ঢাকা     শুক্রবার   ২৬ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৩ ১৪৩১

ভাঙনের সঙ্গে যুদ্ধ করে বেঁচে আছেন কয়েক লাখ মানুষ

বাদশাহ সৈকত ও অদিত্য রাসেল || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১২:১৩, ২১ অক্টোবর ২০২১   আপডেট: ১৮:০৩, ২১ অক্টোবর ২০২১
ভাঙনের সঙ্গে যুদ্ধ করে বেঁচে আছেন কয়েক লাখ মানুষ

নদীর ভাঙা-গড়ার সঙ্গে গড়িয়ে চলা জীবনের এক নাম হলো কুড়িগ্রামের ব্রহ্মপুত্র নদের অববাহিকার চরাঞ্চলের বাসিন্দা অহর উদ্দিনের। বয়স ৫৯ বছর। নদী যতই দুঃখ দিক, তার সঙ্গেই যেন জন্মের সম্পর্ক। 

নদীর বুকে জেগে ওঠা চরে শিশুকাল, শৈশব, যৌবন পেরিয়ে এখন পাঁচ সন্তানের জনক অহর উদ্দিন। তার কাছে জীবনের অর্থই হলো নদীর ভাঙা গড়ার খেলায় চরের জমিতে জীবিকা অন্মেষন করতে করতে জীবনকে শেষ পর্যন্ত টেনে নিয়ে যাওয়া।

১৯৭৯ সদর উপজেলার যাত্রাপুর ইউনিয়নের ঝুনকার চরে বাপ-দাদার বাড়ি ছিল অহর উদ্দিনের। চৌচালা টিনের ঘর, গোয়াল ভরা গরু ছিল তাদের। কিন্তু বাধ সাধলো ব্রহ্মপুত্র নদ। ভারতের কালাইবাড়ী সীমান্ত হয়ে বাংলাদেশের নাগেশ্বরী উপজেলার নুনখাওয়া সীমানা দিয়ে এদেশের অভ্যন্তরে প্রবেশ করা ব্রহ্মপুত্র নদ একদিন গড়িয়ে গড়িয়ে তাদের বসত ভিটার কাছে এলো।  

প্রতি বছর বর্ষা আসলেই ব্রহ্মপুত্র রুদ্রমুর্তী ধারণ করে। নদের প্রখর স্রোত আর তীব্র ভাঙ্গনে একদিন নিশ্চিহ্ন হয়ে গেল আহর উদ্দিনের বাপ-দাদর বসতভিটা। বাড়ির সামান্য কিছু মালামাল সরাতে পারলেও বাকি সব গ্রাস করে নিয়েছিল ব্রহ্মপুত্র।  এরপর ঠিকানা হয় ব্রহ্মপুত্র নদের বুকে জেগে উঠা একই চরের অন্য প্রান্তে। সেখানে ৪ থেকে ৫ বছর বাপ-দাদার জেগে ওঠা জমিতে ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা। তারপর আবারো বসত-ভিটাসহ ঘর-বাড়ি ভেঙ্গে নেয় ব্রহ্মপুত্র। আবারো ঠিকানা হয় নদের বুকে জেগে ওঠা আরেক চরে। এভাবেই সাতবার বাড়ি ভাঙ্গার পাশাপাশি আবাদি জমিও নদীর কবলে চলে যায় অহর উদ্দিনের।  বর্তমানে তিনি তার পরিবার নিয়ে বসবাস করছেন সদরের যাত্রাপুর ইউনিয়নের ব্রহ্মপুত্র নদের পাড়ে বড়ুয়ার চরে অন্যের জমিতে। 

কৃষি নির্ভর এই পরিবারটি বার বার নদী ভাঙনের শিকার হয়ে ভূমিহীন হয়ে পড়েছে। বারবার নদী ভাঙনের কারণে এখন নিজের আপন ভাইরাও একেকজন একেক চরে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছেন। পেশাও পরিবর্তন করেছেন অনেকে। কিন্তু অহর উদ্দিন কৃষি কাজ করেই কোন রকমে জীবিকা নির্বাহ করছেন।
অহর উদ্দিন বলেন, ‘আমার বসতভিটা অনেকবার নদী গর্ভে চলে গেছে। আবাদি জমি মাঝে মধ্যে জেগে উঠলেও তাতে তেমন কোন আবাদ হয় না।  কোন রকমে চলছে জীবন। ’

একই অবস্থা উলিপুর উপজেলার সাহেবের আলগা ইউনিয়নের ব্রহ্মপুত্র অববাহিকার দই খাওয়ার চরের কালু মিয়ার (৫০), জাহাজের আলগা চরের হানিফ মিয়ার (৫৪)। 

ব্রহ্মপুত্রের ভাঙ্গনে প্রতিনিয়ত বাড়ি-ঘর সরাতে সরাতে নদীর অববাহিকায় আইড়মারীর চরে আশ্রয় নিয়েছেন কালু মিয়া। তিনি বলেন, ‘দুই বছর আগে সামান্য কিছু জমি জেগে ওঠায় সেখানে ধান আবাদ করছি। তবে জমিতে বেশি ফলন হয়নি।  যা ফলন হয়েছে তা দিয়েই আমাদের এক থেকে দু’মাসের খাবার চলে।  আর বাকি সময় দিনমজুরের কাজ করেই চলতে হয় আমাকে।’

কুড়িগ্রাম সদর উপজেলার যাত্রাপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মো. আইয়ুব আলী সরকার জানান, ‘বর্ষা মৌসুম এলেই বন্যা এবং নদী ভাঙনে আমার ইউনিয়নেই ৬ থেকে ৭’ শ পরিবার ভূমিহীন হয়ে পড়ে। এ অবস্থা যুগের পর যুগ অব্যাহত রয়েছে। যাত্রাপুর ইউনিয়নে ৯টি ওয়ার্ডের মধ্যে ৮টি ওয়ার্ডের মানুষই প্রতি বছর বন্যা ও নদী ভাঙনের শিকার হয়।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ব্রহ্মপুত্রের মত একই অবস্থা কুড়িগ্রামের উপর দিয়ে প্রবাহিত ধরলা, তিস্তা, দুধকুমর, ফুলকুমর, গঙ্গাধরসহ ১৬টি নদ-নদীর অববাহিকার প্রায় সাড়ে ৪ শতাধিক চরাঞ্চলের প্রায় লক্ষাধিক পরিবারের।  প্রতি বছর এসব নদ-নদীর অববাহিকার অন্তত ৪ থেকে ৫ হাজার পরিবার ভাঙনের কবলে ঘর-বাড়ি, ফসলী জমি হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে পড়েন।  এছাড়া প্রতি বছর নদী ভাঙনে এসব চর অঞ্চলে গড়ে ওঠা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, মসজিদসহ সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন স্থাপনা নদী গর্ভে বিলীন হয়ে যাচ্ছে।  চরাঞ্চলে বসবাসরত এমন কোনো পরিবার পাওয়া যাবে না যাদের ঘর-বাড়ি নদ-নদী গ্রাস করেনি। 

কুড়িগ্রাম জেলার উপর দিয়ে প্রবাহিত অন্য নদ-নদীর তুলনায় ব্রহ্মপুত্রের ব্যপ্তি অনেক বেশি হওয়ায় এই নদের অববাহিকায় ক্ষতিগ্রস্থ মানুষের সংখ্যাও অনেক বেশি। যখন একটি চর ভাঙনের কবলে পড়ে তখন সেই চরে বসবাসরত শতাধিক পরিবার পার্শ্ববর্তী কোনো নতুন চরে বসত গড়ে তোলে জীবনের তাগিদে। 

নতুন চরের বালু জমিতে কাঁশবন সরিয়ে শুরু হয় তাদের হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রম। বালু জমিতে দিনরাত পরিশ্রম করে চিনা বাদাম, কাউন, ধান, ডাল, ভুট্রা, গম, চিনা, সুজি, টিসি, গুজি তিল, কালিজিরা, ধনিয়া, শলুক, মিষ্টি আলুসহ নানা ধরনের সবজি উৎপাদন করেন তারা। অনেকেই নদীতে মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করতে থাকেন। 

চরাঞ্চলের মানুষদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তারা সরকারি বা বেসরকারি কোনো সাহায্য চান না।  তারা শুধু নদ-নদীর ভাঙনটাই বন্ধ করতে চান। তাহলেই তারা চরের বাসিন্দা হয়েও সুখে শান্তিতে বাঁচার স্বপ্ন দেখতে পারবেন।

সিরাজগঞ্জ:
অন্যদিকে চলতি বছরের বন্যায় অব্যাহত ভাঙনে দিশেহারা হয়ে পড়েন সিরাজগঞ্জের যমুনা পাড়ের মানুষ। জেলার শাহজাদপুর, চৌহালী ও কাজিপুর উপজেলায় অব্যাহত নদী ভাঙন তীব্র হয়ে উঠে। 

গত দেড় মাসে এসব উপজেলায় তিন শতাধিক বসতভিটা, একাধিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসহ দেড় হাজার একর বিস্তীর্ণ ফসলি জমি নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। ভাঙ্গনে বাড়ি-ঘর অন্যত্র সরিয়ে নিয়ে মানবেতর জীবন যাপন করছেন ওইসব এলাকার মানুষ।  
শনিবার (১৬ অক্টোবর) জেলার কাজিপুর উপজেলার মাইজবাড়ী ইউনিয়নের ঢেকুরিয়া-বিলচতলের দুই স্থানের প্রায় ৮০ মিটার ধসে গেছে। ওই দিন রাতেই নদী তীর ঘেঁষে বসবাসরত প্রায় দশটি বাড়ি এবং তিনটি দোকান সরিয়ে নেওয়া হয়।

সিরাজগঞ্জ পাউবো’র উপ-সহকারী জাকির হোসেন জানান, কাজিপুরের ভাঙ্গনের খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে গিয়ে প্রায় এক হাজার জিওব্যাগ ফেলে ভাঙ্গন ঠেকানো হয়েছে।  নদীর বুকে চর জেগে ওঠায় ভাঙন দেখা দিয়েছে। 

জেলার শাহজাদপুর উপজেলার এনায়েতপুর থানাধীন খুকনী, জালালপুর ও কৈজুরী ইউনিয়নের অন্তত পাঁচ কিলোমিটার এলাকা জুড়ে যমুনার তীব্র ভাঙ্গন দেখা দিয়েছে। প্রতিদিনই নদীগর্ভে বিলীন হচ্ছে ঘর-বাড়ি ও ফসলি জমি। 

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, চৌহালী উপজেলার জালালপুর ও কৈজুরী ইউনিয়নের যমুনা নদী তীরবর্তী পাঁচ কিলোমিটার এলাকা গত কয়েক বছর ধরেই ভাঙনের কবলে পড়েছে। বাড়ি-ঘর ও ফসলি জমি হারিয়েছে এসব ইউনিয়নের ব্রাহ্মণগ্রাম, পাকুরতলা, আরকান্দি, বাঐখোলা, ঘাটাবাড়িম ভেকা, পুটিপাড়া, জালালপুর, ভেকা হাট পাচিল ও চিলপাড়াসহ ১০ গ্রামের মানুষ। অব্যাহত ভাঙ্গনে মানচিত্র থেকে হারিয়ে যেতে বসেছে গ্রামগুলো। চলতি বছরের বন্যায় ভাঙ্গনের তীব্রতা আরো বেড়ে গেছে। এতে চরম আতঙ্কের মধ্যে রয়েছে এ অঞ্চলের মানুষরা।

ভাঙ্গনের ঝুঁকিতে রয়েছে, মধ্য শিমুলিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, হিজুলিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, পশ্চিম সম্ভুদিয়া প্রাথমিক বিদ্যালয়, খাস মধ্য শিশুলিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, মিশ্রিগাতি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, বারবয়রা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, ইউসুফ শাহি সলঙ্গী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, বিলজলহর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, বাউশা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, শৈলজানা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও হাটাইল নিম্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয়।

নদী ভাঙ্গনে ক্ষতিগ্রস্ত হোসেন আলী, মোমেনা খাতুন, আকবর আলী, আমিরুল ইসলাম, হামিদ আলী ও জসিম উদ্দিনসহ অনেকেই জানান, বন্যার পানি কমে যাওয়ায় যেভাবে নদী ভাঙন শুরু হয়েছে তাতে এখানে বসবাসকারী সবাই আতঙ্কে আছি।  এভাবে চলতে থাকলে বিলীন হয়ে যাবে গ্রামগুলো।  

তারা জানান, নদীভাঙ্গনে যদি বাড়ি-ঘর বিলীন হয়ে যায় সেটা আর ফিরে আসবে না।  যমুনাই চরবাসীর বড় আতঙ্ক।  

চৌহালী উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা জাহাঙ্গীর ফিরোজ জানান, যমুনার ভাঙ্গনে হুমকির মুখে পড়া শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের তালিকা করে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপকে জানানো হয়েছে। 

খুকনী ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান মুল্লুক চাঁন জানান, এনায়েতপুরের আরকান্দি ব্রাহ্মণগ্রাম থেকে শুরু করে যমুনার পশ্চিম তীরের প্রায় পাঁচ কিলোমিটার এলাকা জুড়ে ভাঙন শুরু হয়েছে কয়েক বছর আগেই। এবার তীব্রতা আরো বেড়ে গেছে।  এই এলাকার মানুষগুলো অসহায় অবস্থায় রয়েছে। 

শাহজাদপুর উপজেলা নির্বাহী অফিসার শাহ মো. শামসুজ্জোহা বলেন, যমুনায় বিলীন হয়ে যাওয়া পাকুরতলা গুচ্ছগ্রামের ১৩০টি অসহায় পরিবারের তালিকা করে নতুন আবাসন নির্মাণের জন্য বরাদ্দ চেয়ে কর্তৃপরে কাছে আবেদন করা হয়েছে। বরাদ্দ পেলে এদের জন্য স্থায়ী আবাসনের ব্যবস্থা করে দেওয়া হবে।

সিরাজগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী শফিকুল ইসলাম বলেন, প্রধানমন্ত্রী নদী ভাঙন রোধে একনেক সভায় সাড়ে ৬০০ কোটি টাকার প্রকল্প অনুমোদন দিয়েছেন। আশা করছি নভেম্বর-ডিসেম্বরের মধ্যে কাজ শুরু হবে। প্রকল্পের কাজ শুরু হলে ভাঙ্গন মুক্ত হবে চৌহালী উপজেলাধীন এনায়েতপুর ও বেতিল স্পারবাঁধ ও শাহজাদপুরের খুকনী-জালালপুর ইউপির পূর্বাঞ্চল।

মাসুদ

সম্পর্কিত বিষয়:

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়