে। দেশের স্বাধীনতার নেতৃত্ব দানকারী নেতাকে হত্যার মধ্য দিয়ে বাংলার ইতিহাসে যে কলঙ্ক লেপন করা হয়েছে তা কোনদিনই মোছার নয়। কিন্তু এই নেতার প্রাণ মৃত্যুহীন। সত্য রক্ষার জন্য ইতিহাসই তাকে ধরে রাখবে। ইতিহাস থেকে তার নাম কেউ মুছতে পারবে না।

বঙ্গবন্ধু আজ নেই কিন্তু তার স্বপ্ন আছে। সে স্বপ্ন তিনি রেখে গেছেন আমাদেরই মাঝখানে। তিনি একটি সোনার বাংলা গড়ে তোলার স্বপ্ন দেখেছেন। তার সেই স্বপ্নপূরণ করার দায়িত্ব আজ আমাদের। কিন্তু দুঃখ হয়, যখন আমরা দেখতে পাই বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ ও এর অঙ্গ সংগঠনের নেতাকর্মীরা নিজেদের মধ্যে মারামারিতে লিপ্ত হন। তাদের বুলেট গিয়ে অন্তঃস্বত্তা মাকে তো বটেই মায়ের গর্ভের শিশুকে এফোঁড় ওফোঁড় করে দেয়। জাতির পিতার ডাকে স্বাধীন হওয়া দেশে ভূমিষ্ঠ হয়ে গলা ফাঁটিয়ে কেঁদে ওঠার কথা যে শিশুর, সে গুলিবিদ্ধ হয়েছে মায়ের জঠরেই!

 

এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে, আওয়ামী লীগ ও এর অঙ্গ সংগঠন ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা স্বার্থসংশ্লিষ্ট দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়ছেন। আর তা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে দলের উচ্চ পর্যায়ের নেতার বক্তব্যে। খাই খাই করে দল খাটো হয়- এমন কোন পরিস্থিতির সৃষ্টি না করার জন্য আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও জনপ্রশাসন মন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম দলের নেতাকর্মীদের প্রতি আহবান জানিয়েছেন।

রাজধানীর ধানমন্ডিতে বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘরের সামনে ১১ আগস্ট মঙ্গলবার বিকেলে স্বেচ্ছাসেবক লীগ আয়োজিত জাতীয় শোক দিবসের আলোচনাসভায় বক্তৃতাকালে তিনি এ আহ্বান জানান। সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম বলেন, ‘আওয়ামী লীগ পরিবারের সকল সদস্যের প্রতি অনুরোধ রাখবো, ক্ষমতার স্বাদ ভবিষ্যতেও পাবেন। কিন্তু খাই খাই করে দল খাটো হয়- এমন কোন পরিস্থিতির সৃষ্টি না করি। পঁচাত্তরে এমন পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছিল বলেই বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা সম্ভব হয়েছিল। আমরা যেন এখন সেই পরিবেশ সৃষ্টি না করি।’

সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সম্পর্কিত বিভিন্ন প্রেক্ষাপট তুলে ধরেন। তার বক্তব্যের সারসংক্ষেপ হলো এই যে, সে সময়ও আওয়ামী লীগ ছিল, ছাত্রলীগ ছিলো। নির্মমভাবে জাতির জনক ও তার পরিবারের সদস্যদের হত্যা করা হল অথচ সেটা কী আন্দাজ করা যায়নি? এতবড় একটি ঘটনা ঘটল অথচ তার নিজের দলের লোকরা জানল না? এটা হতে পারে না।

এই আলোচনা সভায় বক্তৃতায় সৈয়দ আশরাফ আরো বলেন, ‘আমরা তো বঙ্গবন্ধুকে রক্ষা করতে পরিনি। দ্বিতীয়বার যদি এ ধরনের পরিস্থিতি আসে আমরা কি পারবো? আমরা কি প্রস্তুত? আমার তো মনে হয় না। এ নিয়ে এখন থেকেই সজাগ ও সতর্ক থাকতে হবে।’

শেখ মুজিবুর রহমানের শাহাদাৎবার্ষিকী উপলক্ষে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন গত ৪ আগস্ট রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে এক শোকসভার আয়োজন করে। অত্যন্ত দু:খজনক যে, এই  শোকসভায় চেয়ারে বসা নিয়ে ছাত্রলীগের দুপক্ষের মধ্যে লেগে যায় মারামারি। এই মারামারির খবর বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রচার ও প্রকাশ হয়েছে। চেয়ারে বসা নিয়ে নিজেদের মধ্যে মারামারির ঘটনা জাতীয় শোক দিবসের শোকসভার গাম্ভীর্যকে ম্লাণ করে দিয়েছে। অথচ এই আলোচনা সভায়ও বক্তৃতায় সৈয়দ আশরাফ বলেন, ‘বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে আমরা কোনো তর্ক-বিতর্ক দেখতে চাই না। আমরা জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করতে চাই। বিভাজন চাই না।’

বঙ্গবন্ধুর আদর্শে গড়ে ওঠা রাজনৈতিক দলের মধ্যে আজ নেতাকর্মীদের রেশারেশি ও মারামারির খবর আমাদেরকে ব্যথিত করে। বঙ্গবন্ধু যে সোনার বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্ন দেখেছেন তা বাস্তবায়নের দায়িত্ব কী তার দলের নেতাকর্মীদের ওপর বর্তায় না? অথচ সে দায়িত্ব পালনে যে তৎপরতা দরকার তা দলীয় অনেকের মধ্যে চোখে পড়ে না। এই দলের নেতাকর্মীরা ৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে রক্ষা করতে পারেননি। এমনকি তার প্রাণনাশ হওয়ার পর প্রতিবাদে তাদের ফেটে পড়ার উল্লেখযোগ্য কোন ঘটনার কথা আমরা জানতে পারি না।

শেখ মুজিবুর রহমান বাঙালির বীরত্বের প্রতীক, জাতির ইতিহাসে এক মহানায়ক। যে কোন জাতির ভাগ্যে এমন বীরের আগমন সহজে ঘটে না। বাংলা ভাষার জন্য আন্দোলনে, ৬ দফা আন্দোলনে তো বটেই, বাঙালির সব আন্দোলন-সংগ্রামে তার ভূমিকা ছিলো ঐতিহাসিক। তার নেতৃত্ব না থাকলে হয়তো বাংলাদেশ স্বাধীনভাবে মাথা উঁচু করে বিশ্ব দরবারে দাঁড়াতে পারত না। এই জাতীয় বীরকে আমরা রক্ষা করতে পারিনি, তার স্বাভাবিক মৃত্যুর নিশ্চয়তা দিতে পারিনি।

আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলামের বক্তব্যের সূত্র ধরে আমরা বলতে চাই, পঁচাত্তর সালের পরিস্থিতি যেন আর ফিরে না আসে। বঙ্গবন্ধুকে তার শাহাদৎবার্ষিকীতে যথাযথ মর্যাদায় স্মরণ করা হবে- এটাই আমরা প্রত্যাশা করি। তিনি গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন সোনার বাংলা। জাতীয় শোক যেন সেই সোনার বাংলা গড়ে তোলার শক্তিতে পরিণত হয়, সেটাই হোক সবার প্রচেষ্টা।


লেখক : সাংবাদিক




রাইজিংবিডি/ঢাকা/১৪ আগস্ট ২০১৫/শাহনেওয়াজ/তাপস রায়
 

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়