ঢাকা     রোববার   ০৫ মে ২০২৪ ||  বৈশাখ ২২ ১৪৩১

রেমাক্রি খালের উৎস সন্ধানে

ফেরদৌস জামান || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৮:২০, ৩ নভেম্বর ২০১৪   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
রেমাক্রি খালের উৎস সন্ধানে

পাথুরে প্রাচীরে ধাক্কা খেয়ে দুই ভাগ হয়ে ঝরছে রেমাক্রির উৎসমুখ তুবং ঝরনা

ফেরদৌস জামান

বাংলাদেশে সৃষ্ট একমাত্র পাহাড়ি নদী সাঙ্গু। দেশের পূর্ব-দক্ষিণের জেলা বান্দরবানের গহীন পাহাড়ে এই নদীর উৎপত্তি। সেখান থেকে পানির ধারা নেমে এসেছে ভাটির দিকে। দীর্ঘ চলার পথে তার বুকের মধ্যে মিশেছে ছোট-বড় অসংখ্য খাল। রেমাক্রি এগুলোর মধ্যে অন্যতম। রুমা উপজেলার অন্তর্গত সুনসংপাড়ার নিকটবর্তী তুবং ঝরনা থেকে রেমাক্রির উৎপত্তি। সেখান থেকে শুরু করে সাঙ্গুর মতোই চলার পথে ছোট ছোট অনেক খালের সঙ্গে মিশে রুমা থেকে থানচী- দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে একটি বাজারের নিকটে এসে রেমাক্রি পতিত হয়েছে সাঙ্গু নদীতে। মজার ব্যাপার হলো, এই বাজারটির নাম ‘রেমাক্রি বাজার’।

 

রেমাক্রির উৎস যেহেতু তুবং, সুতরাং এডভেঞ্চারপ্রিয় মানুষ সেখানে ছুটে যাবেন এটাই স্বাভাবিক। যেহেতু আমরাও দল বেঁধে ভ্রমণ করি সুতরাং আমাদেরও ইচ্ছে হলো রেমাক্রি খালের উৎসস্থান দেখার। সেই ইচ্ছেপূরণেই রওনা হলাম আমরা। অভিযাত্রী দলে এবার আমরা মাত্র তিন জন। ভেঙে ভেঙে বান্দরবান যাওয়া বেশ কষ্টকর। আমাদের সমাজে বিনয় এবং ধৈর্যের বড় অভাব! সে-ক্ষেত্রে কচ্ছপ গতির ‘চট্টগ্রাম মেইল’ ট্রেনের ধৈর্য এবং বিনয় সকলের জন্য শিক্ষণীয় একটি বিষয় হতে পারে। ছাড়ার সময় রাত দশটা হলেও প্রায় নিয়মিত ট্রেনটি দেরিতে ছাড়ে। কখনও কখনও ঘণ্টাও পার হয়ে যায়। এরপর যাত্রাপথে যেখানেই বিপরীত অথবা পেছন থেকে আন্তঃনগর ট্রেন আসে সেখানেই ট্রেনটি থেমে যায়। সম্মান ও বিনয়ের সঙ্গে তাকে সাইড দিয়ে তারপর ধীরে সুস্থে পুনরায় এই ট্রেন যাত্রা শুরু করে হেলেদুলে। ফলে এভাবে চট্টগ্রাম পৌঁছুতেই সকাল নয়টা বেজে গেল।

 

বান্দরবানের বাস পাওয়া যায় বহদ্দারহাট টার্মিনাল থেকে। তখন রোজার মাত্র দ্বিতীয় দিন, ফলে খাবারের দোকান, রেস্তোরাঁ সব বন্ধ। খুঁজব যে সে সুযোগও পাওয়া গেল না। সময় মতো বাস চলতে শুরু করায় আমরা খুশিই হলাম। কিন্তু কিছু দূর যেতেই ভুল ভাঙল। কারণ পথের মধ্যে তার কাণ্ড লোকাল বাসকেও হার মানাল। একবার তো হঠাৎ ধাম করে ব্রেক কষে চালক গাড়ি থামিয়ে নেমে গেলেন। তারপর ঘণ্টা যায় তবুও তার দেখা নেই। হেলপারকে জিজ্ঞেস করে জানলাম, প্রকৃতির বড় চাপে সাড়া দিতে তিনি নাকি আশপাশেই কোথাও আছেন। সুতরাং অপেক্ষা করা ছাড়া আর উপায় কী? অতঃপর তিনি এলেন। বাস চলতে শুরু করল। এভাবেই বান্দরবান এসে পৌঁছলাম। সেখান থেকে আরেকটি বাসে এলাম রুমা বাজার।

 

পরের দিনের পথ বেশ লম্বা, সে কথা ভেবে রাতের খাবার খেয়েই ঘুমিয়ে পরলাম রুমা বাজারের ছোট্ট একটি হোটেলের কক্ষে। খুব সকালে ঘুম থেকে উঠে চান্দের গাড়ির স্ট্যান্ডে গিয়ে জানলাম, এই মৌসুমে কেবল বাজারের দিন ছাড়া বগা পর্যন্ত নিয়মিত নাকি গাড়ি চলে না। হঠাৎ দুএকটি চললেও সেগুলোর নির্দিষ্ট কোনো  সময়সূচি নেই। সুতরাং আশায় বসে না থেকে হাঁটতে শুরু করলাম। যদি পথিমধ্যে গাড়ি মিলে যায় তো গেল, অন্যথায় হেঁটেই বগাপাড়া যাব- এই হলো মনোভাব। ইট বিছানো পথ, দৃষ্টি যেদিকে যায়- সবুজ আর সবুজ। কখনও কখনও লকলকে লম্বা কাশ ঝোঁপ আহ্লাদে ঝুকে পরেছে পথের উপর। আমরাও সেই আহ্লাদে পথ চলছি। পথে পড়ল মুনলাইপাড়া। দোকানে চা-বিস্কুট সবই পাওয়া যায়। বোনাস হিসেবে রয়েছে মৌসুমী ফল- আনারস, আম, লটকন, মিষ্টি লেবু, কলা ইত্যাদি। আম পঁচিশ টাকা কেজি, আনারস দশ থেকে পনের টাকা, আর লটকন সে তো বিনা পয়সাতেই মিলল। জানলাম স্থানীয়রা জুমের পাশাপাশি এসবেরও চাষ করছে। অবাক হলাম এই পাহাড়ে কাজু বাদামেরও চাষ হচ্ছে শুনে। মুনলাইপাড়া থেকে বেশ খানিকটা পথ তো কাজু বাদামের বাগানের মাঝ দিয়েই এগিয়েছে। সাধারণত পাহাড়ের গভীরে এত সব চাষ হয় না। কারণ যোগাযোগ ব্যবস্থাটা এ ক্ষেত্রে মুখ্য। পাহাড়ের গভীরে প্রধানত ধান ও স্বল্প পরিমাণে সবজি চাষ হয়। এ ছাড়াও মোটামুটিভাবে যোগাযোগ ব্যবস্থা যে পর্যন্ত রয়েছে , সেসব এলাকায় প্রচুর পরিমাণে আদা ও হলুদের চাষ হয়। চাষীদের আক্ষেপ, যোগাযোগের সুব্যবস্থা না থাকার কারণে তারা ফসলের উপযুক্ত মূল্য থেকে বরাবরই বঞ্চিত হচ্ছেন।

 

মুনলাইপাড়া থেকে বর্ষার মেঘে ঢাকা পথে এগিয়ে প্রায় দুই হাজার ফুট গভীরে ‘এগার মাইল’ নামক এক পাড়ায় দ্বিতীয়বার যাত্রা বিরতি করলাম। বলে রাখি, পথে একটা গাড়িও চোখে পড়েনি। সুতরাং গাড়ির আশা মাথা থেকে ঝেরে ফেললাম। আম, কলা ও গ্লুকোজের পানি খেয়ে ফের হাঁটতে শুরু করলাম। হেঁটে গিয়ে উপস্থিত হলাম নির্দিষ্ট একটি পয়েন্টে, যেখান থেকে হেঁটেই মিলিটারী ক্যাম্প হয়ে বগা এবং আরো নিচে নেমে ঝিরি পথে এগুলে বগালেকের পশ্চিম পাশের মারমাপাড়া যাওয়া যায়। বগালেক কেন্দ্র করে মারমা এবং বমদের আলাদা দুটি পাড়া রয়েছে। ঝিরি পথের শুনশান অন্ধকার পথ ধরে মারমাপাড়া চলে এলাম। সেখানে জায়গা করে নিলাম লু-পী মারমার ঘরে। লেকের জল অবধি আগানো ছোট্ট কাঠের ঘর। পাহাড়ের নির্মল বাতাস লেকের পানিতে যেন পরিশুদ্ধ হয়ে হু হু করে প্রবেশ করছে ঘরের ভেতর। ওদিকে প্রচণ্ড ক্ষুধায় পেট গিয়ে লেগেছে মেরুদণ্ডে। লু-পী দার বাগানের আম ঘরের মেঝেতে গড়াগড়ি খাচ্ছে, তিন জন কেজি পাঁচেক সাবাড় করে দিলাম। দামের কথা শুনে চোখ কপালে উঠল, বলে কী- মোটে মাত্র ত্রিশ টাকা! তিনি নাকি আমাদের খাইয়ে শান্তি পেয়েছেন। যাই হোক ফেরার পথে তার ঘরে পেঁয়াজ, মরিচ আর পাহাড়ি এক বিশেষ পাতার চাটনি দিয়ে ভাত খাওয়ার দাওয়াত গ্রহণ করে পরদিন সামনে এগিয়ে গেলাম।

 

পাশিংপাড়া পৌঁছতে গিয়ে টিপটিপ বৃষ্টির ফোঁটায় শরীর প্রায় ভিজে গেল। এখান থেকেই নেমে যেতে হয় নিচে সুনসংপাড়ায়। পাশিংপাড়ায় গোটা তিনেক দোকান রয়েছে। বিস্কুটের মোড়ক খুলে একটি দোকানে বসেছি মাত্র, হঠাৎ শুনলাম, ‘এই তারাতারি টাইগার দে!’ তাকিয়ে দেখি লাঠি হাতে তিন জন আনসার সদস্য। তারা নিচে রুমনাপাড়া সেনাক্যাম্প থেকে এসেছেন। লাল কাদায় তাদের পায়ের বুট খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। তারা জানতে চাইলেন- কোথায় যাচ্ছি? হাত দিয়ে পাহাড়ের নিচে দেখিয়ে দিতেই মন্তব্য করলেন, ‘অসম্ভব! পারবেন না।’ আত্মবিশ্বাস বোধহয় এতো বেশি থাকা ঠিক নয়। নেমে যেতে থাকলাম। ৭০- ৮০ ডিগ্রী খাড়া পাহাড়ের দেয়াল বেয়ে নামছি। বর্ষার পানিতে ছোট্ট গর্তগুলোতে পা রাখা দায়। অনেক জায়গায় স্টীলের শীট খাড়া করে বসিয়ে মাটি আটকে রেখে বানানো হয়েছে একেকটি ধাপ বা সিঁড়ি। থেকে থেকে বাঁশের রেলিং এর ব্যবস্থাও আছে। গহীন জঙ্গল, শরীরের খালি অংশে মশার সঙ্গে এক ধরনের পোকার আক্রমণ শুরু হয়ে গেল। হুল ফোটাতে তারা বেশ পারঙ্গম। এমনকি সমতলে নেমে ওদের অত্যাচারে যখন দৌড়াচ্ছি, সেই অবস্থাতেও শরীরে হুল ফুটছে। সন্ধ্যার আগে গিয়ে উপস্থিত হলাম অবসরপ্রাপ্ত এক স্কুল শিক্ষকের ঘরে। চেনা নেই জানা নেই, অথচ তিনি যেন আমাদেরকে অভ্যর্থনা জানানোর অপেক্ষায় ছিলেন। অনেক বড় ঘর, প্রথমে বিশ্রামের জায়গা করে দিলেন। তারপর দেখিয়ে দিলেন গোসলের জায়গা। দূর পাহাড়ের ঝরনা থেকে দেড় কি.মি. পাইপ লাইনের মাধ্যমে টেনে আনা হয়েছে টলটলে বিশুদ্ধ পানি।

 

গোসল করে সতেজ হয়ে প্রথমে মাস্টার সাহেবের সঙ্গে পরের দিনের পরিকল্পনা করতে বসলাম। কথার মাঝখানে চলে এলো রাতের খাবার। রুমা থেকে এক দিনে এসেছি, তাও আবার পায়ে হেঁটে। ঘটনাটি তাকে বিশ্বাস করাতে বেশ বেগ পেতে হলো। সারাদিনের পরিশ্রমের পর ধোঁয়া তোলা জুম চালের ভাত দেখে তর আর সইল না। পেট ভরে নয়, মনে হলো প্রাণ ভরে খেলাম। খাওয়ার পর দিলাম ঘুম।

 

ঘুম থেকে উঠে কটকটে রোদে তুবং-এর পথ ধরলাম। কে বলবে গত কয়েক দিন টানা বৃষ্টি চলছিল? মাস্টার সাহেবের রসিক গল্পে পথের ক্লান্তি দূর হয়ে গেল। কানে ভেসে আসতে লাগল ঝরনার গর্জন। এতটা পথ কখন চলে এসেছি আন্দাজ করতে পারিনি। জঙ্গলাকীর্ণ অন্ধকার পথে গভীরে নেমে দেখতে পেলাম পাশাপাশি জলের দুইটি ধারা। দূর থেকে এসে বিশাল পাথুরে প্রাচীরে ধাক্কা খেয়ে দুই ভাগ হয়ে ঝরছে রেমাক্রির উৎসমুখ তুবং। উঁচু থেকে এতই গতিতে ঝরছে যে, পানির চাপে সৃষ্টি হয়েছে একটি পুকুর। ভদ্রলোকের সঙ্গে ছিল মাছ ধরা জাল। সেটি দিয়ে খানিকক্ষণ মাছ ধরার ব্যর্থ চেষ্টা করলাম। এক পর্যায়ে সাঁতার দিয়ে ঝরনার নিকটে যাওয়ার চেষ্টা করে তাতেও ব্যর্থ হলাম। কারণ পানির গতি এতটাই বেশি যে, কাছাকাছি যেতেই অনুভূত হলো যেন, পানির বেগে মাথার চুল, দুই কান বোধহয় ছিঁড়ে যাবে। পরাজয় মেনে নিয়ে কিনারে এসে বসতে হলো। তারপর বসে বসেই অবাক নয়নে চেয়ে রইলাম রেমাক্রি খালের উৎসমুখে। পান করলাম রেমাক্রির উৎসের সৌন্দর্য-সুধা।

 

 

রাইজিংবিডি/ঢাকা/৩ নভেম্বর ২০১৪/তাপস রায়

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়