ঢাকা     মঙ্গলবার   ১৬ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৩ ১৪৩১

সেই ‌কি‌শোর মু‌ক্তি‌যোদ্ধার বীর প্রতীক উপা‌ধি

মাইনুদ্দীন রুবেল || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০২:৫৯, ২৬ মার্চ ২০২০   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
সেই ‌কি‌শোর মু‌ক্তি‌যোদ্ধার বীর প্রতীক উপা‌ধি

ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার আখাউড়ার ধরখার গ্রাম। এই গ্রামেরই এক কিশোর মাত্র ১২ বছর বয়সে ছুটে গিয়েছিলেন মুক্তিযুদ্ধে। দেশের স্বাধীনতায় অসামান্য অবদান রাখেন।

সেদিনের সেই কিশোর এখন তিন কন্যা ও দুই পুত্র সন্তানের জনক। সেদিনের সেই বীরত্ব আজো তার জন্য ভীষণ গর্বের। মুক্তিযুদ্ধে অসামান্য ভুমিকার জন্য তিনি পেয়েছিলেন বীর প্রতীক খেতাব।

মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি এ জেলারই কসবা উপজেলার কসবা পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়ের সপ্তম শ্রেণির ছাত্র। ওই বয়সেই তিনি লজিং থেকে পড়াশোনা করতেন। চাচার হাত ধরে তিনি মুক্তিযুদ্ধে ছুটে যান।

খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা বীর প্রতীক আবু সালেক ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বিভিন্ন রনাঙ্গনে সাহসী ভূমিকার জন্য আজো মানুষের কাছে শ্রদ্ধার পাত্র।

মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের স্মৃতিচিহ্ন এখনো বয়ে বেড়াচ্ছেন মুক্তিযোদ্ধা আবু সালেক। তাঁর ডান হাতের ক্ষতস্থান দেখলে এখনো গা শিউরে উঠে। হাতের একটি অংশে মাংস এখনো দেবে আছে। এছাড়াও শরীরের বিভিন্ন স্থানে রয়েছে জখমের চিহ্ন।

আবু সালেক জানান, চাচা হামিদুল হক তাকে যুদ্ধে যেতে উদ্বুদ্ধ করেন। যুদ্ধ করতে হলে প্রশিক্ষণ নিতে হবে। প্রশিক্ষনের জন্য যেতে হবে ভারতে। ভারতে যাওয়ার মতো টাকা ছিলনা তার কাছে। বাবা-মায়ের কাছে বললে বয়সের চিন্তা করে তারা তাকে যুদ্ধে যেতে বারণ করবেন।  যুদ্ধে যাওয়া হবে না। কিন্তু দেশ মাতৃকার টানে তিনি নিজেকে সামলাতে পারছিলেন না। এমনই পরিস্থিতিতে তিনি এক রাতে বাড়ি থেকে আধা মন ধান চুরি করে চাচার সাথে পালিয়ে যান। হেঁটে রওনা হন ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের কংগ্রেস ভবনের উদ্দেশ্যে।  কংগ্রেস ভবনের কাছে গিয়ে একটি প্রশিক্ষণ ক্যাম্পের পাশে ধানগুলো ভাঙ্গান। ৭২ টাকায় চাল বিক্রি করে চাচা-ভাতিজা দুই টাকা দিয়ে কিছু খান।

তিনি বলেন, ‘দেশের টানে যুদ্ধের প্রশিক্ষণ নিতে ত্রিপুরা গেছি কিন্তু বয়স কম হওয়ায় তারা আমাকে প্রথমে প্রশিক্ষণ ক্যাম্পে নিতে চাননি। পরে কান্নাকাটি করে  প্রশিক্ষণ শিবিরে যোগ দেই।  ২০/২৫ দিন প্রশিক্ষণ শেষে গ্রেনেড ও আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে দেশে ফিরে এসে যুদ্ধে যোগ দেই।'

তিনি বলেন, ‘যুদ্ধের সময় বোমার আঘাতে আমার সারা শরীরে ক্ষতের সৃষ্টি হয়। এগুলো আমার গর্ব।'

যুদ্ধ চলাকালে ২২ নভেম্বরের একটি ভয়াবহ স্মৃতির কথা উল্লেখ করে আবু সালেক বলেন, ‘ওই যুদ্ধেই তিনি মারাত্মকভাবে আহত হয়েছিলেন। ওই দিনটি তিনি জীবনে কখনো ভুলবেন না। দিনটি ছিলো কোরবানির ঈদের আগের দিন।'

তিনি বলেন, ‘কসবার চন্ডিদোয়ার আর লতুয়ামোড়া এলাকায় একটি অপারেশনের কথা আমাদের জানানো হয়। সেখানে পাকিস্তানিদের একটি ক্যাম্পে প্রায় দেড়শ সেনা ছিলেন। আমরা  প্রায় আড়াইশ মুক্তিযোদ্ধা ওই ক্যাম্পের কাছাকাছি অবস্থান নেই। কথা ছিল ভোর ৫টা থেকে ৫টা ১০ মিনিটের মধ্যে ওই ক্যাম্পে বোমা ফেলা হবে। কিন্তু সময় মতো বোম্বিং হচ্ছিল না। আমরা চিন্তায় পড়ে যাই। দিনের আলো পরিষ্কার হতে দেখে এক পর্যায়ে আমরা আক্রমণ শুরু করি। “চার্জ” বলে চিৎকার করে আমরা পাক বাহিনীর ক্যাম্পে হানা দেই। ক্যাম্পটি ছিল পাহাড়ের মধ্যে। সম্মুখযুদ্ধে অনেক পাকিস্তানি সেনা নিহত এবং আমাদের কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধাও শহীদ হন। একপর্যায়ে শুরু হয় বোম্বিং। তাতেও আমাদের অনেকেই শহীদ হন। আমিসহ চারজন এক বাংকারে ছিলাম। এর মধ্যে তিনজন মারা গেলেও সৌভাগ্যক্রমে আমি বেঁচে যাই। আহত অবস্থায় আমাকে ভারতের হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়।'

আবু সালেক বলেন, ‘মূলত বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে আধাঘণ্টা সময়ের ব্যবধানের কারণে ভুল বোম্বিং হয়েছিল। আমরা ধরে নিয়েছিলাম, বাংলাদেশ সময় ভোর ৫টা থেকে ৫টা ১০ মিনিটে বোম্বিং হবে। অথচ বোম্বিং হয়েছিল এর আধাঘণ্টা পর, যে কারণে আমাদের লোকজনের শহীদ হওয়ার সংখ্যা বেড়ে গেছে।'

তিনি বলেন, ‘প্রায় চার-পাঁচ মাস ভারতের হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলাম। ১৬ ডিসেম্বর দেশ যেদিন স্বাধীন হয় সেদিন ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী আমাদের নগদ এক হাজার টাকা ও একটি রেডিও দিয়ে আসেন। একই দিন আমরা বঙ্গবন্ধুর মাধ্যমে ৫০০ টাকা পাই। দেশ স্বাধীন হওয়ার খবরে আমরা কী যে আনন্দ পাই, তা ভাষায় প্রকাশ করা যাবেনা। ১৯৭২ সালের ২৮ এপ্রিল আমাকে যশোর সামরিক হাসপাতালে এনে ভর্তি করানো হয়।'

আবু সালেক বলেন, ‘আমার বাবা আবুল হাসেমও মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি শহীদ হন।'

মুক্তিযোদ্ধা আবু সালেক গর্বের সাথে যুদ্ধের আরেকটি স্মৃতি রোমন্থন করে বলেন, ‘একবার কসবার চন্দ্রপুর গ্রামে কোম্পানি কমান্ডার লেঃ আব্দুল আজিজের নেতৃত্বে আমরা ১৪/১৫ জন মুক্তিযোদ্ধা ওৎপেতে থাকি। এই গ্রামে পাক বাহিনীর বড় একটা ক্যাম্প ছিলো। ক্যাম্পে অতর্কিতভাবে হামলা করাই ছিল আমাদের উদ্দেশ্য। কিন্তু তাদের অস্ত্র ভান্ডারের সাথে পেরে ওঠা খুবই দুস্কর। তখন কমান্ডার বলেন, পাক বাহিনীকে ফাঁদে ফেলতে হবে। কমান্ডারের নির্দেশ মতে আমরা রাত ১০টা থেকে রাস্তার পাশে ওৎপেতে থাকি। কখন তারা রাস্তা দিয়ে যাবে, এই ভাবে প্রায় ২ ঘন্টা অবস্থান করার পর রাত ১২ টার দিকে পাক বাহিনীর ১৫/২০ জনের একটা টিম যাওয়ার সময় কমান্ডারের নির্দেশে তাদের উপর ফায়ারিং শুরু করি। প্রায় ২ ঘন্টা চলে ফায়ারিং। পরে দেখি পরিবেশ অনেক শান্ত। আমরা মনে করলাম তারা মারা গেছে বা এলাকা থেকে পালিয়ে গেছে। তখন আমরা পরবর্তী অবস্থা দেখার জন্য সেখানে অবস্থান করি। রাত আড়াইটার দিকে পাকবাহিনী পূর্ণশক্তি নিয়ে আমাদের উপর পুনরায় হামলা করে। সেটা ছিলো ভয়াবহ হামলা। তাদের হামলায় আমরা হতভম্ব হয়ে পড়ি। এই যুদ্ধে আমি সবার ছোট ছিলাম। তখন কমান্ডার বলেন, তাদের সাথে যুদ্ধ করে আমরা পারবো না, মৃত্যু ছাড়া কোন উপায় নেই। পিছনে চলে গেলেও তাদের আক্রমনে আমাদেরকে মৃত্যুবরণ করতে হবে।

কমান্ডার বলেন, পিছনে যেতে হলে আমাদের মধ্য থেকে যে কাউকে কভারিং ফায়ার করতে হবে। তখন আমি বলি কভারিং ফায়ার আমিই করবো, আমি ছোট পাকবাহিনী বুঝবেও না। তখন কমান্ডার আমাকে এক বাংকারের মধ্যে পজিশন দেখিয়ে দিল, তখন আমি তাদের উপর অনবরত ফায়ারিং করতে থাকি। ঘন্টাখানেক ফায়ার করার পর আমাদের মুক্তিযোদ্ধারা পিছনে চলে যায়। সামনে পাকবাহিনীর কেউ আছে কিনা তা দেখার জন্য আমি অপেক্ষা করি। সামনে থেকে যখন আর কোন ফায়ারিং হয় না তখন মনে হলো তারা চলে গেছে, তখন ভোর সাড়ে চারটা হবে। তখন আমি ক্লান্ত হয়ে বাংকারে ঘুমিয়ে পড়ি। ভোর সাড়ে ৬টার দিকে কমান্ডারসহ অন্যরা এসে দেখে বাংকারের মধ্যে অস্ত্র বুকে জড়িয়ে আমি ঘুমিয়ে আছি।'

তিনি আরো বলেন, ‘জাতিরজনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আহবানে ও দেশ মাতৃকার টানে আমরা যুদ্ধে গিয়ে ছিলাম। আমাদের উদ্দেশ্যই ছিলো একটা, দেশকে শত্রুমুক্ত করা, দেশকে স্বাধীন করা। নিজের জশ-খ্যাতির জন্য যুদ্ধ করিনি।'

তিনি বলেন, ‘আমাদের দেশ স্বাধীন হয়েছে, আমাদের স্বপ্নও পূরণ হয়েছে। আলহামদুলিল্লাহ আমরা (মুক্তিযোদ্ধরা) ভালো আছি। সরকার আমাদেরকে যথাযথ মূল্যায়ন করছেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বর্তমান সরকার মুক্তিযোদ্ধাদেরকে সম্মানের ও মর্যাদার আসনে আসীন করেছেন। মুক্তিযোদ্ধা ও তাদের সন্তান-সন্ততিকে বিভিন্নভাবে সাহায্য-সহযোগিতা করছেন। মুক্তিযোদ্ধারা ভাতাসহ বিভিন্ন ধরনের সুযোগ-সুবিধা ভোগ করছেন।'

আবু সালেক বীর প্রতীক বলেন, ‘আশির দশকে তাঁর বাবার নামানুসারে তাদের গ্রামের নামকরণ হয় হাসেমপুর।'

তিনি নিজেকে একজন সুখী মানুষ বলে মনে করেন।

 

ব্রাহ্মণবাড়িয়া/শাহ মতিন টিপু

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়