পাকসেনাদের অস্ত্র চুরি করে যুদ্ধে গিয়েছিলেন তছলিম
ফারুক আলম || রাইজিংবিডি.কম
লালমনিরহাটের দিনমজুর তছলিম মিয়া। বিয়ের ১১ মাস পর মুক্তি যুদ্ধ শুরু হয়। প্রায় নতুন বউকে রেখে ফুপা শ্বশুর মজিদের পরামর্শে অপর ২৫ জনের সঙ্গে পাকসেনাদের ক্যাম্প পাহারায় নিয়োজিত হন। তাদের লক্ষ্য ছিল পাকিস্থানি সেনাদের অস্ত্র দখল। একদিন সুযোগ আসে। পাঁচটি রাইফেল নিয়ে পালিয়ে আসেন তসলিমসহ চার যুবক।
বউয়ের বড় ভাই নূর ইসলামের পরামর্শে সেই অস্ত্র নিয়ে যোগ দেন মুক্তিযুদ্ধে। বর্ডার পার হয়ে দেখা হয় দিনহাটা থেকে আসা তাজ উদ্দিনের সঙ্গে। তাজ উদ্দিন তাদের রাইফেল নিয়ে আসার কথা শুনে খুবই খুশি হন। খুশি হয়ে তছলিমকে ২৫০ টাকা উপহার দেন। বাকিরা পান ২০০ টাকা করে। এরপর সই-স্বক্ষর নিয়ে তাদের সবাইকে যুদ্ধে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। কমান্ডার সুবেদ আলী সুবেদারের নেতৃত্বে যুদ্ধ করেন ৯ মাস। সঙ্গে ছিলো বাকি তিন বন্ধু।
স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে আপ্লুত হন তছলিম। ফিরে যান একাত্তরে। তিনি বলেন, ‘‘খান সেনাদের ক্যাম্পে আমরা ১৯ দিন ট্রেনিং পেয়েছিলাম। তিস্তা ব্রিজের নিচেই ছিল তাদের ক্যাম্প। সেখানেই কয়েকদিন ডিউটি করেছি। পরে অস্ত্র নিয়ে পালিয়ে আসার পর ধরলার কলা খাওয়া ঘাট দিয়ে সোজা পূর্ব দিকে দিয়ে ভারতে গেছি।
ইতোমধ্যে রাইফেল হারানোর কথা চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে। আনোয়ার, মকবুল, আলফাজ ও আমি সিদ্ধান্ত নিলাম- যদি খান সেনাদের সামনে পড়ি, তাহলে জীবন চলে গেলেও ধরা দেবো না। পরে বর্ডার পার হয়ে গেলাম। সেখানে তাজউদ্দিন সাহেব দিনহাটা থেকে এলেন। তিনি বললেন, ‘ছেলেগুলোর সাহস আছে। যাও যুদ্ধে, আজ থেকে তোমরা মুক্তিযোদ্ধা।”
‘‘তিনদিন তিনরাত অনাহারে থাকতে হয়েছে। তারপর এ যুদ্ধে ভুরুঙ্গামারি দখলে আনতে সক্ষম হই। ফেরার সময় গ্রামের একটি ছোট ছেলে বললো, এখনো খান সেনা আছে। তখন আবার ফেরত যাই। একদিন অপেক্ষা করার পর দেখি, সেখানে একজন নাপিত ছিলো। সেই নাপিত নিজের জীবন বাঁচানোর জন্য একেক বাঙ্কার থেকে একেক সময় গুলি ছুড়ছিলো। তাকে আটক করা হলো। জেরা করার পর আমার কমান্ডার সুবেদ আলী সুবেদার তাকে ছেড়ে দেওয়ার নির্দেশ দেন।
‘রংপুরের মাহিগঞ্জে একদিন খুব গোলাগুলি হয়। সেখানে আমাদের লেফটেন্যান্ট মারা যান। তাকে ঠিকমতো দাফন করতে পারিনি। একদিন বাড়ি ফিরলাম। ফিরে এসে দেখি খানেরা আমার বাড়িঘর পুড়িয়ে দিয়েছে। আমার বউও বাড়িতে নাই। খোঁজ নিয়ে জানতে পারি সে তার বাবার বাড়িতে আছে।”
তছলিমের স্ত্রী বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধ থেকে ফিরতে পারব কি না সেই অনিশ্চয়তায় পড়ে বাড়ির লোকজন তাকে অন্য জায়গায় বিয়ে দিতে চেয়েছিল। খাওয়ানোর কেউ ছিলো না, দেখার কেউ ছিলো না। সবাই বলতো, এ মুক্তিযোদ্ধার বউ। তখন মুক্তিযোদ্ধার বউ শব্দটা শুনলে ভয় লাগতো।’
বর্তমানে তছলিম মিয়া পঙ্গু হয়ে গেছেন। তিনি দুঃখ করে বলেন, ‘শেখ হাসিনার আমলে ৩০০ টাকা ভাতা পাওয়া শুরু করি। ২০১০ সালের পরে একবার ভাতা বন্ধ করে দেয় স্থানীয় চক্রান্তকারীরা। তবে পুনরায় আমার ভাতা চালু হয়েছে। কয়েকবার মুক্তি যোদ্ধাদের জন্য বরাদ্দকৃত ঘর চেয়েছি, তবে পাইনি। এটাই আক্ষেপ।’
লালমনিরহাট/সনি
আরো পড়ুন