ঢাকা     শনিবার   ০৯ ডিসেম্বর ২০২৩ ||  অগ্রহায়ণ ২৪ ১৪৩০

অন্যরকম এক অন্তঃসত্ত্বা মায়ের গল্প

বান্দরবান প্রতিনিধি || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ২০:২২, ২১ নভেম্বর ২০২৩  
অন্যরকম এক অন্তঃসত্ত্বা মায়ের গল্প

এখনো বিরাজ করছে চাপা আতঙ্ক আর ভয়। অন্যদিকে এলাকাবাসী ফিরে আসায় জিংপার মুখে আনন্দের হাসি। কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্টের (কেএনএফ) আতঙ্কে পাইংক্ষ্যং পাড়াসহ আশপাশের সব এলাকাবাসী পালিয়ে যেতে শুরু করেছে গত এপ্রিল থেকে।

রৌনিন পাড়া, দুর্নিবার পাড়া, খামতাং পাড়ায় কয়েক দফা মৃত্যুর ঘটনায় পালিয়ে যাওয়া আরও বেগবান করে। কেউ পালিয়ে ছিলেন আত্মীয়ের বাড়িতে, কেউবা পালিয়ে ছিলেন জঙ্গলে, আবার কেউ জুমঘরে। পুরো পাড়া শুনশান নীরব, কেউ নেই। পাড়ার সব পরিবার পালিয়ে গেলেও জিংপা বম পালিয়ে যেতে পারেননি কারণ জিংপা তখন অন্তঃসত্ত্বা ছিলেন। দীর্ঘ সাত মাস জিংপা কখনো খেয়ে, কখনো না খেয়ে কাটিয়েছেন পাড়ায়।

বান্দরবান জেলার রোয়াংছড়ি উপজেলার সদর ইউনিয়নের ৬নং ওয়ার্ডের পাইংক্ষ্যং পাড়ার জিংপা বম (৩০) নামে এক মায়ের জীবন সংগ্রামের কথা বলছি।

পাইংক্ষ্যং পাড়াসহ আশপাশের কয়েকটি পাড়ায় কয়েক দফা বন্দুক যুদ্ধে নিহত হওয়ার পর আতঙ্কে পাড়াবাসী সবাই পালিয়ে যায়। এক মেয়েকে নিয়ে কোথাও যেতে পারেননি কারণ পাঁচ মাসের অন্তঃসত্ত্বা ছিলেন জিংপা। সন্তানের কথা ভেবে পাড়ায় একাই থেকে গেছেন। পাড়ায় গোলাগুলি হয়েছে পরে আরও ঝামেলা হতে পারে এই ভেবে তাদের বাবা-মা নিরাপদ আশ্রয়ে চলে যায়। তার স্বামী পাশের এক জুমঘরে পালিয়ে যায়। ওখাান থেকে তাকে দিনে এক বা দুইবার দেখতে আসতেন। মৃত্যুর ভয় আর আতঙ্কে পার করতেন এক একটা দিন। এভাবে ভয় আর আতঙ্কের মধ্যে গত পহেলা অক্টোবর রাতে প্রসবের যন্ত্রণা শুরু হয়। পাশে লুকিয়ে থাকা জুমঘর থেকে স্বামী এসে দেখেন। পরে আশপাশের জঙ্গলে, জুমঘরে পালিয়ে থাকা পাড়াবাসীকে জানালে চারজন মহিলা এগিয়ে আসে। তাদের সহযোগিতায় গভীর রাতে ঘরেই ছেলের জন্ম হয়। তার নাম রাখা হয় ড্রামফেনচাং বম, বয়স এখন দেড় মাস।

রোয়াংছড়ি উপজেলা থেকে পাইংক্ষ্যং পাড়ার দূরত্ব প্রায় ১৩ কিলোমিটার। নেটওয়ার্ক নেই। বিদ্যুৎ নেই। এ পাড়ায় ৯৭ বম পরিবারের বসবাস। সবাই পালিয়ে ছিলেন দীর্ঘ আট মাস।

গত শনিবার (১৮ নভেম্বর) পাড়ায় ফিরেছেন ৫৭ পরিবার। এখনো ৪০ পরিবার ফিরতে পারেনি। পাইংক্ষ্যং পাড়ায় প্রবেশের মুখে জিংপার মাচাং ঘর। দোলনায় দুলছিল ড্রামফেনচাং। ফুটফুটে ফর্সা, মুখে তার মুচকি হাসি। ছেলের জন্য মায়ের এই জীবন যুদ্ধের কথা ড্রামফেনচাং জানেই না। হয়তো একদিন জানবে তার মায়ের গল্প। বর্তমানে তার দুই সন্তান।

জিংপা'র স্বামী ডোয়ালিয়াং বম একজন জুমচাষী। জুমচাষ করেই তাদের সংসার চলে। এ বছর পাড়ায় কেউই জুমচাষ করতে পারেননি। খাদ্য সংকটে পড়েছেন পাড়ার সবাই। জিংপা তার বড় দিদির থেকে ১০ হাঁড়ি ধান নিয়ে কোনোরকমে সংসার চালাচ্ছেন। এই ধান শেষ হলে কি করবেন, সেটি নিয়েই চিন্তা তার।

পাইংক্ষ্যং পাড়ায় ফিরে আসা পারভিময় বম নামে আরেক মা বলছিলেন, পাশের এক পাড়ায় (রৌনিন পাড়া) তিনজনের মৃত্যুর খবর পেয়ে, ভয়ে একসাথে পনেরো পরিবার পালিয়ে যায়। তার দুটি সন্তান ছিল। হাঁটতে না পারায় বেশি দূরে পালাতে পারেননি। পাড়ার পাশের একটা জঙ্গলে লুকিয়ে ছিলেন। খাবার ফুরিয়ে গেলে রাতের অন্ধকারে পাড়ায় এসে ধান-চাল নিয়ে যেতেন। এভাবে জঙ্গলে লুকিয়ে ছিলেন তারা।
পাড়ার পাশে জুমঘরে লুকিয়ে থাকা লালকিম বম বলেন, ‘গ্রামের সবাই পালিয়েছিল। মেয়েটি তার সন্তান নিয়ে একাই বাড়িতে ছিল। প্রসবের সময় পাশে জঙ্গলে পালিয়ে থাকা চারজন মহিলার সহযোগিতা পেয়েছিলেন। আগের মত যদি শান্তি ফিরে আসে গ্রামবাসীদের জন্য খুব ভালো হবে। এলাকাবাসী চায় শান্তিতে, নির্ভয়ে যাতে জুমচাষ করে বেঁচে থাকতে পারে।’

চাইমং/ফয়সাল

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়