ঢাকা     রোববার   ১৪ ডিসেম্বর ২০২৫ ||  অগ্রহায়ণ ২৯ ১৪৩২

Risingbd Online Bangla News Portal

‘জলাতঙ্ক’ অভিশাপ থেকে মুক্তির উপায়

শাহ মতিন টিপু || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৫:২৭, ২৮ সেপ্টেম্বর ২০১৫   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
‘জলাতঙ্ক’ অভিশাপ থেকে মুক্তির উপায়

শাহ মতিন টিপু : জলাতঙ্ক রোগের কারণে পৃথিবীতে প্রতিবছর প্রায় ৬০ হাজার লোকের মৃত্যু হয়। এর প্রায় দুই হাজার জনেরই মৃত্যু ঘটে বাংলাদেশে। প্রতিবছর কুকুর-বিড়ালের কামড়ে আক্রান্ত হয়ে জলাতঙ্কের ঝুঁকিতে পড়ে প্রায় তিন লাখ মানুষ। আপনারা জেনে আশ্চর্য হবেন, ভারতের পর বাংলাদেশে জলাতঙ্কজনিত রোগীর মৃত্যুসংখ্যা বিশ্বের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ। তবে বিশেষজ্ঞদের মতে, এ সংখ্যা আরো অনেক বেশি। কারণ বাংলাদেশে জলাতঙ্ক রোগের তথ্য সংগ্রহ এবং সংরক্ষণের কোনো সামগ্রিক ব্যবস্থা আজও গড়ে ওঠেনি।

আজ বিশ্ব জলাতঙ্ক দিবস। ইংরেজিতে World Rabies Day. প্রতিবছর ২৮ সেপ্টেম্বর দিবসটি বিশ্বব্যাপী পালিত হয়। জলাতঙ্ক জীবাণু সম্পর্কে সচেতনতা সৃষ্টি করতেই সারা বিশ্বে বিশ্ব জলাতঙ্ক দিবস পালিত হয়। এই রোগের রোগীরা জল দেখে বা জলের কথা মনে পড়লে প্রচণ্ড আতঙ্কিত হয় বলে এই রোগের নাম জলাতঙ্ক।

ভাইরাসজনিত এই রোগটি সাধারণত কুকুর, শেয়াল, বাদুড় প্রভৃতি উষ্ণ রক্তের প্রাণীদের মধ্যে দেখা যায়। এটি এক প্রাণী থেকে আরেক প্রাণীতে পরিবাহিত হয় তার লালা বা রক্তের দ্বারা। প্রতিবছর বিশ্বে যত মানুষ কুকুরের দ্বারা আক্রান্ত  হয়ে মারা যায় তার ৯৯ শতাংশই এই রোগের কারণে হয়। এবার দিবসটির প্রতিপাদ্য ‘সকলে মিলে জলাতঙ্ক প্রতিরোধ করি’।

শত বছর ধরেও কুকুর মেরে জলাতঙ্ক প্রতিরোধ করা সম্ভব হয়নি। জলাতঙ্ক প্রতিরোধে বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও কয়েক বছর আগে থেকে কুকুরকে টিকাদান কর্মসূচি হাতে নেওয়া হয়েছে। কুকুরকে টিকাদান কর্মসূচিতে স্বাস্থ্য অধিদফতরের সঙ্গে যৌথভাবে কাজ করছে আন্তর্জাতিক সংগঠন ওয়ার্ল্ড সোসাইটি ফর দ্য প্রোটেকশন অব অ্যানিমেলস (ডব্লিউএসপিএ)। ডব্লিউএসপিএ জানায়, জলাতঙ্ক নিয়ন্ত্রণে কুকুর নিধন অকার্যকর পদক্ষেপ হিসেবে প্রমাণিত হয়েছে। পক্ষান্তরে কুকুরকে টিকাদান পদ্ধতি বৈজ্ঞানিক ও কার্যকর উপায়।

দিবসটি উপলক্ষে ওয়ান হেলথ উইং ভয়েস বাংলাদেশ মাসব্যাপী জলাতঙ্ক রোগ সম্পর্কে সচেতনতা, কুকুরের জন্মনিয়ন্ত্রণ সম্পর্কে জনসচেতনতা তৈরিতে প্রচারণা, শোভাযাত্রা ও স্কুল পর্যায় সচেতনতা সৃষ্টি করছে। বিশ্ব জলাতঙ্ক দিবস উপলক্ষে আজ স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ও প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের উদ্যোগে বিভিন্ন কর্মসূচি হাতে নেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে শোভাযাত্রা, সেমিনার, ভ্যাকসিন প্রদান উল্লেখযোগ্য বলে জানিয়েছেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (রোগ নিয়ন্ত্রণ) অধ্যাপক ডা. আবুল খায়ের সামসুদ্দিন চৌধুরী।

জলাতঙ্ক বা র‌্যাবিসের লক্ষণ : ক্ষতস্থান চুলকানো, ক্ষতস্থানে ব্যথা, মুখ থেকে লালা নিঃসৃত হওয়া, উত্তেজনা, স্বল্পমাত্রায় জ্বর, গিলতে সমস্যা হওয়া, পানি পিপাসা থাকা, পানি দেখে ভয় পাওয়া, মৃদু বায়ু প্রবাহে ভয় পাওয়া, আবোল-তাবোল বকা, প্যারালাইসিস ইত্যাদি।

এ ভাইরাস মগজের নিউক্লিয়াস এমবিগুয়াসে আক্রমণ করে। মগজের এ অংশটি প্রশ্বাসে নিয়োজিত শরীরের বিভিন্ন অংশকে অতিরিক্ত উত্তেজনা থেকে দমন করে রাখে এবং শ্বাস-প্রশ্বাসের সমন্বয় ঘটায়। কিন্তু ভাইরাস সংক্রমণে এ কাজে ব্যাঘাত ঘটে। ফলে জলাতঙ্ক রোগী যখন পানি খেতে যায়, তখন তার গলা ও শ্বাসনালি উত্তেজনায় সংকুচিত হয়ে তীব্র ব্যথার অনুভূতি জাগায়। সেই সঙ্গে কিছু পানি শ্বাসনালি দিয়ে মূল শ্বসনতন্ত্রে প্রবেশ করে কাশি হয়ে এক ভীতিকর পরিস্থিতির সৃষ্টি করে।

অনেকে মনে করেন, কুকুরে কামড়ালেই জলাতঙ্ক হবে, কিন্তু সব কুকুরে কামড়ালেই জলাতঙ্ক হয় না। কারণ এটা প্রধানত পশুদের রোগ। তাই প্রথমত পশুদের এটি হতে হবে। তার পরই তা মানুষের মধ্যে সংক্রমিত হবে। শুধু কুকুর নয়, বিড়াল বা অন্য যেকোনো প্রাণীর কামড় থেকেও এ রোগ হতে পারে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে আঁচড় থেকেও এ রোগ হয়।

জলাতঙ্কের চিকিৎসা গ্রামমুখী করা জরুরি : এখন পর্যন্ত জলাতঙ্ক চিকিৎসা রয়ে গেছে কেবলই শহরমুখী। সিটি করপোরেশন ও জেলা শহরের বাইরে উপজেলা পর্যায়ে জলাতঙ্ক রোগীদের চিকিৎসার কোনো ব্যবস্থা নেই। ফলে গ্রাম বা উপজেলা পর্যায়ের রোগীদের ছুটে আসতে হয় জেলা শহরে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (রোগ নিয়ন্ত্রণ) অধ্যাপক ডা. আবুল খায়ের সামসুদ্দিন চৌধুরী বলেন, ‘উপজেলা পর্যায়ে কারিগরি কিছু সমস্যা থাকে। বিশেষ করে ভ্যাকসিনগুলোর প্রতি ভায়াল চারজনের জন্য নির্ধারিত। কিন্তু অনেক সময়ই রোগী পাওয়া যায় না। একটি ভায়াল থেকে মাত্র একজনের জন্য ব্যবহার করার পর বাকি ওষুধ ফেলে দিতে হয়, যা বড় ধরনের অপচয়। এ ছাড়া বাজেটেরও বড় রকম সংকট রয়েছে। তাই আপাতত জেলা শহর পর্যন্তই চিকিৎসা কার্যক্রম চালাতে হচ্ছে।’

এদিকে জলাতঙ্ক রোধে সরকারের বিভিন্ন উদ্যোগ চলছে অনেকটাই বিশৃঙ্খল অবস্থার মধ্য দিয়ে। পাঁচ বছর আগের তথ্য-উপাত্ত ও ব্যবস্থাপনায় ভর করেই চলছে সচেতনতা ও চিকিৎসা কার্যক্রম। মানুষের পাশাপাশি কুকুরকে ভ্যাকসিন দেওয়া হলেও এর কোনোটিরই কার্যকারিতা পরীক্ষার কোনো পদক্ষেপ নেই।

জলাতঙ্ক রোগ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. মোয়াজ্জেম হোসেন বলেন, ‘মানুষ ও কুকুরের ভ্যাকসিনগুলো একটানা দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু এগুলোর কার্যকারিতা কী পর্যায়ে আছে, তা পরীক্ষা-নিরীক্ষা বা গবেষণার কোনো উদ্যোগ দেখছি না; যা খুবই সংশয়ের ব্যাপার।’

জলাতঙ্ক চিকিৎসা ব্যবস্থাপনায় আগের চেয়ে অনেকটাই পরিবর্তন এসেছে। জলাতঙ্ক প্রতিরোধে একযোগে চলছে মানুষ ও কুকুরকে ভ্যাকসিন দেওয়ার কার্যক্রম। তবু মানুষের ভয় কমছে না। দেশজুড়ে জলাতঙ্কভীতি আছেই। বিশেষজ্ঞরা বলেন, সরকারের পক্ষ থেকে গৃহীত কার্যক্রমগুলোর মধ্যে সমন্বয় ও শৃঙ্খলার অভাবে সাধারণ মানুষের কাছে সঠিক তথ্য যাচ্ছে না। মানুষ এই চিকিৎসা কার্যক্রম ও কুকুর ব্যবস্থাপনা সম্পর্কে জানতে পারে না। ঢাকায় সামান্য পরিসরে কুকুর ব্যবস্থাপনার কাজ হলেও সারা দেশে এর তেমন কোনো প্রতিফলন দেখা যায় না।

অধ্যাপক ডা. মোয়াজ্জেম হোসেন জানান, আগে এ দেশে আধুনিক ও সহজলভ্য চিকিৎসাব্যবস্থা ছিল না। এই রোগ নিরাময়ে আক্রান্ত ব্যক্তির নাভি ঘিরে ১৪টি ইনজেকশন দেওয়া হতো। নার্ভ টিস্যু ভ্যাকসিন (এনটিভি) নামের ওই ভ্যাকসিনের নানা গুরুতর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া থাকায় তা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। একই সঙ্গে ২০১০ সালের জুলাই থেকে দেশে সরকারিভাবে অত্যাধুনিক ও অধিক নিরাপদ টিস্যু কালচার ভ্যাকসিন (টিসিভি) ইনজেকশন চালু করা হয়েছে। হাতের বাহুর চামড়ায় অনেকটা ইনসুলিনের আদলেই এই ভ্যাকসিন প্রয়োগ করা হয়। একজন রোগী চারবার এই ভ্যাকসিন দেবে। প্রথমবার দেওয়ার পরের তৃতীয়, সপ্তম ও ২৮তম দিনে এই ডোজ দেওয়া হয়।

জলাতঙ্ক বা র‌্যাবিস একটি ১০০ ভাগ মৃত্যুঝুঁকিপূর্ণ রোগ। এ রোগের ভাইরাস শরীরে প্রবেশ করে লক্ষণ প্রকাশ পেতে সাধারণত তিন সপ্তাহ থেকে তিন মাস পর্যন্ত সময় লাগতে পারে। তবে কোনো কোনো ক্ষেত্রে কামড় বা আঁচড়ের ধরন ও স্থানভেদে চার দিন থেকে কয়েক বছর পরেও এ রোগের লক্ষণ প্রকাশ পেতে পারে। এমনকি ১৮ বছর পরেও এ রোগের লক্ষণ প্রকাশ পাওয়ার কথা জানা গেছে।

সুতরাং এ জাতীয় যেকোনো প্রাণীর কামড়, আঁচড় বা কোনো ক্ষতস্থানে লালার স্পর্শ হলে যত দ্রুত সম্ভব ক্ষতস্থানটি প্রচুর সাবান পানি দিয়ে অন্তত ১০ মিনিট ধরে খুব ভালো করে ধুয়ে ফেলতে হবে। ক্ষতস্থানে পভিডন আয়োডিন বা অন্য কোনো অ্যান্টিসেপটিক লাগাতে হবে এবং অনতিবিলম্বে ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী জলাতঙ্কের আধুনিক ভ্যাকসিন গ্রহণ করে চিকিৎসা শুরু করতে হবে।

আমাদের একটি কথা অবশ্যই মনে রাখতে হবে, ক্ষতস্থানটিতে যেন আমরা ব্যান্ডেজ বা সেলাই না করি। যেহেতু এ রোগের কোনো চিকিৎসা নেই, সেহেতু তাবিজ-কবচ, পানি-থালা-কলা পড়া ইত্যাদি করে মূল্যবান সময় কোনোভাবেই নষ্ট করা ঠিক হবে না। জলাতঙ্কের বিরুদ্ধে আধুনিক প্রতিরোধমূলক চিকিৎসাব্যবস্থা গ্রহণ করে বিশ্বের অনেক দেশই আজ এ রোগের অভিশাপ থেকে মুক্তি পেয়েছে।

 

 

 

রাইজিংবিডি/ঢাকা/২৮ সেপ্টেম্বর/টিপু/এএন

রাইজিংবিডি.কম

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়