ঢাকা     মঙ্গলবার   ০৯ ডিসেম্বর ২০২৫ ||  অগ্রহায়ণ ২৪ ১৪৩২

Risingbd Online Bangla News Portal

রক্তাক্ত ৪ আগস্ট: ফেনীতে গুলিতে ঝরে যায় ৭ তরুণের প্রাণ

ফেনী প্রতিনিধি || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৯:৪৭, ৪ আগস্ট ২০২৫   আপডেট: ১৯:৫০, ৪ আগস্ট ২০২৫
রক্তাক্ত ৪ আগস্ট: ফেনীতে গুলিতে ঝরে যায় ৭ তরুণের প্রাণ

উপরে বাম থেকে: ইসতিয়াক আহমেদ শ্রাবণ, সরওয়ার জাহান মাসুদ, সবুজ, ছাইদুল ইসলাম শাহী; নিচে বাম থেকে:জাকির হোসেন শাকিব, ওয়াকিল আহম্মদ শিহাব ও মাহবুবুল হাসান মাসুম

৪ আগস্ট ২০২৪, শ্রাবণের শেষ বিকেল। ফেনীর মহিপাল ফ্লাইওভারের নিচে শান্তিপূর্ণ অবস্থান করছিলেন হাজারো ছাত্র-জনতা। তৎকালীন শেখ হাসিনা সরকারের পদত্যাগের এক দফা আন্দোলনের কর্মসূচিতে তারা জড়ো হয়েছিলেন। হাতে ছিল লাল-সবুজের পতাকা, চোখে বৈষম্যহীন বাংলাদেশের স্বপ্ন।

ফ্লাইওভার এলাকায় উত্তেজনা বাড়তে থাকে। হঠাৎ বিকট শব্দে গর্জে ওঠে মহিপাল এলাকা। গুলিতে লুটিয়ে পড়েন ইসতিয়াক আহমেদ শ্রাবণ, সরওয়ার জাহান মাসুদ, মো. সবুজ, ছাইদুল ইসলাম শাহী, জাকির হোসেন শাকিব ও ওয়াকিল আহম্মদ শিহাব। সেখানে তাদের মৃত্যু হয়। গুলিবিদ্ধ হয়েও বেঁচে ছিলেন শিক্ষার্থী মাহবুবুল হাসান মাসুম। ৭ আগস্ট চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনিও মারা যান।

আরো পড়ুন:

মহিপাল এলাকায় কয়েক ঘণ্টার মধ্যে সব স্তব্ধ হয়ে যায়। বাতাসে বারুদের গন্ধ, রাস্তায় রক্ত আর পড়ে থাকা জুতা-স্যান্ডেল হয়ে ওঠে নৃশংসতার নীরব সাক্ষ্য।

শহীদ ইসতিয়াক আহমেদ শ্রাবণের মা ফাতেমা আক্তার বলেন, ‘‘ও মাথায় আমার ওড়না পেঁচিয়ে আন্দোলনে গিয়েছিল। এক বছর পরও আমরা তার মৃত্যু মেনে নিতে পারছি না। মেয়েটা (শ্রাবণের বোন) ভাইয়ের শোকে কারো সঙ্গে কথাও বলে না।’’ 

শহীদ ছাইদুল ইসলাম শাহীর মা রাহেনা বেগম বলেন, ‘‘শাহী বাসা থেকে বের হওয়ার আগে ২৫ টাকা চেয়েছিল। বলেছিল শহর থেকে ফেরার ভাড়া লাগবে। কিন্তু আর ফেরেনি।’’

শহীদ ওয়াকিল আহম্মদ শিহাবের মা মাহফুজা আক্তার বলেন, ‘‘চুল কাটবে বলে ঘর থেকে বের হয়েছিল। হয়ত বুঝেছিল, এবারই শেষ দেখা। বুকের মধ্যে তিনটা গুলি লেগে ঝাঁঝরা হয়ে গিয়েছিল আমার সন্তান।’’

মাহবুবুল হাসান মাসুমের ভাই মাহমুদুল হাসান বলেন, ‘‘মামলায় কোনো অগ্রগতি নেই। যারা জামিনে বের হয়ে আসে, তাদের অনেকে প্রভাবশালীদের সহায়তায় বারবার পার পেয়ে যাচ্ছে।’’ 
আহতদের একজন নূর হোসেন, তখন ফেনী ইউনিভার্সিটির আইন বিভাগের শিক্ষার্থী ছিলেন। তিনি বলেন, ‘‘গুলিবিদ্ধ হওয়ার পর আমি হাসপাতালে গিয়েও চিকিৎসা পাইনি। উল্টো হামলার মুখে পড়তে হয়।’’ 

ঘটনার দিন ফেনী শহরের বিভিন্ন হাসপাতালে আহতদের চিকিৎসা দিতে অস্বীকৃতি জানায়। অভিযোগ রয়েছে, হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে নিষেধ করা হয়। ফেনী জেনারেল হাসপাতালে প্রথমে নেয়া হয় শ্রাবণের মরদেহ। একে একে আসতে থাকে অন্যদের মরদেহও। হাসপাতালে কান্নার রোল পড়ে যায়। মহিপালের হামলা ও হত্যার ঘটনায় মোট ২২টি মামলা হয়েছে। তার মধ্যে ৭টি হত্যা ও ১৫টি হত্যাচেষ্টার মামলা। এ সব মামলায় ২ হাজার ১৯৯ জনের নাম রয়েছে। আরো ৪ হাজার অজ্ঞাতনামা আসামির কথা উল্লেখ আছে। একমাত্র মাসুম হত্যা মামলায় ২২১ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দেয়া হয়েছে। অভিযুক্তদের মধ্যে রয়েছেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং ফেনীর দুই সাবেক সংসদ সদস্য। 

পুলিশ বলছে, ১৬৪ ধারায় ১১ জন আসামি স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। অনেকে এখনো পলাতক। তথ্যপ্রযুক্তির সহায়তায় অভিযান অব্যাহত রয়েছে। 

৪ আগস্টে ফেনীর মহিপালে গুলি করার দৃশ্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয়। একাধিক ভিডিওতে দেখা গেছে, একজন যুবক মহিপাল প্লাজার সামনে রিকশা থেকে নেমে অত্যাধুনিক অস্ত্র দিয়ে গুলি ছুড়তে ছুড়তে সামনে এগিয়ে যাচ্ছে। তার আশপাশে অনেকের হাতে তখন দেশীয় অস্ত্র ছিল। একপর্যায়ে আন্দোলনকারীরা পিছু হটলেও গুলিবর্ষণ বন্ধ হয়নি। নিহতদের মধ্যে অধিকাংশ ছিল গুলিবিদ্ধ।

সেদিন সংবাদ সংগ্রহে গিয়ে অনেক সাংবাদিকও মারধর ও লাঞ্ছিত হয়েছেন। অনেককে মোটরসাইকেল থামিয়ে মারধর করা হয়। ছিনিয়ে নেয়া হয় পরিচয়পত্র ও মোবাইল। এ দিন অন্তত ১০ জন সাংবাদিককে ব্যাংক ভবনের দ্বিতীয় তলায় অবরুদ্ধ করে রাখার অভিযোগ পাওয়া গেছে।

ফেনী জেলা বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের সাবেক সমন্বয়ক মুহাইমিন তাজিম বলেন, ‘‘শহীদদের রক্তের ওপর এ সরকার গঠিত। অথচ এখনো বিচার হয়নি। আমরা দাবি করছি, বিচার দ্রুত সম্পন্ন হোক।’’ 

ফেনীর পুলিশ সুপার হাবিবুর রহমান জানান, জুলাই-আগস্টের ঘটনায় ২২টি মামলা হয়েছে। এর মধ্যে ৪ আগস্টে ফেনীর মহিপালে নিহত মাহবুবুল হাসান মাসুম হত্যার ঘটনায় ২২১ জনের বিরুদ্ধে চার্জশিট দেয়া হয়েছে। এতে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও এমপি নিজাম হাজারীকে নির্দেশদাতা হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।

তিনি আরও বলেন, তদন্তে যাদের সম্পৃক্ততা পাওয়া গেছে, তারাই চার্জশিটে আছেন। এখানে কোনো রাজনৈতিক পরিচয় বিবেচনায় আনা হয়নি। অনেক আসামিকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। যারা বিদেশে আছে, তাদের ফিরিয়ে আনতে ইন্টারপোলের সহযোগিতা চাওয়া হচ্ছে।

জেলা প্রশাসক মো. সাইফুল ইসলাম বলেন, ‘‘ফেনীতে হতাহতের সংখ্যা অন্য জেলার তুলনায় বেশি ছিল। ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারকে সহায়তা দিতে আমরা সর্বাত্মক চেষ্টা করেছি। এখন পর্যন্ত সাড়ে ৫ কোটি টাকার সহায়তা দেয়া হয়েছে।’’ 

ঢাকা/সাহাব/বকুল

সম্পর্কিত বিষয়:

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়