ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

হুমকির মুখে গৌড়ের ঐতিহাসিক স্থাপনা

জাহিদ হাসান মাহমুদ মিমপা || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৫:৪১, ২৯ জানুয়ারি ২০২০   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
হুমকির মুখে গৌড়ের ঐতিহাসিক স্থাপনা

এককালে বাংলার রাজধানী ছিল গৌড়। এটি লক্ষ্মনাবতী নামেও পরিচিত। প্রাচীন এই নগরীর একাংশ পড়েছে পশ্চিমবঙ্গের মালদা জেলায় এবং অন‌্য অংশ চাঁপাইনবাবগঞ্জে।

প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের উদাসীনতায় হুমকির মুখে পড়েছে বহু ঐতিহাসিক পুরাকীর্তি। কয়েকশ’ বছর আগের এসব প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনের বেশিরভাগই ধ্বংসপ্রায়। অনেক নিদর্শন এখনো প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের তালিকার বাইরে। দু-একটি পুরাকীর্তি সংস্কার করা হলেও বেশিরভাগই পড়ে আছে অযত্নে-অবহেলায়। তবে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের দাবি, একে একে প্রতিটি নিদর্শনই সংস্কার করা হচ্ছে। এসব ঐতিহাসিক স্থাপনা ও নিদর্শন দ্রুত সংস্কারের দাবি জেলাবাসীর।

চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা জুড়েই আছে নানা প্রাচীন নিদর্শন ও ঐতিহাসিক স্থাপনা। এর মধ্যে অন্যতম ঐতিহাসিক ছোট সোনা মসজিদ। মুসলিম স্থাপত্যশিল্পের এক অপূর্ব নিদর্শন এটি। মসজিদের চার কোণে চারটি অষ্টকোণাকৃতির মিনার এবং ওপরে ১২টি অর্ধগোলাকৃতির ও তিনটি চৌচালা আকৃতির গম্বুজ আছে। গম্বুজগুলোতে একসময় সোনার পিণ্ড ছিল। তাই এর নামকরণ করা হয় সোনা মসজিদ। স্থাপত্যকলা ও শৈল্পিক সৌন্দর্যের বিচারে এ মসজিদ গৌড়ের রত্ন হিসেবে পরিচিত। সুলতান আলাউদ্দিন হোসেন শাহের আমলে ওয়ালী মুহাম্মাদ কর্তৃক ১৪৯৩ থেকে ১৫১৯ খ্রিস্টাব্দের মধ‌্যে মসজিদটি নির্মিত হয়।

ঐতিহাসিক ছোট সোনা মসজিদের সামান্য দূরেই তোহাখানা। ১৬৫৫ সালে শাহ সূজা এটি নির্মাণ করেন। এর পাশেই আছে মোগল আমলের একটি মসজিদ ও হজরত শাহ নেয়ামতুল্লাহর (রহ.) মাজার। সঠিকভাবে রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে ধ্বংস হচ্ছে এসব স্থাপনা।

সোনা মসজিদ রেস্ট হাউসের কেয়ারটেকার আব্দুল মতিন বলেন, যেসব ঐতিহাসিক নিদর্শন রয়েছে- মসজিদ, মন্দির, রাজবাড়ি এগুলো সংস্কার করা একান্ত প্রয়োজন। সোনা মসজিদের সৌন্দর্যবর্ধনের জন্য এর উত্তর দিকে পুকুরপাড়ে বাউন্ডারি দরকার। নিরাপত্তার জন্য নেই প্রহরী। ঐতিহাসিক এ মসজিদকে ধ্বংসের হাত থেকে বাঁচাতে হলে এর পাশ দিয়ে যে মহাসড়ক রয়েছে তা বাইপাস করা একান্ত দরকার। কারণ, প্রতিদিন এই মহাসড়ক দিয়ে সোনা মসজিদ বন্দর থেকে ৪০০-৫০০ ট্রাক চলাচল করে। এ সময় কেঁপে ওঠে পুরো মসজিদটি। ঐতিহাসিক নিদর্শনগুলো রক্ষণাবেক্ষণে প্রয়োজন কাস্টডিয়ান অফিস।

চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জ উপজেলার বালিয়াদিঘি গ্রামের পশ্চিমে অবস্থিত প্রাচীন স্থাপত্য কলার আরেক নিদর্শন দারাসবাড়ি মসজিদ। মসজিদটি বাংলার মুসলিম শাসনামলের মধ্যযুগীয় স্থাপত্যকলার নিদর্শন। মসজিদের পূর্ব পাশে ছোট দিঘির পাশেই বিশাল এলাকাজুড়ে রয়েছে দারাসবাড়ি মাদ্রাসা। ধারণা করা হয়, পঞ্চদশ শতকে সুলতান আলাউদ্দিন হোসেন শাহের আমলে নির্মিত এ মাদ্রাসাটি বাংলাদেশর সবচেয়ে প্রাচীন মাদ্রাসা। সুবৃহৎ এ মসজিদটি বর্তমানে ভগ্নপ্রায়।

মসজিদটি সম্পর্কে সোনা মসজিদ এলাকার গৌড় বংশের নুরুল হুদা সাত্তারী গৌড়ীয়া জানান, বহুদিন আগেই ভেঙে গেছে মসজিদটির ছাদ। অথচ জেলায় যেসব মুসলিম শাসনামলের মসজিদ রয়েছে এটি তার মধ্যে সর্ববৃহৎ। একসময় মাদ্রাসাটি বিশ্ববিদ্যালয় ছিল। যেখানে নদীয়া, পশ্চিম দিনাজপুর, মালদহ, দেশের উত্তরবঙ্গ ও দক্ষিণবঙ্গের লোকজন উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করত। মাদ্রাসাটিতে ৩০০ জন শিক্ষক সে সময় শিক্ষা দিতেন। এ প্রত্নতাত্তিক নিদর্শনটি জরুরি ভিত্তিতে সংস্কার করা প্রয়োজন।

জেলার গোমস্তাপুর উপজেলার রহনপুরে অবস্থিত সর্বপ্রাচীন প্রত্নসম্পদ নওদা বুরুজ। স্থানীয়রা একে বলে থাকেন ষাঁড় বুরুজ। এর সঠিক ইতিহাস উদঘাটনে প্রয়োজন পরিকল্পিত উৎখনন। কিন্তু আজও সেটি হয়নি। উল্টো অবহেলা আর অযত্নে দিনের পর দিন ক্ষয়ে যাচ্ছে এ প্রত্ন নিদর্শনটি। চারপাশে গড়ে উঠেছে বহু অবৈধ ঘরবাড়ি। দখল হয়েছে এর আশপাশের জমিও। প্রতিবছর বর্ষায় এর মাটি গলে ক্ষয়ে যাচ্ছে। এর চারপাশে নেই সীমানা প্রাচীরও।

এসব ঐতিহাসিক সম্পদ সংরক্ষণে সরকার জরুরি ভিত্তিতে কার্যকর ব্যবস্থা নেবে, এমন আশা ইতিহাসবিদ ও প্রত্নতত্ত্ব গবেষকদের।

চাঁপাইনবাবগঞ্জ সরকারি কলেজের বাংলা বিভাগের প্রধান ও আঞ্চলিক ইতিহাস গবেষক অধ‌্যাপক ড. মাযহারুল ইসলাম তরু জানান, চাঁপাইনবাবগঞ্জ বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী জনপদ। গৌড়ের প্রাচীন রাজধানী হিসেবে এ জেলার যে পরিচিতি, তার বহু নিদর্শন এখনো দাঁড়িয়ে আছে। এর মধ্যে অনেকগুলোই অত্যন্ত জীর্ণ অবস্থায় আছে।

ঐতিহাসিক স্থাপনাগুলো সংস্কার ও রক্ষণাবেক্ষণের ব্যাপারে প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের আঞ্চলিক পরিচালক জানান, জেলার অনেক পুরাকীর্তি বিভিন্ন সময় কমবেশি সংরক্ষণ করা হয়েছে। চলতি বছর সরকারের রাজস্ব আদায় এবং জাদুঘর করার জন্য তোহাখানায় টিকিট চালু করতে যাচ্ছি। আমরা প্রতিটি পুরাকীর্তিই প্রায়োরেটি বেসিসে সংস্কার করি। যখন দেখা যায়, কোনো স্থাপনার খুব খারাপ অবস্থা, তখন দেখে-শুনে ও গবেষণা করে সেগুলোর সংস্কার করি। ওই মনুমেন্টগুলো যেসব উপাদান দিয়ে তৈরি সেগুলো দিয়েই সংস্কার করা হয়। এ ক্ষেত্রে আমরা সরাসরি ইট, সিমেন্ট দিয়ে করতে পারি না। সামনের অর্থবছরে কিছু সীমানা প্রাচীর নির্মাণ ও প্রত্নতাত্ত্বিক খনন করারও পরিকল্পনা রয়েছে।

চাঁপাইনবাবগঞ্জের অন‌্যান‌্য ঐতিহাসিক স্থাপনার মধ্যে রয়েছে- কানসাটের পুরনো জমিদার বাড়ি। বাড়িটি এখন সম্পূর্ণই ধ্বংসপ্রাপ্ত ও পরিত্যক্ত। এছাড়াও রয়েছে দাদনচক মসজিদ, খঞ্জন দিঘি বা রাজাবিবির মসজিদ, ধনিয়াচক মসজিদ, ব্রিটিশ আমলে নির্মিত মাঝপাড়া বালিগ্রাম ৬ গম্বুজ মসজিদ, নবাবি আমলে নির্মিত মহারাজপুর জামে মসজিদ, ঐতিহাসিক নীলকুঠি, ভোলাহাটের চামচিকা মন্দির, গিলাবাড়ি প্রাচীন শিবমন্দির, কাজী সাহেবের মসজিদ, রহনপুরের গম্বুজ ও অতি প্রাচীন ঠাকুরবাড়ি বা মহান্ত বাড়ি প্রভৃতি।


চাঁপাইনবাবগঞ্জ/মিমপা/রফিক

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়