মসজিদে দাঁড়িয়ে প্রতিজ্ঞা: ভালো হতে চেয়ে হলেন মাদক সম্রাট
রফিক সরকার, গাজীপুর || রাইজিংবিডি.কম
বাঁ থেকে- সাখাওয়াত, মোফাজ্জল ও হৃদয়
মসজিদে দাঁড়িয়ে প্রতিজ্ঞা করেছিলেন, ফিরবেন সৎ জীবনে। কিন্তু কয়েক মাসের মধ্যেই সেই ‘প্রতিজ্ঞাবদ্ধ’ সাখাওয়াত হোসেন এখন পরিণত হয়েছেন গাজীপুরের কালীগঞ্জ উপজেলার দুর্বাটি এলাকার মাদক সম্রাটে। স্থানীয়দের বিশ্বাস ভেঙে, সমাজের বিভিন্ন শ্রেণিকে ব্যবহার করে, তিনি গড়ে তুলেছেন একটি ভয়ঙ্কর এক মাদক সাম্রাজ্য।
চলতি বছরের জানুয়ারিতে কালীগঞ্জ পৌরসভার ১ নম্বর ওয়ার্ডের দুর্বাটি এলাকার মসজিদে দাঁড়িয়ে মো. সাখাওয়াত হোসেন (৩৮) ঘোষণা দিয়েছিলেন, তিনি আর কখনো মাদক ব্যবসায় জড়াবেন না। রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর আইনের চোখ এড়িয়ে চলতে এ প্রতিজ্ঞা করেছিলেন বলে জানান স্থানীয়রা।
সেদিন উপস্থিত মুসল্লিরা তাকে সংশোধনের সুযোগ দিয়েছিলেন। কিন্তু কয়েক সপ্তাহ যেতে না যেতেই সাখাওয়াত পুনরায় মাদক ব্যবসায় নেমে পড়েন আরও সংগঠিতভাবে। এখন তিনি শুধু নিজের এলাকাতেই সীমাবদ্ধ নন বরং আশেপাশের উপজেলাগুলোতেও মাদক সরবরাহ করছেন বলে বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে।
স্থানীয় অনুসন্ধানে জানা গেছে, দুর্বাটি ও বাঙ্গালহাওলা এলাকায় অন্তত ১৩টি স্থানে সক্রিয়ভাবে ইয়াবা, হেরোইন, গাঁজা ও চোলাই মদের বেচাকেনা হচ্ছে। এর মধ্যে রয়েছে—বাঙ্গালহাওলা ব্রিজের পূর্ব পাশের তমির ভিটা, গণি মিয়ার পুকুরপাড়, সাধুর হাট, তুমলিয়া রেল ব্রিজ, খ্রিস্টান পাড়ার একাংশ, শিমুলতলা, ফকির বাড়ি, ফারুক চেয়ারম্যানের সড়ক এবং মাদক কারবারি হৃদয়ের নিজ বাড়িসহ একাধিক স্পট।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, প্রতিদিন সন্ধ্যার পর এসব জায়গায় মাদকসেবীদের আনাগোনা বেড়ে যায়। এলাকাবাসী নিজ উদ্যোগে পাহারার ব্যবস্থা করলেও কোনো ফল মেলেনি। স্থানীয়দের অভিযোগ, পুলিশকে অসহযোগিতা এবং সাখাওয়াতের ‘ম্যানেজমেন্ট’ এসব কর্মকাণ্ডের পেছনে বড় ভূমিকা রাখছে।
সাখাওয়াতের নেটওয়ার্কে রয়েছে দুর্বাটি গ্রামের আব্দুল মান্নান ভূঁইয়ার ছেলে হৃদয় ভূঁইয়া, মৃত মো. মোশারফ হোসেনের ছেলে প্রবাস ফেরত মোফাজ্জল হোসেন ও মৃত মহসিন মছেনের ছেলে মো. হাবিবুর রহমান হাবি। তারা সবাই প্রকাশ্যে মাদক সরবরাহ করছে, এমনকি পুলিশি অভিযানের ভয়ও তাদের নেই বলে অভিযোগ রয়েছে।
মাদকের প্রভাবে এসব এলাকায় পারিবারিক সংকট চরমে উঠেছে। জানা গেছে, এক মাদকসেবী ছেলে নিজের পরিবারের শেষ সম্বল গরুটিও বিক্রি করে দিয়েছে মাদক কেনার জন্য। আরেকজন স্ত্রীর জমানো টাকা না পেয়ে তাকে মারধর করেছে।
এদিকে, চুরি, ছিনতাই, এমনকি ডাকাতির মত অপরাধও বেড়েছে আশঙ্কাজনক হারে। এলাকাবাসীর ভাষায়, ‘এখনকার দুর্বাটি যেন এক খোলা মাদক বাজার!’
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক স্থানীয় বাসিন্দা জানান, সাখাওয়াত মসজিদে দাঁড়িয়ে বলেছিলেন, তিনি আর মাদক বিক্রি করবেন না। কিন্তু এখন তিনি উপস্থিত মুসল্লিদের মান-সম্মান শেষ করে দিয়েছেন। কোথাও গেলে লোকে বলে, আমরা নাকি মাদক কারবারির এলাকা থেকে এসেছি। পরিবারের শিশু-কিশোররাও আজ মাদকের ফাঁদে পড়ে গেছে।
দুর্বাটি ও বাঙালহাওলা এখন এক অঘোষিত মাদক হটস্পট। এলাকা রক্ষায় প্রশাসনের হস্তক্ষেপ, গণসচেতনতা ও সম্মিলিত প্রয়াস ছাড়া বিকল্প দেখছেন না কেউ।
এলাকাবাসী বলছেন, যে মসজিদে দাঁড়িয়ে প্রতিজ্ঞা করেছিল, আজ সেই মসজিদের পাশেই নেশার কারবার চালাচ্ছে সাখাওয়াত। আর কতকাল চলবে এই প্রতারণা? প্রশ্ন তাদের।
কালীগঞ্জ পৌরসভার ১ নম্বর ওয়ার্ডের সাবেক কাউন্সিলর মোফাজ্জল হোসেন আকন্দ মোমেন বলেন, “আমি প্রতিটি মসজিদে গিয়েছি, উঠান বৈঠক করেছি। সাখাওয়াতকে সংশোধনের সুযোগ দিয়েছি। কিন্তু সে কথা রাখেনি। পুলিশকে আমরা সহযোগিতা করতে প্রস্তুত, এখন তাদেরই পদক্ষেপ নেওয়ার সময়।”
কালীগঞ্জ থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) মো. আলাউদ্দিন বলেন, “আমি আগস্টের পর এই থানায় যোগদান করেছি। বাঙালহাওলা ও দুর্বাটি এলাকার মাদক স্পট সম্পর্কে আগে অবগত ছিলাম না। তবে এখন জেনেছি, দ্রুত সময়ের মধ্যেই অভিযান চালানো হবে।”
তিনি আরও বলেন, “মাদকের ব্যাপারে আমরা জিরো টলারেন্স নীতি অনুসরণ করি। স্থানীয়রা তথ্য দিলে আমরা আরও কার্যকর পদক্ষেপ নিতে পারব। কেউই আইনের ঊর্ধ্বে নয়।”
ঢাকা/এস