ঢাকা     শুক্রবার   ০৫ ডিসেম্বর ২০২৫ ||  অগ্রহায়ণ ২০ ১৪৩২

Risingbd Online Bangla News Portal

ফেনীতে বন্যা: কৃষি, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদে ব্যাপক ক্ষতি

ফেনী প্রতিনিধি || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৯:৪৪, ১৪ জুলাই ২০২৫  
ফেনীতে বন্যা: কৃষি, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদে ব্যাপক ক্ষতি

স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যার এক বছর পার না হতেই আবারো পানিতে তলিয়ে গেছে ফেনীর বিস্তীর্ণ জনপদ। টানা বর্ষণ ও ভারতের উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলের কারণে জেলার ফুলগাজী, পরশুরাম, ছাগলনাইয়া, দাগনভূঞা ও সদর উপজেলার বহু নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়।

বন্যার পানির তোড়ে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন কৃষক, মাছচাষি ও গবাদিপশু পালনকারীরা। জেলা প্রশাসন ও সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলোর প্রাথমিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, কৃষি, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ খাতে মোট ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ১০ কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে। ক্ষতির পরিমাণ আরো বাড়বে বলে ধারণা করছেন তারা। 

আরো পড়ুন:

ডুবে গেছে সাড়ে ৫ হাজার হেক্টরের বেশি ফসলি জমি: 
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্যমতে, এবার বন্যায় ৮৪৫ হেক্টর জমির আউশ ধান, ৫৩৭ হেক্টর জমির গ্রীষ্মকালীন সবজি পানিতে তলিয়ে যায়। মরিচ, আদা, হলুদ ও টমেটো মিলিয়ে প্রায় ২৫ হেক্টর এবং আমন ধানের ৬৮৯ হেক্টর বীজতলা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বস্তায় সংরক্ষিত আদা ৩ হাজার ৪৭০ হেক্টর জমির ফসল হিসেবে ধরা হয়েছে। সবমিলিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত জমির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৫ হাজার ৫৬৬ হেক্টর।

ফুলগাজীর দরবারপুর ইউনিয়নের কৃষক কামরুজ্জামান চৌধুরী বলেন, “তিন বিঘা জমির আমন বীজতলা পানিতে তলিয়ে গেছে। প্রতিবছর এমন হয়। সরকার যদি কার্যকর কোনো ব্যবস্থা না নেয়, কৃষকদের টিকে থাকা কঠিন হয়ে যাবে।”

পরশুরামের ধনীকুন্ডা এলাকার কৃষক মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, “পাঁচ বিঘা জমির শাক-সবজি একরাতেই পানিতে ডুবে গেছে। বছর না ঘুরতেই আবারো এমন ক্ষতির মুখে পড়লাম।”

জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মোহাম্মদ আতিক উল্লাহ বলেন, “বন্যার পানি এখনো অনেক জায়গায় রয়েছে। পানি নামার পরই প্রকৃত ক্ষয়ক্ষতির চিত্র পাওয়া যাবে। আমরা ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের তালিকা তৈরি করছি, সরকারকে প্রণোদনার জন্য প্রস্তাব দেওয়া হবে।”

মৎস্য খাতে ক্ষতি ৮ কোটি ৭০ লাখ টাকা
জেলা মৎস্য অফিসের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, জেলার ছয়টি উপজেলায় ২ হাজার ৩৩০টি পুকুর, দিঘি ও মাছের খামার বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ভেসে গেছে ২৭৬ মেট্রিক টন মাছ এবং ১২৮ মেট্রিক টন পোনা মাছ। মাছ ও পোনার আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে প্রায় ৮ কোটি ৭০ লাখ টাকা।

ফুলগাজীর শ্রীপুর গ্রামের মাছচাষি আলমগীর বলেন, “তিন বিঘা পুকুরের সব মাছ চলে গেছে। প্রায় আড়াই লাখ টাকার ক্ষতি হয়েছে।”

পরশুরামের মাছচাষি হাসিবুর রহমান বলেন, “পুকুরের চারপাশে নেট দিয়েছিলাম, কিন্তু বাঁধ ভেঙে পানির তীব্র স্রোতে সব ভেসে গেল। গতবার বন্যার পর কোনো সহায়তা পাইনি।”

জেলা মৎস্য কর্মকর্তা আমিনুল ইসলাম বলেন, “উপজেলা পর্যায়ে চূড়ান্ত ক্ষয়ক্ষতির প্রতিবেদন প্রস্তুত করা হচ্ছে। ক্ষতিগ্রস্তদের তালিকা সরকারকে দেওয়া হবে।”

প্রাণিসম্পদে ক্ষতি প্রায় ৬৫ লাখ টাকা
জেলা প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের প্রাথমিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, এবারের বন্যায় ১০ হাজার ৬০০টি মুরগি, ২৩৫টি হাঁস, তিনটি ছাগল, একটি ভেড়া ও চারটি গরু মারা গেছে। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে গবাদিপশুর খাদ্যও। নষ্ট হয়েছে ৭ টন দানাদার খাদ্য, ৩০ টন খড় ও ১৬০ টন ঘাস। সবমিলিয়ে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ৬৫ লাখ টাকা।

ফুলগাজীর কমুয়া চানপুর গ্রামের খামারি রাসেল বলেন, “আমার একটি গরু বন্যার পানিতে ডুবে মারা গেছে। আয়-রোজগারের প্রধান উৎস ছিল গরুটি। আমি নিঃস্ব হয়ে গেছে।”

বিসমিল্লাহ পোল্ট্রি খামারের মালিক হাসান বলেন, “দেড় হাজার মুরগি মারা গেছে। সব মিলিয়ে প্রায় সাড়ে চার লাখ টাকার ক্ষতির মুখে পড়েছি।”

জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডা. মো. মোজাম্মেল হক বলেন, “প্রাণিসম্পদ খাতে ক্ষতির পরিমাণ আরো বাড়তে পারে। সরকারিভাবে বরাদ্দ পেলে ক্ষতিগ্রস্তদের সহায়তা দেওয়া হবে।”

গত ৮ জুলাই থেকে জেলার মুহুরী, কহুয়া ও সিলোনিয়া নদীর তীরবর্তী এলাকাগুলোতে পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্মিত বাঁধ ভেঙেছে অন্তত ৪১টি স্থানে। ফলে প্লাবিত হয় জেলার পাঁচটি উপজেলা। স্থানীয় বাসিন্দারা বলছেন, প্রতি বছর বর্ষা এলেই এই দুর্দশার সৃষ্টি হয়। তারা দ্রুত সময়ের মধ্যে স্থায়ী ও টেকসই বাঁধ নির্মাণের দাবি জানিয়েছেন।

ঢাকা/সাহাব/মাসুদ

সম্পর্কিত বিষয়:

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়