ঢাকা     শনিবার   ০৪ মে ২০২৪ ||  বৈশাখ ২১ ১৪৩১

‘মস্ত মানুষ’ ঠিকাদার ছেলের ফ্ল্যাটে স্থান হয়নি মায়ের

মির্জা শহিদুল, চৌহালী, সিরাজগঞ্জ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৯:৩৯, ১৭ জানুয়ারি ২০২২   আপডেট: ১১:০৮, ১৮ জানুয়ারি ২০২২
‘মস্ত মানুষ’ ঠিকাদার ছেলের ফ্ল্যাটে স্থান হয়নি মায়ের

‘ছেলে আমার মস্ত মানুষ, মস্ত অফিসার/ মস্ত ফ্ল্যাটে যায় না দেখা এপার-ওপার/ নানান রকম জিনিস আর আসবাব দামি দামি/ সবচে' কমদামি ছিলাম একমাত্র আমি…’

মোরশেদা খানম হৃদয়ের হাহাকার কণ্ঠে তুলে এই গানটি গাইতে পারেন। তাতে ‘মস্ত মানুষ’ ছেলে অনুতাপে কতটা দগ্ধ হবে বলা না-গেলেও সমাজ অন্তত অপেক্ষায় থাকবে সেই দিনের, যেদিন ছোট্ট ঘরে মায়ের মুখোমুখি হবে ছেলে। মা বাষ্পরুদ্ধ কণ্ঠে ছেলেকে বুকে জড়িয়ে প্রার্থনা সঙ্গীতের মতো গাইবেন- ‘আশ্রমের এই ঘরটা ছোট, জায়গা অনেক বেশি, খোকা আমি দু'জনেতে থাকবো পাশাপাশি।’

মোরশেদা খানমের বয়স এখন ষাট। একশ বছর বাঁচার সাধ তার ইতোমধ্যেই ফুরিয়েছে। অথচ একসময় তিনি নিজেই শত-সহস্র মানুষের জীবনের ‘বালাই ষাট’ দূর করতে সচেষ্ট হয়েছেন। স্থানীয় রাজনীতিতে ছিলেন চেনা মুখ। আজ তারাও ভুলতে বসেছে মোরশেদা খানমকে। তিনি আজ সবখানেই উপেক্ষিত। না, এজন্য এই নারীর কোনো আক্ষেপ নেই। আক্ষেপ থাকবেই বা কেন? নিজের পেটের একমাত্র সন্তান যখন সম্পর্ক অস্বীকার করে তখন আর কোনো দুঃখই স্পর্শ করে না ভাগ্যবিড়ম্বিত এই মাকে।  

মোরশেদা খানম এখন অন্ধপ্রায়। হয়তো সন্তানের ফিরে আসার প্রতীক্ষায় কাঁদতে কাঁদতে তিনি হারিয়েছেন চোখের আলো। অন্যের সাহায্য ছাড়া চলাফেরা করতে পারেন না। এরও অনেক আগে রাক্ষসী যমুনা অতলে টেনে নিয়েছে ভিটেবাড়ি। রেখে গেছে শুধু স্মৃতি। এরপর থেকে চৌহালী উপজেলার চর জাজুরিয়ায় মুনা খানের পতিত জমিতে আশ্রিতা হিসেবে তিনি বাস করছেন। 

মোরশেদা খানমের জীবনে এখন আর কোনো আয়োজন নেই। কেউ খেতে দিলে একবেলা জোটে আহার। না-দিলে রাতভর উপোস। বর্ষা, শীত তার জন্য অভিশাপ। কিন্তু এখনও মানুষ আছে, তারা জানে প্রাণের মূল্য। তেমনই কিছু মানুষ দাঁড়িয়েছেন মোরশেদা খানমের পাশে। তুলে দিয়েছেন ছয় টিনের এক ছাপড়া-ঘর। ছাপড়ার তিনদিকে বেড়া থাকলেও সামনের অংশে দরজা বা জানালা দেওয়ার সামর্থ্য হয়নি। গ্রামের মানুষ, সাধ থাকলেও সাধ্য সবার থাকে না। ফলে সামনের অংশে টানিয়ে দেয়া হয়েছে পলিথিন। তাতে আসমানীর ভেন্না পাতার ছাউনির দুরবস্থা থেকে কিছুটা মুক্তি মিলেছে মোরশেদা খানমের। কিন্তু এই অবস্থায় কীভাবে পতিত হলেন তিনি?

মুনা খানের স্ত্রী লাইলী খানমের কাছ থেকে জানা গেল সে কথা। মানুষ হয়ে মানবিক দায় এড়িয়ে যেতে পারেননি ষাটোর্ধ্ব এই নারী। কে জানে হয়তো দারিদ্র্যই তাকে করেছে মহান! নইলে তিনি নিজেই যেখানে দু‘বেলা পেটপুড়ে খেতে পান না, থাকেন দিনমজুর ছেলের সংসারে, সেই তিনিই কিনা অসহায় অন্ধ ও পঙ্গু বৃদ্ধা মোরশেদা খানমের আজ প্রধান ভরসা। 

লাইলী খানম কথাপ্রসঙ্গে জানালেন, টাঙ্গাইল জেলার নাগরপুর উপজেলার বলরামপুরের আওলাদ হোসেনের সঙ্গে চৌহালীর খান পরিবারের মেয়ে মোরশেদা খানমের বিয়ে হয়। বিয়ের পর জীবননৌকা তরতর করে চলছিল। কিন্তু বিধিবাম! যমুনার কড়ালগ্রাসে বাড়িঘর, জমি বিলীন হয়ে গেলে এই দম্পতি চৌহালীর চর জাজুরিয়ায় এক আত্মীয়ের বাড়িতে আশ্রয় নেন। এখান থেকে তারা যখন ঘুরে দাঁড়ানোর স্বপ্ন দেখছিলেন তখনই এলো সবচেয়ে বড় আঘাত। স্বামী ও বড় ছেলে মারা গেলেন। মোরশেদা খানম এবার অকূল পাথারে পড়লেন। তবে হাল ছাড়লেন না। ছোট ছেলে সুহাদকে নিয়ে নতুন করে বাঁচার স্বপ্ন দেখলেন তিনি। সেই স্বপ্নপূরণে আনসার ভিডিপির চাকরি নিলেন। ছেলেকে কিছুটা পড়াশোনা শিখিয়ে বড় করলেন। ছেলে এরপর কাজের সন্ধানে পাড়ি জমাল রাজধানীতে। হাউজিং কোম্পানিতে জুটে গেল ইলেক্ট্রিকের কাজ। খুব দ্রুত হলো তার ভাগ্যের পরিবর্তন। নিজেই ঠিকাদারী শুরু করলেন। রাজধানীর ফার্মগেটের ফ্ল্যাট বাসায় স্ত্রী, ছেলে-মেয়ে নিয়ে তার এখন সুখের সংসার! 

সুহাদ জীবন সাজিয়ে নিয়েছে তার মতো। কিন্তু ভুলে গেছে মায়ের কথা। দীর্ঘ ৮ বছর সে মোরশেদা খানমের কোনো খোঁজ নেয়নি। বলতে বলতে আঁচলে চোখ মোছেন লাইলী খানম। 

সুহাদের সঙ্গে আপনারা যোগাযোগের চেষ্টা করেননি? এবার দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে হতদরিদ্র এই বৃদ্ধার কণ্ঠ থেকে। ‘সে তো কোনো পরিচয় ও বাসার ঠিকানা দেয় না’, ঝরে পড়ে অসহায়ত্ব।  

অযত্ন, অবহেলা আর বিনা চিকিৎসায় মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাচ্ছেন মোরশেদা খানম। অথচ তার সমাজসেবার কথা এখনও অনেকের স্মৃতিতে সমুজ্জ্বল। তেমনই একজন চৌহালী উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি হযরত আলী মাস্টার। তিনি বলেন, আমি ৩০ বছর চৌহালী আওয়ামী লীগের সভাপতি ছিলাম। সে সময় উপজেলার ৩ নম্বর ওয়ার্ডের মহিলা আওয়ামী লীগের সভানেত্রী ছিলেন মোরশেদা খানম। ১৯৯২ সাল থেকে টানা ১০ বছর এ পদে তিনি দায়িত্ব পালন করেছেন।  

মোরশেদা খানমকে ‘আওয়ামী লীগের দুর্দিনের কাণ্ডারী’ উল্লেখ করে হযরত আলী বলেন, ‘আওয়ামী লীগের সকল আন্দোলন সংগ্রামের সম্মুখ সারির সহযোদ্ধা ছিলেন মোরশেদা খানম। তিনি দীর্ঘদিন চৌহালী উপজেলা আনসার ও ভিডিপির দলপতি ছিলেন। শত শত অসহায় অনাহারী নারীকে সাহায্য করেছেন। তাদের মুখে আহার তুলে দিতে তিনি অফিসে অফিসে ঘুরে বিধবা ভাতা, বয়স্ক ভাতা, স্বামী পরিত্যাক্তা নারীর ভাতা কার্ড করে দিয়েছেন। সরকারি-বেসরকারি ত্রাণ পাইয়ে দিয়েছেন বহু অসহায় মানুষকে। গর্ভবতী মা ও দুস্থ রোগীদের হাসপাতালে নিয়ে চিকিৎসা করিয়েছেন। অথচ আজ তার জীবন চলে অন্যের দয়ায়। এটা খুবই কষ্টদায়ক, বেদনাবিধুর।’ 

হযরত আলী এই অসহায় নারীর পাশে দাঁড়াতে দেশের বিত্তবানদের অনুরোধ করেছেন। চৌহালী আওয়ামী লীগের সভাপতি তাজউদ্দিন খোঁজ নিয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়ার আশ্বাস দিয়েছেন। চৌহালী উপজেলার ভারপ্রাপ্ত  নির্বাহী কর্মকর্তা আনিছুর রহমান দায়িত্ব নিয়ে বলেছেন, ‘মোরশেদা খানমের পক্ষে তার নিকট আত্মীয়দের কেউ আবেদন করলে ঘরের জন্য টিন ও বয়স্ক ভাতা কার্ড করে দেওয়া হবে।’

হয়তো এ সবই হবে। হয়তো এ সবই মোরশেদা খানমের ললাটের লিখন। কিন্তু যে ললাট প্রতীক্ষায় আছে একমাত্র সন্তানের স্নেহের করতল স্পর্শের, সেই প্রতীক্ষা পূরণের দায়িত্ব বিধাতা নেবেন না কেন?

/তারা/ 

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়