ঢাকা     রোববার   ১৪ ডিসেম্বর ২০২৫ ||  অগ্রহায়ণ ২৯ ১৪৩২

Risingbd Online Bangla News Portal

‘তৃতীয় লিঙ্গের মানুষের অধিকারে সচেতন হোন’ 

আসিফ হোসেন || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৭:০৬, ৭ সেপ্টেম্বর ২০২০   আপডেট: ১৭:০৭, ৭ সেপ্টেম্বর ২০২০
‘তৃতীয় লিঙ্গের মানুষের অধিকারে সচেতন হোন’ 

আমরা সবাই মানুষ। এই পৃথিবীতে বেঁচে থাকার অধিকার আছে সবার। স্বাভাবিক জীবনযাপন করারও অধিকার আছে সবার। কিন্তু সমাজের তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ সেই অধিকার পায় না। তারা সমাজে হিজড়া হিসেবে পরিচিত। 

সরকারের সমাজসেবা অধিদপ্তরের জরিপ মতে, বাংলাদেশে তৃতীয় লিঙ্গের মানুষের সংখ্যা মাত্র ৯,৮৯২ জন। কিন্তু গবেষকদের হিসাব মতে, সারাদেশে হিজড়াদের সংখ্যা দেড় লাখেরও বেশি। তাদের বেশির ভাগই থাকে ঢাকা শহরে। শুধু রাজধানীতেই এদের সংখ্যা ১৫ হাজারের মতো।

আমাদের কাছে হিজড়া মানে বিরক্তি ও আতঙ্ক। শহরের লোকজনের কাছে তো তারা নিয়মিত বিড়ম্বনার কারণ। শহরে সাধারণ মানুষের চলাচলের প্রায় সব জায়গাতেই অহরহ দেখা মেলে এই অদ্ভুত ব্যবহার করা মানুষের। তাদের চাঁদাবাজির ঘটনা সম্পর্কে সবাই অবগত। তারা বেশিরভাগই বাজার, রাস্তা, গণপরিবহন, পার্কের মতো স্থানে জোরপূর্বক টাকা আদায়ের চেষ্টা করে।

টাকা আদায় না করতে পারলে অশ্লীল ভাষায় গালাগাল করে। কেউ কেউ অসহায় হয়ে নামে ভিক্ষাবৃত্তিতে। আবার কেউ লিপ্ত হয় যৌনকর্মে। কিন্তু তারা কেন এই পথগুলো বেছে নেয়? তার কারণ আমাদের এই সমাজ ব্যবস্থা।

বাংলাদেশ সরকার ২০১৪ সালের ২৬ জানুয়ারি, হিজড়াদের ‘তৃতীয় লিঙ্গ’ হিসাবে স্বীকৃতি প্রদান করে। তারা স্বীকৃতি পেলেও তাদের নিয়ে সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গিতে তেমন কোনো পরিবর্তন আসেনি। তথাকথিত সভ্য সমাজে তাদের বাস করতে দেখা যায় না। কারণ তাদের জোরপূর্বক আলাদা করে দেওয়া হয়। কিংবা তারা নিজেরাই আলাদা হতে বাধ্য হয়।

তাদের প্রতি আমাদের ব্যবহার এটাই প্রকাশ করে যে তারা আলাদা, তারা অসম্পূর্ণ, তাদের এই পৃথিবীতে সেই অধিকার নেই, যেটা স্বাভাবিক নারী ও পুরুষের আছে। পরিবার থেকে শুরু করে সমাজের প্রতিটি জায়গাতে তারা অপমান, উপহাস, তাচ্ছিল্য ও নিগ্রহের শিকার হয়। হিজড়া পরিচয়ে কোনো শিশু বিদ্যালয়ে যেতে পারে না। কোনো পরিবার তার সন্তানকে হিজড়া হিসাবে পরিচয় করিয়ে দিতে পারে না। সমাজও তাদের মেনে নেয় না। সমাজের নিরক্ষর ব্যক্তি হোক বা শিক্ষিত সম্মানজনক ব্যক্তি রাস্তায় তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ দেখলে সবাই তাদের দিকে এমনভাবে তাকায়, যেন তারা চিড়িয়াখানার কোনো প্রাণী।

তৃতীয় লিঙ্গের মানুষকে আমরা লিঙ্গ প্রতিবন্ধী বলতে পারি। তাদের দেহে কিছু ত্রুটি থাকে। এই ত্রুটির মূল কারণ সন্তান গর্ভে থাকা অবস্থায় গর্ভবতী নারীর বিভিন্ন হরমোনের পরিবর্তন। এছাড়াও জন্মের পরবর্তী সময়ে বিভিন্ন কারণে তাদের দেহে ও আচরণে নারী ও পুরুষ উভয়ের লক্ষণ প্রকাশ পায়। যেগুলোর উপর তাদের কোনো নিয়ন্ত্রণ থাকে না। আর এই অনিয়ন্ত্রিত বিষয়ের জন্য তাদের সারাজীবন লড়াই করতে হয়। উৎসর্গ করতে হয় সব লোকলজ্জা। বেছে নিতে হয় এসব ঘৃণ্য কর্মপন্থা।

তাদের দেহে ও আচরণে কিছুটা পরিবর্তন ছাড়া বাকি সবই আমাদের মতোই। তারা শারীরিকভাবে পঙ্গু নয়। তারা সক্ষম মানুষ। তাদেরও একটা স্বাভাবিক মস্তিষ্ক আছে। তাদেরও বুদ্ধিমত্তা আছে। তাদেরও আবেগ আছে। তারাও স্বাভাবিক জীবনের আশা করে। তারাও নিজের মধ্যে থাকা সৃজনশীলতাকে কাজে লাগিয়ে নিজের ও সমাজের জন্য কিছু করতে চায়। ভিক্ষাবৃত্তি ও অপকর্ম নয়, তাদেরকে সম্মানজনক পেশায় নিযুক্ত করার ব্যবস্থা করতে হবে।

সমাজের বৈষম্যমূলক দৃষ্টিভঙ্গি ও আচরণের জন্য বেশিরভাগ তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ লিপ্ত হয় অপকর্মে। কিন্তু তাদের মধ্যে অনেকে পছন্দ করে না এই ধরনের কাজ। তারা লোকলজ্জা, উপহাস, তাচ্ছিল্যকে পেছনে ফেলে ছুটে চলে জীবিকার জন্য। আমাদের উচিৎ তাদের সম্মান করা। তাদের উৎসাহিত করা, তাদের পাশে দাঁড়ানো। কাউকে হেয় করা কোনো মানুষের নৈতিক কাজ নয়।

হিজড়াদের সমান অধিকার নিশ্চিত করতে সবার সম্মিলিত উদ্যোগ প্রয়োজন। তারা যেহেতু অন্য মানুষের মতো সব কাজ করতে সক্ষম, সেহেতু তারা যেন সব ধরনের কাজ করার সুযোগ পায় এজন্য সবাইকে সচেতন হতে হবে। তারাও যেন সমাজের অন্য মানুষের মতো শিক্ষা গ্রহণ করে সম্মানজনক পেশায় নিযুক্ত হতে পারে, তার জন্য প্রয়োজনীয় কর্মসূচি গ্রহণ করতে হবে।

তৃতীয় লিঙ্গের শিশুকে স্কুলগামী করতে বাবা-মাকে উৎসাহিত করতে হবে। স্কুলগামীদের জন্য বৃত্তির ব্যবস্থা করতে হবে। প্রাপ্তবয়স্কদের কারিগরি শিক্ষার ব্যবস্থা করতে হবে। ঋণসুবিধা প্রদানের মাধ্যমে তাদের উদ্যোক্তায় পরিণত করতে হবে। 

বাংলাদেশ সরকার হিজড়াদেরকে তৃতীয় লিঙ্গ হিসাবে স্বীকৃতি দেওয়ার পূর্বে ও পরবর্তী সময়ে তাদের জন্য অনেক কর্মসূচি গ্রহণ করেছেন। সরকার হিজড়াদের সমাজের মূলধারায় ফিরিয়ে আনতে ২০০৮ সালে ভোটাধিকার প্রদান করেন। শিক্ষা অধিদপ্তর ২০১২ সাল থেকে তৃতীয় লিঙ্গ শিশুদের জন্যে শিক্ষা উপবৃত্তি চালু করেন।

কর্মসূচিগুলোর উদ্দেশ্য হলো তাদের শিক্ষা, প্রশিক্ষণ, সহায়তা ও উন্নয়ন। যার জন্য বরাদ্দ হয়েছে প্রচুর অর্থ। এই অর্থ সরকারের কোষাগার থেকে বের হয়, কিন্তু সরকারি কর্মকর্তাদের দুর্নীতির জন্য সুষ্ঠুভাবে ব্যয় হয় না। শুধু অর্থ বরাদ্দের মাধ্যমে কোনো কিছুতে পরিবর্তন আনা সম্ভব নয়। পর্যাপ্ত অর্থ বরাদ্দের সঙ্গে প্রয়োজন তার সুষ্ঠু তদারকির ব্যবস্থা। অনেক বেসরকারি সংস্থাও এ ধরনের কাজে যুক্ত আছে।

এসব কর্মসূচির পাশাপাশি বিভিন্ন সচেতনতামূলক কার্যক্রমও গ্রহণ করতে হবে। শিক্ষিত-অশিক্ষিত সবাইকে বোঝাতে হবে যে তারাও আমাদের মতো মানুষ। স্বাভাবিক নারী পুরুষের মতো তাদেরও অধিকার আছে শিক্ষা, চাকরি সব কিছুতেই। সবাইকে সচেতন করতে হবে যেন সমাজে কোনো তৃতীয় লিঙ্গ সন্তান জন্মগ্রহণ করলে তাদের পিতা-মাতাকে কটুক্তি না করে। সবাই যেন তাদের সঙ্গেও অন্যদের মতো স্বাভাবিক ব্যবহার করে।

লেখক: শিক্ষার্থী, ট্যুরিজম অ্যান্ড হসপিটালিটি ম্যানেজমেন্ট বিভাগ, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়।

ইবি/মাহফুজ/মাহি

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়