ঢাকা     মঙ্গলবার   ৩০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৭ ১৪৩১

‘বেসরকারি টিভি চ্যানেলগুলো ব্যয়বহুল অনুষ্ঠান কম করছে’

আমিনুল ইসলাম শান্ত || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৪:১২, ২৪ এপ্রিল ২০২৩   আপডেট: ১৪:২৬, ২৪ এপ্রিল ২০২৩
‘বেসরকারি টিভি চ্যানেলগুলো ব্যয়বহুল অনুষ্ঠান কম করছে’

আব্দুন নূর তুষার। পেশায় চিকিৎসক। কৈশোরে জাতীয় স্কুল বিতর্ক প্রতিযোগিতা দিয়ে গণমাধ্যমের সঙ্গে সম্পৃক্ত হন। পরে বাংলাদেশ টেলিভিশনে ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান ‘শুভেচ্ছা’ উপস্থাপনা করে তারকাখ্যাতি লাভ করেন। টিভি অনুষ্ঠান ছাড়াও রেডিওতে শো উপস্থাপনা করেছেন আব্দুন নূর তুষার। এগুলোর মধ্যে ‘সং আলাপ’, ‘তুষারপাত’ খুবই জনপ্রিয় ছিল। ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান ও উপস্থাপনার নানা বিষয় নিয়ে রাইজিংবিডির সঙ্গে কথা বলেছেন তিনি। এ আলাপচারিতার গুরুত্বপূর্ণ অংশ তুলে ধরা হলো।

রাইজিংবিডি: নব্বই দশকে ঈদে ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান প্রচার হতো। সেসময় আপনারা কীভাবে প্রস্তুতি নিতেন। আপনার অভিজ্ঞতার আলোকে জানতে চাই।

আব্দুন নূর তুষার: নব্বই দশকে ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান হতো বাংলাদেশ টেলিভিশনে। এনটিভি, একুশে টিভি ছাড়া আর কোনো প্রাইভেট টিভি চ্যানেল ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান তৈরি করে নাই। ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান যা হওয়ার তা মূলত বাংলাদেশ টেলিভিশনে হয়েছে। এখানে কাজের অভিজ্ঞতা ছিল ভিন্ন। কারণ এটি সরকারি টেলিভিশন। সরকারি নিয়মকানুন মেনে অনুষ্ঠান তৈরি করতে হতো। ২০০১ সালের পরে এটিএন বাংলায় নিয়ম করে কিছু ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান নির্মাণ করা হয়েছে। তাও এটা চ্যানেলটির মালিকের আগ্রহের কারণে হয়েছে। ইসমাইল, আনজাম (আনজাম মাসুদ) এ চ্যানেলের জন্য নিয়মিত কিছু ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান নির্মাণ করেছে।

আমি মূলত, বিটিভির জন্য ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান নির্মাণ করেছি। সরকারি নিয়ম মেনে কম বাজেটে আমাকে তা করতে হয়েছে। প্রযোজক বাজেট নিয়ন্ত্রণ করতেন আর আমি তৈরি করতাম কনটেন্ট। অনুষ্ঠানটিতে কী থাকবে, কী থাকবে না সেই কাজটি আমার ছিল। দেখা যেত, টাকা নাই ফুলের তোড়া ভাড়া করে আনতে হতো, কিংবা সোফা নাই সেটাও ভাড়ায় আনা হতো। ওই সময়ে ৭০-৮০ হাজার বা ১ লাখ টাকা বাজেট দিতো। যার কারণে অনেক প্রপস ভাড়া করে আনতে হতো। 

রাইজিংবিডি: নতুন কোনো ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান জনপ্রিয়তা পাচ্ছে না কেন?

আব্দুন নূর তুষার: একটি ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান তৈরি করতে গেলে বড় বাজেট লাগে। এখন অনেক বেসরকারি টিভি চ্যানেল। মালিকানাধীন এসব প্রতিষ্ঠান যেখানে লাভ কম সেখানে বিনিয়োগ করতে চায় না। ধরেন, একটি টিভি নাটক বানাতে খরচ হয় আড়াই লাখ টাকা। সেখানে একটি ম্যাগাজিন অনুষ্ঠানে বানাতে খরচ হয় ১২ লাখ টাকা। দুটোই ১ ঘণ্টার কনটেন্ট। টিভিওয়ালারা ম্যাগাজিন অনুষ্ঠানের ১২ লাখ টাকা দিয়ে ৬টা কনটেন্ট বানাতে পারে এবং দর্শকদের ৬ ঘণ্টা ব্যস্ত রখতে পারে। এর মাঝে বিজ্ঞাপন প্রচার করছে। আর প্রতি মিনিট বিজ্ঞাপনের খরচ একই। এক ঘণ্টার ম্যাগাজিন অনুষ্ঠানে ১৫ মিনিট বিজ্ঞাপন প্রচার করতে পারবে। আর এই টাকা দিয়ে ৬টি কনটেন্ট বানালে ৯০ মিনিট বিজ্ঞাপন প্রচার করতে পারবে। এসব হিসাবের কারণে বেসরকারি টিভি চ্যানেল ব্যয়বহুল অনুষ্ঠান কম তৈরি করে।

রাইজিংবিডি: তাহলে কি বলা যায়- বাজেটের কারণে নতুন ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান তৈরি হচ্ছে না কিংবা জনপ্রিয়তা পাচ্ছে না? 

আব্দুন নূর তুষার: প্রথমত, ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান বানাচ্ছে না। দ্বিতীয়ত, জনপ্রিয়তা পাচ্ছে না কারণ টিভিতে দর্শক এখন আগের চেয়ে কমে গেছে। তৃতীয়ত, ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান বানাতে গেলে উপস্থাপককে একই সঙ্গে উপস্থাপনা ও কনটেন্ট তৈরি করতে হবে। বর্তমান সময়ের অধিকাংশ উপস্থাপক কনটেন্ট মেকার নন। তারা সেটে যান, স্ক্রিপ্ট দেখেন, শট দেন। এখনকার উপস্থাপক নিজের কথা নিজে বলেন না। এটা একটি কারণ বলে আমার মনে হয়। তা ছাড়া উপস্থাপক হয়তো কষ্টও করতে চান না। কারণ বিনিময়ে বেশি পেমেন্ট পাবেন না। সবকিছু মিলিয়ে ব্যবসায়ীক কারণে এই অবস্থা তৈরি হয়েছে। উপস্থাপক একজন তারকার সাক্ষাৎকার নিয়ে যে টাকা পান, একটি ম্যাগাজিন অনুষ্ঠানের জন্য কাছাকাছি পরিমাণের টাকাই পায়। আবার কনটেন্টের মালিকও সে না। তাহলে সে কেন এত পরিশ্রম করবে?

রাইজিংবিডি: ম্যাগাজিন অনুষ্ঠানে উপস্থাপককে কমেডি করতে দেখা যায়, বিষয়টি কীভাবে দেখেন? 

আব্দুন নূর তুষার: হ্যাঁ, ইদানীং উপস্থাপনা করতে গিয়ে অনেকে কমেডি করেন। উপস্থাপক এভাবে কমেডি করতে থাকলে সেটা আর ঠিক ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান থাকে না। বরং সেটা স্ট্যান্ড আপ কমেডি হয়। নিজে হাসানো উপস্থাপকের কাজ না। বরং এমন বিষয়বস্তুকে উপস্থাপন করা যা দেখে মানুষ হাসবে। না হলে এই উপস্থাপক যেখানেই যাবেন লোকে তাকে হাসাতে বলবেন। মানুষ ধরেই নেবেন উনি সবসময় রসিকতা করেন। অতি রসিকতা সম্পন্ন অনুষ্ঠান তৈরি করে ওই উপস্থাপককে মানুষ সিরিয়াসলি নিতে চান না। এজন্য মাঝে মাঝে হাসির অনুষ্ঠান করা যেতে পারে।   

রাইজিংবিডি: টিভি অনুষ্ঠানে কথা বলার সময় উপস্থাপকের কতটা সতর্ক থাকা উচিত?

আব্দুন নূর তুষার: টেলিভিশন সবাই দেখে। বয়স ভেদে টেলিভিশন আলাদা আলাদা না। যার কারণে টেলিভিশনে কিছু বলার সময় খেয়াল রাখা উচিত! কোনো একটা অনুষ্ঠানে বলা হলো- আপনারা ভাইরাল হন। ভাইরাল হওয়া মানেই সফল হওয়া। টেলিভিশনে এই কথা বলাটা ঠিক না। কারণ ইতিবাচক-নেতিবাচক দুটো বিষয়ই ভাইরাল হয়। সুতরাং ভাইরাল হলেই আপনি সফল মানুষ ব্যাপারটা কিন্তু তা না। আপনি কিছু একটা করলেন, আর সেই ভিডিও ছড়িয়ে পড়লো। এতে অনেক মানুষ বিষয়টি জানলো। অনেক লোক জানা মানেই আপনি সফল নন। অনেক লোক জানা মানে হচ্ছে আপনাকে অনেক মানুষ দেখেছেন। আপনাকে অনেক লোক দেখা আর মনে রাখা এক নয়। সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রচুর ভাইরাল বিষয় আছে যেগুলোকে মানুষ সম্মান করে না।         

রাইজিংবিডি: উপস্থাপনায় যারা নতুন তাদের জন্য আপনার কী পরামর্শ থাকবে?

আব্দুন নূর তুষার: মানুষ যাতে তাদের উপস্থাপক হিসেবে মনে রাখেন এমন একটি অবস্থান তৈরি করা। ইন্টারনেটে মানুষ আমাকে আমার অনুষ্ঠান দিয়ে মনে করেন। কেউ বলে আমি শুভেচ্ছার উপস্থাপক, কেউ বলে আমি হরলিক্স জিনিয়াসের উপস্থাপক। আমি সারা জীবনে খুব বেশি অনুষ্ঠান উপস্থাপনা করিনি। আরটিভির জন্য করেছি রোড টু ডেমোক্রেসি। এটা পলিটিক্যাল টক শো হলেও টপ রেটেড ছিল। বিটিভির শুভেচ্ছা, এনটিভির হরলিক্স জিনিয়াস- এসবই টপ রেটেড ছিল। এরকম ভিন্ন ভিন্ন ধরনের অনুষ্ঠান যেমন জয়তু, শুভেচ্ছা, জিনিয়াস, বাংলাদেশ রোড টু ডেমোক্রেসি আর কেউ করে নাই। আর একটা বিষয় খেয়াল করলে দেখবেন, আমার প্রত্যেকটি অনুষ্ঠান ভিন্ন ভিন্ন টপিক নিয়ে তৈরি হয়েছে। এসবের কোনোটা রাজনৈতিক, কোনোটা সেলিব্রেটি, কোনোটা সাক্ষাৎকারমূলক অনুষ্ঠান। আসলে অনুষ্ঠানের প্রতি মনোযোগ দেওয়াটা জরুরি, যাতে মানুষ মনে রাখেন। মানুষ যদি আমাকে ট্রল করে তাও এসব অনুষ্ঠানের নাম দিয়ে ট্রল করেন।

মানুষের জীবনে অর্থের প্রয়োজন আছে। যারা উপস্থাপনা করছেন তাদেরও অর্থের প্রয়োজন আছে। সুতরাং অনেক অনুষ্ঠান তাদের উপস্থাপনা করতে হবে। কিন্তু এত কাজের পাশাপাশি একটা দুইটা অনুষ্ঠান চিন্তা করে করা প্রয়োজন। এই অনুষ্ঠান টাকার জন্য নয়, মানুষ যাতে মনে রাখেন সেজন্য। উপস্থাপনার পাশাপাশি এখন অনেকে অভিনয় করছেন। আসলে একসঙ্গে সব কিছু করতে গেলে মানুষ কোনোটাই মনে রাখেন না।
 

তারা//

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ