ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

গ্রামে বসে ডলার আয় করছেন ইউটিউবার মিতু 

মিফতাউল জান্নাতি সিনথিয়া || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৬:১৭, ৩ ডিসেম্বর ২০২০   আপডেট: ১৬:২১, ৩ ডিসেম্বর ২০২০
গ্রামে বসে ডলার আয় করছেন ইউটিউবার মিতু 

মিতু ইসলাম। জন্মস্থান ও বসাবাস চাঁদপুর জেলার পল্লিগ্রামে। ১০ম শ্রেণিতে পড়াশোনা অবস্থায় বিয়ে হয়ে যায় তার। সেই সূত্রে বলা যায় মিতুর বেড়ে ওঠা ও কৈশোর কেটেছে শ্বশুর বাড়িতে। 

সমাজের চিরাচয়িত নিয়ম অনুযায়ী বিয়ের পর আর পড়াশোনা করা হয়নি তার। অন্যসব গ্রাম্য বধূদের মতোই জীবন কাটছিল তার। স্বামী ও এক সন্তান নিয়ে যৌথ পরিবারে ব্যস্ত সময় পার করছেন মিতু।

পড়াশোনা থেকে দীর্ঘ বিরিতির পর ২০১৭ সালে পরিবারের সবার অনুমতিক্রমে পুনরায় পড়াশোনা করার সুযোগ হয় মিতুর। বর্তমানে তিনি উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চমাধ্যমিকে দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী। পড়াশোনার    পাশাপাশি তিনি এখন কাজ করছেন নারী ইউটিউবার হিসেবে। তার ইউটিউব চ্যানেলের নাম ‘Mitus Nakshi Kantha’।

কোনো রকম প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ছাড়াই ফেসবুক গ্রুপ (ডিজিটাল স্কিল ফর বাংলাদেশ) ডিএসবি থেকেই তার ইউটিউবার হওয়ার স্বপ্ন। গ্রুপে অন্যদের পোস্ট পড়ার মাধ্যমেই শিখতে পারেন ইউটিউবের খুঁটিনাটি। নেই কোনো দামি যন্ত্রপাতি ও পর্যাপ্ত ইন্টারনেটের সুবিধা। খাতার উপর পেন্সিল দিয়ে  নিজস্ব চিন্তাধারার নকশা দিয়ে ফুটিয়ে তুলেছেন নকশিকাঁথার অসাধারণ সব ভিডিও। এ যেন ঢাল-তলোয়ার ছাড়া যুদ্ধে নামার মতো সংগ্রামী জীবন মিতুর। 

সম্প্রতি রাইজিংবিডিতে তিনি তার জীবনের গল্প বলেছেন। সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন রাইজিংবিডির উদ্যোক্তা ডেস্কের সহ-সম্পাদক মিফতাউল জান্নাতি সিনথিয়া।

রাইজিংবিডি: ইউটিউব চ্যানেলের শুরুটা কীভাবে ছিল?

মিতু: ফেসবুক ব্যবহার করাই যেখানে বারণ ছিল, সেখানে ইউটিউবে কাজ করা ঘুমিয়ে স্বপ্ন দেখার মতো। স্বপ্ন দেখতাম আমি, যা জানি তা যদি ভিডিওর মধ্যে তুলে ধরতে পারতাম! ভাবনাটা কখনো বাস্তবে রূপ দিতে পারবো ভাবিনি। কারণ, আমি ইংরেজিতে দুর্বল ছিলাম। ভিডিও এডিট থেকে শুরু করে কিছুই আমার জানা ছিল না। তাই এ নিয়ে আশাকরিনি। রাজিব আহমেদ স্যারের সার্চ ইংলিশ নামের ফেসবুক গ্রুপে অনুশীলনের পর ইংরেজিতে উন্নতি করতে পারি। 

আমার উন্নতি দেখে রাজিব স্যার একদিন বললেন, ‘আশাকরি আপনি একদিন জাতীয় পর্যায়ের কেউ হবেন’। তখন থেকেই মনের মধ্যে একটা অনুপ্রেরণা কাজ করতো। তারপর অনলাইন থেকে ইউটিউব নিয়ে জানার চেষ্টা করি। যেহেতু ততদিনে ইংলিশে দুর্বলতা কেটেছে, তাই ইংলিশ আর্টিকেল পড়তেও সমস্যা হয়নি। আর এভাবেই ইউটিউব নিয়ে প্রাথমিকভাবে শিখতে পারি।  

তবে ইউটিউবকে আমার কাছে তখন অনেক বড় কিছু মনে হতো। এমনকি চ্যানেল ওপেন করার পরও আমি ভিডিও আপলোড দিয়ে ভাবতাম আমার ভিডিও কে দেখবে? ১০০ ভিউজ মানেই তখন আমার কাছে বিশাল ব্যাপার ছিল। কারণ আমার ভালো ক্যামেরা নেই, ল্যাপটপ নেই এমনকি ক্যামেরা স্ট্যান্ডও নেই। তবে এগুলো আমি চাইলে পেতাম। কিন্তু আমার সবসময়ই একটা ইচ্ছা যে, আমি যা করবো নিজে করবো। তখন লাভ হলেও আমার লস হলেও আমার। 

কোনো উন্নতি না করলেও কেউ কিছু বলবে না। কিন্তু টাকা খরচ করে ঠকে গেলে নিজেরই খারাপ লাগবে। তাই শুরুতে আমি পানির বোতল কেটে ক্যামেরা স্ট্যান্ডের কাজে ব্যবহার করি। কখনো মোবাইল জানালার গ্রিলের সঙ্গে, কখনো ওয়ারড্রবের কর্নারে রেখে ভিডিও করতাম।

যেহেতু আমার স্বামী ঘুমিয়ে গেলে ভিডিও করতাম, তাই সে ক্যামেরা স্ট্যান্ডের অভাব বুঝতে পারেনি। হঠাৎ যখন একদিন তার নজরে পড়ে, তখন সে একটা ক্যামেরা স্ট্যান্ড নিয়ে আসে। এই ছাড়া এই পর্যন্ত আমার ইউটিউবে কাজ করার জন্য আলাদা কিছুই কেনা হয়নি। এমনকি আমি এখনো ডিজাইন আঁকি আমার ক্লাসে লেখার খাতাতে শুধু একটি পেন্সিলের সাহায্যে।

রাইজিংবিডি: গ্রাম থেকে ইউটিউবে কাজ করতে গিয়ে নেটে সমস্যা হয় না?  

মিতু: পল্লিগ্রামে আমার বসবাস।  ইউটিউব ভিডিও আপলোড দিতে পর্যাপ্ত নেট প্রয়োজন হয়। তাই বেশিরভাগ সময়ই নেট সমস্যায় পড়তে হয়। এমনও হয়েছে, একটা ভিডিওর মেগাবাইটের পরিমাণ একটু বেশি হলে দুই দিনেও আপলোড দিতে পারিনি। তিন দিনের মতো সময় লেগেছে। 

আমি যখন গর্ভকালীন আমাদের বাড়িতে ছিলাম, সেখানে ঘরে কোনো নেটই পাওয়া যেত না। তখন ভিডিও এডিট করে সব সিস্টেম সেট করে স্বামীকে দিয়ে বাইরে পাঠাতাম আপলোডের জন্য। মাঝে মাঝে দেখা যেত সারাদিন শেষে ঘরে এসে মোবাইল হাতে দিলে দেখতাম ৪০ শতাংশও হয়নি। এইভাবে দুই-তিন দিনও লেগে যেত।

রাইজিংবিডি: নকশা নিয়ে কাজ শুরু করেছিলেন কেন?  

মিতু: আমি যখন ইউটিউব চ্যানেল ওপেন করি, তখন ভাবনা ছিল একাধিক বিষয় নিয়ে কাজ করবো। তাই প্রথমে, নকশীকাঁথা ডিজাইন, এমব্রয়ডারি, ফ্রুট কার্ভিং, রান্না এসব মাথায় আসে। তাই চ্যানেলের নাম দিয়ে ছিলাম মিতুস ওয়ার্ল্ড অল ইন ওয়ান। কিন্তু পরবর্তী সময়ে যখন দেখি আমার নকশীকাঁথা ডিজাইনের ভিউজ বেশি হচ্ছে ও একটি নকশীকাঁথা ডিজাইন চার লাখ ছাড়িয়েছে, তখন ভাবলাম যে নকশীকাঁথা ডিজাইন নিয়েই কাজ করা উচিত। তাই আসিফ ভাইয়ের পরামর্শে নাম পরিবর্তন করে ‘Mitus Nakshi Kantha’ রেখেছি। আমি নকশীকাঁথা ডিজাইন নিয়েই এখন ভিডিও বানাচ্ছি, তবে সামনে এমব্রয়ডারি নিয়েও কাজ করবো, ভিডিও বানাবো।

রাইজিংবিডি: আপনার ইউটিউব চ্যানেলের সাবস্ক্রাইবার কতজন?  

মিতু: বর্তমানে ‘Mitus Nakshi Kantha’ চ্যানেলের সাবসক্রাইবার প্রায় ১০ হাজার। প্রথম পেমেন্ট পেয়েছি ১০০ ডলার।

রাইজিংবিডি: ইউটিউব নিয়ে কাজ করতে গিয়ে কাদের সহযোগিতা বেশি ছিল?

মিতু: শুরুতেই বলবো রাজিব স্যারের কথা। কারণ, স্যারের মতো শিক্ষক ও তার শিক্ষা না পেলে আমি ইউটিউবে আসার কথা ভাবতেই পারতাম না। তারপর হলো নুরুন্নবী হাসান ভাইয়া। তিনি কাজ শুরু করতে অনেক উৎসাহিত করেছেন। সবাই ঘুমিয়ে পড়ার পর আমি আমার বিছানায় বসে রাত জেগে ভিডিও বানাতাম। আমার স্বামী সাপোর্ট না করে বিরক্ত হলে আমার পক্ষে কাজ চালিয়ে যাওয়া সম্ভব হতো না। আসিফ হাসান ভাইয়ার কাছ থেকেও পেয়েছিলাম পর্যাপ্ত সযোগিতা। আমার মাও আমাকে অনেক মানসিক সাপোর্ট দিয়েছেন। তাই এই মানুষগুলোর কাছে আমি চির কৃতজ্ঞ।

রাইজিংবিডি: আপনার চ্যানেলের সফলতার কথা জানতে চাই।

মিতু: আমার ইউটিউব চ্যানেল চালু করার উদ্যোগ গ্রহন করি ২০১৮ সালে। তারপর নিয়মিত কাজ শুরু করি ২০১৯ সালের মাঝামাঝিতে। গুগল থেকে অনুমোদন ও মনিটাইজেশন পেয়ে নিজের অ্যাকাউন্টে পেমেন্ট পেয়েছি। প্রথম ধাপ সফলতার সঙ্গে পার করতে পেরেছি। আশাকরি নিয়মিত কাজ করে এভাবেই সফলতার সঙ্গে এগিয়ে যাবো।

রাইজিংবিডি: আপনার চ্যানেলে কেমন সাড়া পাচ্ছেন?  

মিতু: বর্তমানে আমার চ্যানেলের সাবস্ক্রাইবারের সংখ্যা ১০ হাজার ছাড়িয়েছে। আশাকরি নিয়মিত কাজ করলে আরও অনেক সাড়া পাবো।

রাইজিংবিডি: আপনার চ্যানেল নিয়ে পরিকল্পনা কী?

মিতু: বর্তমানে নকশীকাঁথা ডিজাইন নিয়ে কাজ করছি। তাই আমার প্ল্যান হলো নকশীকাঁথা নিয়ে স্টার্টআপ বিজনেস শুরু করা। ভবিষ্যতে নিজেকে একজন সফল ইউটিউবার, উদ্যোক্তা ও নারী হিসেবে দেখতে চাই। আমার ভবিষ্যৎ ইচ্ছা, যেসব নারী আমার মতো পড়ালেখা থেকে ঝরে পড়েছে, যারা কিছু করতে চায় কিন্তু পারছে না, যারা সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত, তাদের নিয়ে কাজ করা। আমার ব্যবসার মাধ্যমে তাদের কর্মস্থল তৈরি করা।

রাইজিংবিডি: নতুন ইউটিউবারদের জন্য আপনার পরামর্শ কী?  

মিতু: নতুন কেউ এই পেশায় আসতে চাইলে আমি তাদের বলবো, যেকোনো একটা কাজ নিয়ে মনস্থির করুন ও সেই ব্যাপারে জ্ঞানার্জন করুন। ইউটিউব সম্পর্কে জানুন, শিখুন তারপর কাজ শুরু করুন। তবে কেউ যদি ভাবেন, তার ভালো ক্যামেরা নেই, ল্যাপটপ নেই, তিনি কীভাবে কাজ শুরু করবেন? তাদের বলবো, মোবাইল থাকলে শুধু তা দিয়েই শুরু করুন। তারপর ধীরে ধীরে সব কিছু ম্যানেজ করুন। নিয়মিত কাজ করুন, সফলতা আসবেই।

ঢাকা/মাহি

সম্পর্কিত বিষয়:

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়