পিঠে গুলি, বুকে জীবনজয়ের আকুতি
নিয়াজ আহমেদ সিপন || রাইজিংবিডি.কম
পরিবারের সদস্যদের সাথে মোহাম্মদ আলী (চেয়ারে বসা)
“আল্লাহর কাছে হাজার শুকরিয়া যে আমি বেঁচে ফিরতে পেরেছি, বাবা-মায়ের মুখ দেখতে পারছি। জীবনে এমন পরিস্থিতি দেখব ভাবিনি।” বিছানায় শুয়ে অস্ফুট স্বরে কথাগুলো বলছিলেন মোহাম্মদ আলী (১৬), যার পিঠে এখনও বয়ে বেড়াচ্ছেন গত জুলাই-আগস্টের ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের সময়ের গুলিবিদ্ধ হওয়ার যন্ত্রণা।
ঢাকার রাজপথে স্রেফ মিছিল দেখতে গিয়ে জীবনটাই হারাতে বসেছিলেন লালমনিরহাটের আদিতমারী উপজেলার কুমড়ীরহাট এস সি স্কুল এন্ড কলেজের দশম শ্রেণির এই শিক্ষার্থী।
মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে এলেও ভবিষ্যৎ নিয়ে গভীর শঙ্কা আর চিকিৎসার বিপুল খরচ কীভাবে জুটবে, সেই চিন্তায় দিশেহারা মোহাম্মদ আলী ও তার দিনমজুর পরিবার। শুধু নিজের জীবন হারাতে বসেছিলেন তাই নয়, চোখের সামনে হারিয়েছেন খালাতো ভাই মিরাজকে।
মিরাজ মহিষখোচা বহুমুখী উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি উত্তীর্ণ হয়ে কলেজে ভর্তি হয়েছিল। তিনি ঢাকায় গার্মেন্টসে কাজ করতেন। উপজেলার মহিষখোচা ইউনিয়নের খানপাড়া এলাকার আব্দুস সালামের ছেলে মিরাজ।
জুলাই-আগস্টের উত্তাল সময়ে দেশজুড়ে চলছিল বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন। হাজার হাজার ছাত্র-জনতা তখন ঢাকার রাজপথে। যাত্রাবাড়ীতে এমনই এক মিছিলের উত্তাপ ছুঁয়ে গিয়েছিল ঢাকায় বেড়াতে আসা লালমনিরহাটের কিশোর মোহাম্মদ আলীকে। তার ভাষায়, “আমরা শুধু মিছিল দেখতে গিয়েছিলাম। পরিবেশটা এমন ছিল যে, ঠিক থাকতে পারিনি।” খালাতো ভাই মিরাজকে সঙ্গে নিয়ে তিনিও মিশে যান সেই স্রোতে। কিন্তু মুহূর্তেই সব আনন্দ বদলে যায় বিভীষিকায়। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ছোড়া গুলিতে আলীর কোমর ও পিঠের এক অংশে এবং মিরাজের দুই হাঁটুতে গুলি লাগে। রক্তাক্ত অবস্থায় দুজনকে উদ্ধার করে সহযোদ্ধা শিক্ষার্থীরা।
আহত অবস্থায় তাদের নেওয়া হয় যাত্রাবাড়ির একটি স্থানীয় এক হাসপাতালে। কিন্তু সেখানে প্রয়োজনীয় চিকিৎসার ব্যবস্থা ছিল না। উপায়ন্তর না দেখে ৩০ হাজার টাকায় একটি মাইক্রোবাস ভাড়া করে মোহাম্মদ আলীকে নিয়ে যাওয়া হয় রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। সঙ্গে ছিলেন গুলিবিদ্ধ খালাতো ভাই মিরাজও। কিন্তু রংপুরে পৌঁছেও বিপত্তি। শত শত আহত রোগীর ভিড়ে তাৎক্ষণিক চিকিৎসা মেলেনি। চিকিৎসার এই বিলম্বই কাল হয় মিরাজের জন্য। অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে সেখানেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন মিরাজ। আলীর অবস্থা তখন জীবন-মরণ। অনেক কষ্টে সেখানে তার গুলি বের করেন চিকিৎসকরা। টানা ১২ দিনের পর বাড়িতে নিয়ে আসেন তার পরিবার।
রংপুরে কয়েকদিনের যন্ত্রণাদায়ক চিকিৎসা শেষে পরিবার একটি সিএনজিচালিত অটোরিকশা ভাড়া করে আলীকে ফিরিয়ে আনে তার গ্রামের বাড়ি লালমনিরহাটের আদিতমারী উপজেলার ভাদাই ইউনিয়নের নেগাদের ঘাট গ্রামে। আলী ওই গ্রামের দিনমজুর মোমিন মিয়া ও মোছা মোমেনা খাতুনের একমাত্র অবলম্বন।
বাবা মোমিন মিয়া অন্যের জমিতে কাজ করে সংসার চালান, মা গৃহিণী। অন্যের জমিতেই কোনোমতে মাথা গোঁজার ঠাঁই তাদের।
শারীরিক যন্ত্রণার পাশাপাশি ভবিষ্যৎ নিয়ে গভীর অনিশ্চয়তা ভর করেছে আলীর মনে। তিনি বলেন, “গুলিটা পিঠে লাগার পর থেকে আমি আর সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারি না বেশিক্ষণ। ভারী কোনো কাজ করার শক্তি নেই। পড়াশোনাও বন্ধ হয়ে গেল। আমার তো কাজ করে খাওয়ার কথা ছিল, এখন আমিই সবার চিন্তার কারণ। আমি সরকারের কাছে, দেশের মানুষের কাছে হাত জোড় করে প্রার্থনা করি, আমার চিকিৎসার দায়িত্ব নিন। আমার অসহায় পরিবারটার পাশে একটু দাঁড়ান। আমি বাঁচতে চাই, সুস্থ হয়ে বাবা-মায়ের দেখাশোনা করতে চাই।”
তার মা মোমেনা খাতুন কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, “ছেলেটার সঙ্গের ভাইটা মারা গেল। আমার ছেলেটারও কী হয়, সেই ভয়ে কলিজা শুকিয়ে যাচ্ছিল। ডাক্তারদের হাতে-পায়ে ধরেছি আমরা। অনেক কষ্টে তারা রাজি হয়ে পিঠ থেকে গুলিটা বের করেছে। আল্লাহ্ আমার ছেলেটাকে শুধু ফিরিয়ে দিয়েছেন।”
তিনি আরো বলেন, “এখন যে টাকা সরকারীভাবে পেয়েছি সেই টাকা চিকিৎসা করতে শেষ হয়েছে। এখন মোহাম্মদ আলীর বাবা দিনমজুরের কাজ করে যে টাকা পায়, সেই টাকায় তার ওষুদের ব্যবস্থা করেন। এভাবে কতদিন চলবে? তাই সরকারের প্রতি অনুরোধ যে দিনমজুর পরিবারের দিকে একটু তাকায়।”
দিনমজুর বাবা মোমিন মিয়া অশ্রুসজল চোখে বলেন, “ছেলেটাকে নিয়েই যত স্বপ্ন ছিল। এখন সে নিজেই বিছানায়। ওর চিকিৎসার খরচ জোগাড় করতে গিয়ে সব হারিয়েছি। এখন কীভাবে কী হবে জানি না। সরকার যদি একটু দয়া না করে, তাহলে ছেলেটাকে বাঁচানোই কঠিন হয়ে যাবে।”
তিনি আরো বলেন, “আমরা চাই তাকে একটি চাকরি দিলে সেটা করে চলতে পারবে। আমরা অন্যের জমিতে বসবাস করে চলি। ঘর-বাড়ি নেই বললে চলে। যার জমিতে আছি, তারাও আর বেশিদিন রাখতে রাজি নয়। তাই সরকারের প্রতি অনুরোধ দ্রুত আমাদের দিকে দৃষ্টি দেওয়া। না হলে চলার মত কোন পথ থাকবে না।”
বাবা মোমিন মিয়া বলেন, “সরকারীভাবে অনেক মানুষ এগিয়ে এসেছে। ডিসি অফিস থেকে প্রায় ৩৫ হাজার ও বিভিন্নভাবে ১ লক্ষ টাকা পেয়েছি, সেই টাকা চিকিৎসা করতে শেষ। যারা হেল্প করেছে তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা।”
অসুস্থ মোহাম্মদ আলী বলেন, “আমার বাবা-মা খুব গরিব। অন্যের জায়গায় থাকি আমরা। তাদের মুখে একটু হাসি ফোটাব, সংসারের হাল ধরব, এই স্বপ্ন নিয়েই তো ঢাকায় গিয়েছিলাম একটা কাজের আশায়। কিন্তু এখন আমি নিজেই বোঝা হয়ে গেলাম। আমার চিকিৎসার জন্য আব্বা-আম্মা যা জমানো ছিল সব শেষ করে ফেলেছে। সরকার আর মানুষের কাছ থেকে যা সাহায্য পেয়েছিলাম, সেটাও প্রায় শেষ। আব্বা এখন কোথায় টাকা পাবে? আমার চিকিৎসা কীভাবে চলবে? কিছুই বুঝতে পারছি না।” কথাগুলো বলতে বলতে কান্নায় ভেঙে পড়েন তিনি।
দিনমজুর বাবা মোমিন মিয়া অশ্রুসজল চোখে বলেন, “ছেলেটাকে নিয়েই যত স্বপ্ন ছিল। এখন সে নিজেই বিছানায়। ওর চিকিৎসার খরচ জোগাড় করতে গিয়ে সব হারিয়েছি। এখন কীভাবে কী হবে জানি না। সরকার যদি একটু দয়া না করে, তাহলে ছেলেটাকে বাঁচানোই কঠিন হয়ে যাবে।”
এ বিষয়ে লালমনিরহাট জেলা প্রশাসক (ডিসি) জনাব এইচ এম রকিব হায়দার বলেন, “মোহাম্মদ আলীর মতো একজন তরুণের গুলিবিদ্ধ হওয়ার পরও অলৌকিকভাবে বেঁচে ফেরা নিঃসন্দেহে সৃষ্টিকর্তার অপার করুণা। তবে এটি আমাদের জন্য গভীর উদ্বেগের এবং দুঃখের বিষয় যে, গত জুলাই-আগস্ট মাসের ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানকালীন অস্থির সময়ে কেবল মোহাম্মদ আলীই নন, এই জেলায় আরও অনেকেই হতাহতের শিকার হয়েছেন।”
তিনি আরও বলেন, “আমাদের কাছে থাকা প্রাথমিক তথ্য অনুযায়ী, সেই দুর্ভাগ্যজনক সময়ে লালমনিরহাট জেলায় মোট ১২ জন নাগরিক প্রাণ হারিয়েছেন এবং ৪৭ জন আহত হয়েছেন। জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে আমরা প্রতিটি হতাহতের ঘটনা অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে নিয়েছি। নিহতদের শোকসন্তপ্ত পরিবারবর্গ এবং আহত ব্যক্তিবর্গের নিয়মিত খোঁজখবর রাখা হচ্ছে। আমরা জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে তাদের পাশে থাকার এবং সাধ্যমত প্রয়োজনীয় সহযোগিতা পৌঁছে দেওয়ার সর্বাত্মক চেষ্টা করে যাচ্ছি। তাদের এই কঠিন সময়ে আমরা সর্বদা সহমর্মী এবং তাদের সহায়তায় অঙ্গীকারবদ্ধ।”
ঢাকা/এস