ঢাকা     মঙ্গলবার   ৩০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৭ ১৪৩১

ভবের হাটের রঙের মানুষের বিদায়: মাসুম রেজা

মাসুম রেজা || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৩:০২, ২০ ফেব্রুয়ারি ২০২১   আপডেট: ১৮:১২, ২০ ফেব্রুয়ারি ২০২১
ভবের হাটের রঙের মানুষের বিদায়: মাসুম রেজা

বাংলা চলচ্চিত্র আর টিভি নাটক আজ এটিএম শামসুজ্জামানকে হারালো। সিনেমার রুপালি পর্দা এটিএমহীন হয়ে গেল; এক দুঃসহ সংবাদ! তিনি মজা করে বলতেন, ‘মাসুম তোমরা আমারে ভালো মানুষ বানাইছ। সিনেমাতে ভিলেনের অভিনয় করতে করতে সবাই আমারে মন্দ মানুষ বলে জানত, তোমাদের রঙের মানুষ-এর বস্তানি শা’ চরিত্রের মাধ্যমে আমি এক আজগুবি ভালো মানুষে পরিণত হয়েছি।’

সিনেমার একটা সময় গেছে যখন অশ্লীলতা আর নিম্নমানের ছবি তৈরির অভিযোগে এফডিসি প্রায় ছবিশূন্য হয়ে পড়েছিল। তখন অনেকেই টেলিভিশনে কাজ করতে এসেছিলেন। এটিএম ভাই তাঁদের একজন। ‘রঙের মানুষ’ ধারাবাহিকে অভিনয় করে তিনি প্রমাণ করেছিলেন, অভিনয়ে কতটা বহুমুখী দক্ষতা তাঁর আছে। তিনি একবার চোখ দেখাতে ভারতের চেন্নাইয়ে গিয়েছিলেন শঙ্করা নেত্রালয়ে। সেখানে অনেক বাঙালি যান চোখের চিকিৎসার জন্য। এটিএম ভাইকে দেখে তাদেরই একজন ছুটে এসে বলেছিলেন- ‘আপনি এখানে কী করছেন! আপনার রঙের মানুষের কী হবে?’

এটিএম ভাই উত্তর দিয়েছিলেন- ‘রঙের মানুষের বস্তানি শা’ ফকিরান্তি করতে এখানে আসছে। এটা নাটকেরই অংশ। সমস্যা হবে না।’ বলেই তিনি হো হো করে হেসে উঠেছিলেন। ফিরে এসে বলেছিলেন, ‘তোমাদের রঙের মানুষতো খুবই জনপ্রিয়!’

তিনি যে-কথাটা খুব বেশি বলতেন তা হলো, ‘তুমি আর সালাউদ্দিন লাভলু আসলে সিনেমার মানুষ। তোমরা কেন টিভি নিয়ে মেতে আছো!’ একদিন তিনি আমাকে সিনেমার প্রযোজক মতিয়ুর রহমান পানুর কাছে নিয়ে গেলেন। সালাউদ্দিন লাভলুও ছিলেন। এটিএম ভাই পানু ভাইকে বললেন, ‘এরা রঙের মানুষের লোক, এখন সিনেমা বানাবে।’ বলেই দায়িত্ব শেষ করলেন না। একটা গল্প শোনালেন পানু ভাইকে। বললেন, ‘এই হইল তোমার ছবির গল্প।’

পানু ভাই সহাস্যে রাজি হলেন। এরপর এটিএম ভাই আমাকে বললেন, ‘কাল থেকে তুমি আমার বাড়িতে বসে স্ক্রিপ্ট লেখতে শুরু করবা।’ পরদিন সকালে এটিএম ভাইয়ের বাড়িতে গেলাম। তাঁর বৈঠকখানায় তো সোফা চেয়ার নাই! কেবল নরম তক্তপোশ বিছানো- অনেকটা রাজকীয় ভঙ্গী। একেকটা দৃশ্য ভাবনা শেষে সংলাপ লেখার পালা শুরু হলো। আমি লিখি আর এটিএম ভাইকে শোনাই। তিনি আমার শব্দগুলো একটু এদিক-ওদিক করতে বলেন। লিখতে শুরু করার আগে তিনি বলে নিয়েছিলেন; ‘শোনো মাসুম- সিনেমা হইল এমুন একটা জিনিস যেইটা তোমার হাত থেকে বের হবে কিন্তু এর সফলতা থাকবে দর্শকের হাতে। তাই দর্শকদের চমকিত করতে একটা না একটা নতুন কিছু তোমার সিনেমাতে থাকতে হবে। আর সে কারণেই এই সিনেমার নাম দেওয়া হয়েছে ‘মোল্লাবাড়ির বৌ’। এই যে মোল্লাবাড়ির বৌ প্রকৃতি ভালোবাসে, গান ভালোবাসে, তার পিতা বয়াতি- এই বিষয়টাই হলো সম্পূর্ণ নতুন ধারণা।’

আসলেও তাই, এই নতুন ধারণাকে ভিত্তি করে যে ছবি নির্মাণ করলেন সালাউদ্দিন লাভলু, তার সাফল্য আকাশচুম্বি হয়েছিল। বাংলা চলচ্চিত্রে যখন খরা চলছিল তখন ‘মোল্লাবাড়ির বৌ’ দর্শকদের হলে টেনে এনেছিল জোয়ারের মতো। এটিএম ভাইয়ের বৈঠকখানায় বসে এই ছবি লিখতে গিয়ে আমি শিখেছিলাম অনেক কিছু। তাঁর বৈঠকখানা যেন আমার শেখার বিশ্ববিদ্যালয়।

এটিএম ভাই ধারাবাহিকভাবে আমার লেখা লাভলুর পরিচালনায় অনেকগুলো খণ্ড নাটকে অভিনয় করেছেন। কত কত স্মৃতি তার সঙ্গে! তাঁর প্রিয় অভিনেতাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন- হুমায়ুন ফরীদি। চলচ্চিত্রে দুজনেই একই ধারার চরিত্রে অভিনয় করেও তিনি ঈর্ষা নয়, ভালোবাসতেন ফরীদি ভাইকে, পছন্দ করতে তাঁর অভিনয় শৈলী। ফরীদি ভাইয়ের সঙ্গে একটা নাটকে তাঁর অভিনয়ের ইচ্ছা আমাকে জানিয়েছিলেন। সেটা ২০০৪ সালের কথা। আমার দীর্ঘ ধারাবাহিক ‘ভবের হাট’ লিখলাম। দুই ভায়ের ভেতরে দ্বন্দ্বমূলক সম্পর্কের নাটক ছিল সেটা। মারেম খাঁ আর হারেম খাঁ। পরিচালক সালাউদ্দিন লাভলু মারেম খাঁর চরিত্রে এটিএম শামসুজ্জামান আর হারেম খাঁ চরিত্রে হুমায়ুন ফরীদিকে নির্বাচন করলেন। জমে গেল ভবেরহাট। চ্যানেল আই-এ প্রচারিত হতো নাটকটা। তুমুল জনপ্রিয় হয়েছিল সেটি।

এটিএম ভাই ধূমপান করতেন। তাঁর ধূমপান করার ধরন নিয়ে আমরা বেশ হাসাহাসি করতাম। তিনি প্যাকেট থেকে একটা সিগারেট বের করে সেটাকে টিপে টিপে নরম করতেন, আর দোয়া পড়ে ফুঁ দিতেন। এরকম বেশ কয়েকবার ফুঁ দিয়ে তারপর সিগারেটটা ধরাতেন। এক মজার মানুষ ছিলেন তিনি! প্রকৃতই রঙের মানুষ।

তিনি ঢাকার একজন পীরের ভক্ত ছিলেন। একদিন খুব সকালে আমার বাসার কলিংবেল বেজে উঠল। দরজা খুলে দেখি এটিএম ভাই। আমি আকাশ থেকে পড়লাম! তিনি বললেন, ‘এখনই চলো মাসুম, তোমারে একটা গান লিখতে হবে। চলো, তোমার অফিসে বইসা গানটা লেইখা দাও।’ আমি তাঁকে নিয়ে ধানমণ্ডি বত্রিশের অফিসে গেলাম। বসে বসে একটা গান লিখে দিলাম।

আজ এটিএম ভাইয়ের মৃত্যুতে ফেসবুকজুড়ে কেবল শোকের বারতা। প্রত্যেকেই বলছেন- এটিএম ভাইয়ের অভাব অভিনয় জগতে কখনো পূরণ হবে না। জাতীয় চলচ্চিত্র ও একুশে পদকপ্রাপ্ত এই অনবদ্য অভিনয়শিল্পীর মৃত্যুতে আমরা গভীরভাবে শোকাহত। ভবের হাটের রঙের মানুষ- আপনাকে বিদায়। আপনি চির স্মরণীয় হয়ে থাকবেন আমাদের অন্তরে।   
 

ঢাকা/তারা

সম্পর্কিত বিষয়:

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ