ঢাকা     শনিবার   ০৮ নভেম্বর ২০২৫ ||  কার্তিক ২৪ ১৪৩২

Risingbd Online Bangla News Portal

ঐতিহ্য হারাচ্ছে গারোপাহাড়ের ক্ষুদ্র নৃ গোষ্ঠী

শেরপুর সংবাদদাতা || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৪:১৪, ১৯ নভেম্বর ২০২১   আপডেট: ১৪:২৯, ১৯ নভেম্বর ২০২১
ঐতিহ্য হারাচ্ছে গারোপাহাড়ের ক্ষুদ্র নৃ গোষ্ঠী

গারোপাহাড় খ্যাত শেরপুর জেলার শ্রীবরদী, নালিতাবাড়ী ও ঝিনাইগাতী উপজেলার বিস্তীর্ণ পাহাড়ি এলাকা জুড়ে সুদীর্ঘকাল ধরে বসবাস করছে কোচ, বানাই, ডালু, হাদি, গারো ও হাজং ক্ষুদ্র নৃ গোষ্ঠি। একসময় বছর জুড়ে তারা নানা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করতো। সময়ের আবর্তে শেরপুরের এসব ক্ষুদ্র নৃ গোষ্ঠির সংস্কৃতি, ভাষা-ঐতিহ্য এখন বিলুপ্তির পথে।

গারোদের সর্ববৃহৎ ধর্মীয় উৎসব হলো বড়দিন। এছাড়াও প্রতিবছর ইস্টার সানডে, তীর্থ উৎসব, ইংরেজি নববর্ষ পালন ও নতুন ফসল গোলায় তোলার আগে ওয়ানগালা উৎসব পালন করে থাকে। কিন্তু নিজস্ব সংস্কৃতির সুষ্ঠু চর্চা ও গারোদের অন্য জেলায় পাড়ি জামানোর কারণে গারো আদিবাসীদের হাজার বছরের ঐতিহ্য-সংস্কৃতি এখন বিলুপ্ত প্রায়। 

আদিবাসী সংগঠন ট্রাইভাল ওয়েল ফেয়ার এসোসিয়েশনের (টিডাব্লিউএ) সূত্রে জানা গেছে, নালিতাবাড়ী উপজেলায় ১১টি ইউনিয়নে ৭ টি গ্রামে সহস্রাধিক পরিবারে প্রায় ৫০ হাজার সদস্য নানা প্রতিকূল পরিবেশ মোকাবেলা করে বাপ-দাদার বসত ভিটায় বসবাস করে আসছেন। এরা পাহাড়ে শাল ও গজারির বনে ছোট ছোট ঝুপড়িতে ক্ষুধা আর দারিদ্রের সঙ্গে লড়াই করে আজও টিকে আছে নানা কষ্টে। 

এদের অধিকাংশ পরিবারই পাহাড়ি বন থেকে জ্বালানি কাঠ সংগ্রহ আর অন্যের বাড়িতে দিন মজুরি করে জীবিকা নির্বাহ করে। এসব সম্প্রদায়ের রয়েছে আলাদা আলাদা কৃষ্টি সংস্কৃতি এবং নিজস্ব সমাজ ব্যবস্থা। গারোরা খ্রীষ্টান ধর্মাবলম্বী আর কোচ ও হাজং সম্প্রদায়ের লোকজন সনাতন হিন্দু ধর্মাবলম্বী।

রাংটিয়া গ্রামের গারো বাপ্পি ম্রং জানান, গারোদের স্থানীয় বা আঞ্চলিক ভাষার নাম ‘আচিক কাথ্যা’। ‘আচ্ছিক বলতে বোঝায় গারো যারা পাহাড়ে বাস করে, আর কাথ্যা শব্দের অর্থ ভাষা। গারোরা প্রধানত ও মূলত পাহাড়ে বসবাস করে এবং তাই আচিক কাথ্যার মানে গারোদের ভাষা। এটা গারোদের মৌখিক ভাষা এবং তারা এখনো লিখিত ভাষার উদ্ভব ঘটাতে পারেনি। 

সীমান্তঘেঁষা খলচান্দা গ্রামের কোচ সম্প্রদায়ের মিঠুন কোচ (৩৬) বলেন, আমরা বন-পাহাড়ে যুদ্ধ করে অসহায় জীবন যাপন করে আসছি। তাই পেটের তাগিদে অভাবের তাড়নায় ইতিহাস-ঐতিহ্য কি বুঝিনা। শুধু এটাই বুঝি বেঁচে থাকতে হবে। নিজস্ব ভাষায় কথা বলার জন্য কোচদের আছে কোচ ভাষা আর গারোদের আছে আচিক ভাষা। বর্তমানে এই দুই ভাষাতেও বাংলা ভাষার সংমিশ্রন হয়ে গেছে। 

নিজস্ব ভাষা সংরক্ষণের তথা মায়ের ভাষায় কথা বলার জন্য কোচ আদিবাসীদের নিজস্ব ভাষায় স্কুল প্রতিষ্ঠার দাবি জানান খলচান্দা গ্রামের শ্রী অনিল কোচ (৩৪)। তিনি বলেন নতুন প্রজন্মের অনেকেই তাদের নিজস্ব ভাষার ফাঁকে ফাঁকে বাংলা জুড়ে দিয়ে কথা বলেন। তাই আধুনিকতার ছোঁয়ায় কোচদের ভাষাও আজ বিলুপ্ততির পথে।

বর্ণমালা তথা লেখ্যরূপের অভাবে গারো সম্প্রদায়ের শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতি, ইতিহাস ও ঐতিহ্য বিলুপ্তির পথে। মান্দী (গারো) সমাজের বদ্ধমূল ধারণা ও বিশ্বাস, অতীতে আচিক ভাষার বর্ণমালা তথা লেখ্যরূপ ছিল। কিন্তু বর্তমানে আধুনিক জীবন-যাপন ও সুষ্ঠ চর্চা না থাকায় গারোদের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি বিলীন হয়ে যাচ্ছে।

আধুনিক যুগের তাল মেলাতে গিয়ে এসব হাজং ও কোচ আদিবাসীদের শত বছরের ইতিহাস ঐতিহ্য-সংস্কৃতি এখন হারিয়ে যেতে বসেছে। 

আদিবাসীদের বিভিন্ন সাংস্কৃতিক উৎসবে তাদের নিজ হাতে বানানো হারিয়ে যাওয়া বাদ্যযন্ত্রের মধ্যে আছে মান্দিদামা, ক্রাম, খোল, নাগ্রা, জিপসি, খক, তবলা, ঢোল, মিল্লাম, স্ফি, রাং, বাঁশের বাশি, আদুরী নামের বাদ্যযন্ত্র ও পোশাক দকবান্দা, দকশাড়ী, খকাশিল, দমী, রিক মাচুল আর কোচ আদিবাসীদের রাংঙ্গা লেফেন ও আছাম।

আর খাদ্যের তালিকায় রয়েছে বাঁশের কুড়ল আর চালের গুড়া দিয়ে তৈরি খাবার উপকরন ‘মিয়া’, কলাপাতায় করে ছোট মাছ আগুনে পুড়া দিয়ে খাওয়া যার নাম ‘ইথিবা’, মুরগির বাচ্চা পুড়া দিয়ে বাঁশের চোঙ্গায় ভরে পেয়াজ ও কাচা মরিচ দিয়ে ভর্তা করে খাওয়া যার নাম ব্রেংআ, মিমিল, কাকড়া, শামুক ও চাল দিয়ে তৈরি মদ যার নাম 'চু' আর কোচ আদিবাসীদের কাঠমুড়ি ইত্যাদি খাবার উপকরণ প্রায় বিলুপ্তির পথে।

ট্রাইভাল ওয়েল ফেয়ার এসোসিয়েশনের (টিডাব্লিউএ) নেতা প্রাঞ্জল এম সাংমা বলেন, আধুনিক যুগের সাথে তাল মেলাতে গিয়ে আমাদের ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি অনেকটাই বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। আদিবাসীদের কৃষ্টি-সংস্কৃতি সংরক্ষণে শেরপুরের বিভিন্ন উপজেলায় আদিবাসী বসবাসকারী এলাকায় কালচারাল একাডেমি স্থাপনের জন্য সরকারের কাছে জোর দাবি জানাচ্ছি। 

তারিকুল ইসলাম/টিপু

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়