ঢাকা     শনিবার   ২৭ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৪ ১৪৩১

বগুড়ায় সমস্যার আরেক নাম উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স

এনাম আহমেদ, বগুড়া: || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৯:৩৮, ১৬ অক্টোবর ২০২০  
বগুড়ায় সমস্যার আরেক নাম উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স

নানা সমস্যায় জর্জরিত বগুড়ার বিভিন্ন উপজেলার স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স। হাসপাতালগুলো যেন নিজেই রুগ্ন হয়ে পড়েছে। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের সংকট সব উপজেলাতেই। কোনো কোনো উপজেলায় বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকই নেই। মেডিক‌্যাল অফিসার দিয়েই চলছে স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সগুলো। 

সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, অধিকাংশ স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নেই পর্যাপ্ত যন্ত্রপাতি। অপারেশন থিয়েটারের অভাবে বাড়ির কাছে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স থাকলেও রোগীদের যেতে হয় বগুড়া শহরের শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিক‌্যাল কলেজ হাসপাতাল বা ক্লিনিকগুলোতে। স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে জনবল সংকট, চিকিৎসা সরঞ্জামের অভাব ও অপরিচ্ছন্ন পরিবেশের কারণে দুর্ভোগে আছেন বগুড়ার সব উপজেলার মানুষ।

সিভিল সার্জন কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, বগুড়ায় ১১টি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স আছে। এর মধ্যে শাজাহানপুর, শেরপুর আর নন্দীগ্রাম উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ৩১ শয্যা বিশিষ্ট। বাকি আট উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ৫০ শয্যার। শাজাহানপুর ও নন্দীগ্রাম স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ৫০ শয্যায় উন্নীত করার কাজ চলছে। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের সংকট সবখানেই। উপজেলাগুলোর মধ্যে নন্দীগ্রাম, ধুনট ও সোনাতলায় বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকই নেই। বাকি আট উপজেলার অধিকাংশ স্বাস্থ‌্য কমপ্লেক্সে একজন করে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক আছেন।

স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সগুলো ঘুরে জানা গেছে, সবচেয়ে বেশি অবহেলিত নন্দীগ্রাম স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স। নন্দীগ্রাম সদর থেকে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স প্রায় ৬ কিলোমিটার দূরে ভাটগ্রাম ইউনিয়নের বিজরুল গ্রামে অবস্থিত। এটি স্থাপিত হয়েছিল ১৯৬৪ সালে। হাসপাতালটিকে ৫০ শয্যায় উন্নীত করতে নতুন একটি চারতলা ভবন নির্মাণ করা হচ্ছে। এ হাসপাতালটি উপজেলা সদর থেকে অনেক দূরে হওয়ায় ভাটগ্রাম ও আশপাশের গ্রামের লোকজন ছাড়া সেখানে কেউ যান না। সদর এবং এর আশপাশের এলাকার রোগীরা নন্দীগ্রামের ২০ শয্যা বিশিষ্ট বিশেষায়িত হাসপাতালের আউটডোরে সেবা নিয়ে থাকেন। 

নন্দীগ্রাম উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা তোফাজ্জল হোসেন বলেন, ‘অন্যান্য উপজেলার চেয়ে নন্দীগ্রাম উপজেলার স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সটি বেশি অবহেলিত। নন্দীগ্রাম সদর থেকে প্রায় ৬ কিলোমিটার ভেতরে হওয়ায় এখানে কোনো বিশেষজ্ঞ ডাক্তার পোস্টিং নিতে চান না। কেউ পোস্টিং পেলেও বেশিদিন থাকতে চান না। প্রায় এক বছর হলো এখানে কোনো বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক নেই। আসলে ডিজি অফিস থেকে পোস্টিং হলে আমি তো কাউকে ধরে রাখতে পারব না।’ 

গাবতলী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে গিয়ে দেখা গেছে একই চিত্র। হাসপাতালটি ৫০ শয্যার। রোগীও ভর্তি আছেন ৪৭ জন। কিন্তু রোগীদের জন্য মাত্র একজন বিশেষজ্ঞ ডাক্তার আছেন। পাঁচ মাস আগে এ হাসপাতাল থেকে বদলি হয়ে চলে গেছেন ইএনটি, অর্থোপেডিক ও শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ। অপারেশন থিয়েটার থাকলেও মেশিনপত্র এখনও সব আসেনি। এছাড়া, যেসব মেশিন আছে সবগুলোই নষ্ট। একটি মাত্র এক্সরে মেশিন কয়েকদিন আগে হাসপাতালটি পেয়েছে। মেশিন এবং অপারেশন থিয়েটারের অভাবে অপারেশনের রোগীদের শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিক‌্যাল কলেজ হাসপাতালে রেফার করছে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। হাসপাতালটিতে ১৭ জন মেডিক‌্যাল অফিসার আছেন। নার্স আছেন ২৪ জন। দুটি আয়া পদের বিপরীতে আছেন একজন। ৫ পরিচ্ছন্নতাকর্মীর স্থলে আছেন দুজন। 

উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. শারমীনা পারভীন বলেন, ‘উপজেলায় শুধু একজন গাইনোকলজিস্ট আছেন। আমাদের এখানে পেডিটিশিয়ান, ইএনটি এবং অর্থোপেডিক্স বিশেষজ্ঞ ডাক্তার ছিলেন, তারা সম্প্রতি পদোন্নতি নিয়ে এখান থেকে চলে গেছেন। গাইনির অপারেশনের একজন অ‌্যানেসথেসিওলজিস্ট দরকার, যা আমাদের নেই। এ কারণে এখানে অপারেশন হয় না।’ 

বগুড়া-৭ (শাজাহানপুর-গাবতলী) আসনের সংসদ সদস্য রেজাউল করিম বাবলু বলেন, ‘হাসপাতালের এই অবস্থার বিষয়ে আমাকে জানানো হয়নি। আমাকে চাহিদাপত্র দিলে সেটা নিয়ে আমি মন্ত্রণালয়ে কথা বলতাম। এর আগে অ্যাম্বুলেন্সের প্রয়োজন বলে জানিয়েছিল। আমি সেটার ব্যবস্থা করেছি। আজ বিষয়টি জানলাম। আমি স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের প্রধানের সঙ্গে কথা বলব।’

অপরদিকে, ৫০ শয্যা বিশিষ্ট সারিয়াকান্দি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে এক জুনিয়র কনসালট‌্যান্ট ছাড়া আর কোনো বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক নেই। মেডিক‌্যাল অফিসারদের দিয়েই পরিচালিত হচ্ছে এ হাসপাতালও। অপারেশন থিয়েটার থাকলেও বিশেষজ্ঞ ডাক্তার এবং অ‌্যানেসথেসিওলজিস্টের অভাবে দীর্ঘদিন ব্যবহার না হওয়ায় অধিকাংশ যন্ত্র অকেজো হয়ে পড়ে আছে। হাসপাতালটিতে দুটি ইসিজি মেশিন আছে। এক্সরে মেশিন থাকলেও মেশিন চালানোর লোক নেই। আল্ট্রাসনোগ্রাম মেশিনটিও নষ্ট। হাসপাতালটি বর্তমানে পরিচালিত হচ্ছে ১৯ জন মেডিকেল অফিসার, ১৮ জন নার্স, দুজন ওয়ার্ডবয় এবং দুজন আয়া দিয়ে। হাসপাতালটিতে তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের সংকটের কারণে অধিকাংশ সময়ই পরিবেশ নোংরা থাকে। অপারেশন থিয়েটার বন্ধ থাকায় সেখানে দুটো রুমে ৫ শয্যার করোনা আইসোলেশন ইউনিট করা হয়েছে। সেখানে ৫৪ জন রোগী ভর্তি আছেন। এছাড়া, এই হাসপাতালের সীমানা প্রাচীর নিচু হওয়ায় প্রায়ই রাতে চোরের দল রোগী ও তাদের মালামাল চুরি করে নিয়ে যায়।

বগুড়া-১ (সারিয়াকান্দি-সোনাতলা) আসনের সংসদ সদস্য সাহাদারা মান্নান বলেন, ‘আমি এমপি হিসেবে নির্বাচিত হয়েছি মাত্র দুই মাস হলো। আমি করোনার মধ্যেও দুইবার হাসপাতালে গিয়েছি। কিন্তু ডাক্তাররা তো আমাকে তেমন কিছু বলেননি।’ 

বগুড়ার ডেপুটি সিভিল সার্জন ডা. মোস্তাফিজুর রহমান তুহিন বলেছেন, ‘আসলে বিশেষজ্ঞ ডাক্তার নিয়োগ দেওয়া হয় মন্ত্রণালয় থেকে।’ 

অপারেশন থিয়েটার সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘অপারেশন করতে হলে একজন বিশেষজ্ঞ ডাক্তার এবং একজন অ‌্যানেসথেসিওলজিস্টের প্রয়োজন। লোকবল সংকটের কারণেই অপারেশন থিয়েটারগুলোও পরিচালনা সম্ভব হচ্ছে না। যেসব যন্ত্রপাতি নষ্ট, সে বিষয়ে বার বার চিঠি দেওয়া হয়েছে। আমাদের আশ্বাসও দেওয়া হয়েছে যে, আমরা সেগুলো পাবো। কিন্তু লোকবল সংকটের কারণেও মেশিনগুলো আসছে না। কারণ, মেশিন চালানোর জন্য যদি কোনো লোক না থাকে তাহলে অব্যবহৃত অবস্থায় থাকতে থাকতে মেশিনগুলো একসময় নষ্ট হয়ে যাবে।’ 

এনাম/রফিক

সম্পর্কিত বিষয়:

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়