ঢাকা     মঙ্গলবার   ০৭ মে ২০২৪ ||  বৈশাখ ২৪ ১৪৩১

ডেঙ্গু: সংশ্লিষ্টদের ভাবনা 

মেসবাহ য়াযাদ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ২০:১৯, ২৭ জুলাই ২০২৩   আপডেট: ২০:২১, ২৭ জুলাই ২০২৩
ডেঙ্গু: সংশ্লিষ্টদের ভাবনা 

চলতি বছরে এখন পর্যন্ত (২৬ জুলাই) দেশজুড়ে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে মৃতের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২১৫ জনে। একই সময়ে ডেঙ্গুতে আক্রান্তের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪০ হাজার ৩৪১ জনে। কোনোভাবেই ডেঙ্গু সংক্রমণ ও মৃত্যু কমানো যাচ্ছে না। হাসপাতালে রোগীদের ভিড়ে চিকিৎসাসেবা দিতে হিমশিম খাচ্ছেন চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীরা।

চলমান ডেঙ্গুর প্রকোপ মোকাবিলায় মশা নিধনের পাশাপাশি ডেঙ্গুর ভ্যাকসিন প্রয়োগ এবং এ বিষয়ে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য নীতিনির্ধারকদের তাগিদ দিয়েছেন ভাইরোলজিস্টরা। তারা বলছেন, বর্তমান বিশ্বে দুটি ডেঙ্গু ভ্যাকসিন আছে। এগুলো ইতোমধ্যে বিশ্বের প্রায় ২০টির মতো দেশে অনুমোদন পেয়েছে। ভ্যাকসিনগুলোর ডেঙ্গু প্রতিরোধ সক্ষমতা ৮০ শতাংশের ওপরে। ভ্যাকসিনপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের ৯০ শতাংশকেই ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হলেও হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার প্রয়োজন পড়ে না।

ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীতে ঠাসা রাজধানীর মুগদা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল। এ অবস্থায় হাসপাতালটিতে নতুন কোনো ডেঙ্গু রোগী না যাওয়ার পরামর্শ দিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। সংস্থাটি বলছে, ডেঙ্গু রোগীর চাপ সামলাতে হিমশিম খাচ্ছে মুগদা হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। এমন পরিস্থিতিতে রাজধানীর মুগদা হাসপাতালে আপাতত আর রোগী ভর্তি করা সম্ভব নয়।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (পরিকল্পনা ও উন্নয়ন) আহমেদুল কবীর বলেছেন, মুগদা হাসপাতালে ম্যাক্সিমাম লিমিটও ক্রস হয়েছে। এ অবস্থায় রোগীরা যেন মুগদা হাসপাতাল ভর্তি না হন। 

তিনি বলেন, আমরা ডিএনসিসি হাসপাতালে ঘুরেছি, রোগীদের সঙ্গে কথা বলেছি, তাদের প্রয়োজনীয় সাপোর্ট দেওয়ার চেষ্টা করছি। ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীদের জন্য আরও ২ হাজার ৫০০টি শয্যা প্রস্তুত করে রাখা আছে। বর্তমানে প্রতিদিন ১ হাজার ২০০ রোগী ভর্তি হচ্ছে, সেই সঙ্গে ছুটিও হচ্ছে ৯০০ থেকে ১ হাজারের মতো। তার মানে স্থিতিশীল থাকছে ২০০ থেকে ৩০০ শয্যা।

আহমেদুল কবীর বলেন, সবগুলো হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেছেন, রোগীদের জন্য নতুন করে আরও ২০০ থেকে ৩০০ শয্যা বৃদ্ধি করতে হবে। মুগদা হাসপাতালকে আমরা নতুন করে শয্যা বৃদ্ধির জন্য বলিনি। কারণ, ওইখানে ৬ শতাধিক রোগী ভর্তি আছে। ডিএনসিসি হাসপাতালকে বলেছি, ৮০০টির মতো শয্যা সেখানে প্রস্তুত করতে। কুর্মিটোলা হাসপাতালে আমরা আরও ১০০ বেড প্রস্তুত করার জন্য বলেছি। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজকে আরও ১৫০টি এবং কুয়েত মৈত্রী হাসপাতালে ১০০টি শয্যা বাড়ানোর জন্য বলা হয়েছে।

ডেঙ্গু সংক্রমণের এমন ঊর্ধ্বগতিতে শঙ্কা প্রকাশ করে এ কর্মকর্তা বলেন, রোগী যদি অতিমাত্রায় বাড়তে থাকে, তাহলে সেটি সামাল দেওয়া কষ্টকর হবে। একজন চিকিৎসকের ১০ জন রোগী ম্যানেজ করার কথা, তাদের ২০ থেকে ৩০ জন রোগী ম্যানেজ করতে হচ্ছে। সবচেয়ে জরুরি হলো, যেকোনো মূল্যে ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা কমানো।

এডিস মশা নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে ডেঙ্গু পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখা কঠিন হবে, উল্লেখ করে অধ্যাপক ডা. আহমেদুল কবীর বলেন, শুধু ঢাকা নয়, সারা দেশেই বর্তমানে ডেঙ্গু ছড়িয়েছে। এখন ঢাকা সিটির পাশাপাশি ঢাকার বাইরে রোগীর সংখ্যা বেশি। এডিস মশা যদি আমরা নিয়ন্ত্রণ করতে না পারি, ডেঙ্গু পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখা খুব কঠিন হবে।

রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইডিসিআর) উপদেষ্টা ও সংক্রামক রোগ বিশেষজ্ঞ ডা. মোশতাক হোসেন বলেছেন, মহামারি ঘোষণা করার ক্ষেত্রে আমাদের নীতিনির্ধারকদের মধ্যে অজানা ভয় আছে, স্পর্শকাতরতা আছে। এগুলো পরিবর্তনের জন্য আমাদের সময় লাগবে। কাজেই ডেঙ্গু মহামারি হয়েছে কি না, এটার জন্য আমাদের নীতিনির্ধারকদের বিব্রত করার কোনো প্রয়োজন নেই। এটা রোগতাত্ত্বিকদের বিশ্লেষণের বিষয়। রোগতাত্ত্বিকরা বলেছেন, আমরা মহামারিতে ঢুকেছি। কাজেই এটা নিয়ে বিতর্ক করার কোনো অবকাশ নেই।

ডা. মোশতাক বলেন, ডেঙ্গু এখন মহামারি। মহামারি মানে হাজার হাজার মানুষ রাস্তায় পড়ে আছে, বিষয়টি এমন নয়। আমাদের গণমাধ্যমকর্মীরা অনেক সময় কর্তৃপক্ষকে প্রশ্ন করেন, এটাকে মহামারি হিসেবে ঘোষণা করবেন কবে? জরুরি জনস্বাস্থ্যের বাংলাদেশে ঘোষণা করার কোনো ইতিহাস নেই এবং এর প্রয়োজন খুব একটা আছে বলে মনে করি না।

স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদের (স্বাচিপ) সভাপতি ডা. জামাল উদ্দিন চৌধুরী বলেছেন, ডেঙ্গু নিধন ও ডেঙ্গুর আক্রমণ থেকে বাঁচার জন্য যেসব নির্দেশনা আছে, সেগুলো না মানলে জরিমানাসহ শাস্তির বিধান আরও বাড়ানো উচিত। যখনই শাস্তির দিকে যাবেন, তখনই কিছু কাজ হবে। শাস্তির কোনো বিকল্প নেই।

ডা. জামাল উদ্দিন চৌধুরী বলেন, সচেতনতা বৃদ্ধির কাজটা গণমাধ্যমের মাধ্যমে বেশ হচ্ছে। আমি বেশকিছু জায়গায় দেখেছি, কোনোকিছুতে শৃঙ্খলা আনার জন্য আইনের প্রয়োগটা হলো আসল। আইনের প্রয়োগ হলেই মানুষ খারাপ কাজ বা বেআইনি কাজ থেকে নিজেকে বিরত রাখে। তাই, আরও বেশি করে জরিমানা করা উচিত। 

বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) যুগ্ম সম্পাদক স্থপতি ইকবাল হাবিব বলেন, পুলিশের ডাম্পিং করা গাড়িগুলো ডেঙ্গু প্রজননের সবচেয়ে বড় প্রজননস্থল। ঢাকার প্রায় সব থানার সামনা-সামনি গাড়ি ডাম্পিং করা রয়েছে। একটু করে কেরোসিন ঢাললে সেখানে ঠিক হয়ে যায়। সম্প্রতি বিষয়টি নিয়ে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে আলাপ হলে পুলিশ বলেছে, আমরা ইমিডিয়েটলি ব্যবস্থা নিচ্ছি। তার মানে, তারা অনেক দেরি করে ফেলেছে। এতে ডেঙ্গুতে যা ক্ষতি হওয়ার, হয়ে গেছে।

তিনি বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষেত্রগুলো ডেঙ্গুর মতো জায়গায় অত্যন্ত সুস্পষ্ট। গত বছর বা তার আগের বছর ডেঙ্গুর যে পিক পয়েন্ট (নির্দিষ্ট মাস) দেখেছি, এবার অনেক আগেই জানুয়ারিতে ডেঙ্গু দেখলাম। এর মধ্যে গত দুই মাসে প্রায় ৩০ হাজার লোক ডেঙ্গু আক্রান্ত দেখলাম। ২০২২ সালে এই ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা ৪১ হাজার ছিল। আমরা ইতোমধ্যে প্রায় ৪১ হাজার টাচ করে ফেলেছি। অবস্থাটা যদি সবাই এখনো না বোঝেন, তাহলে এটাকে মহামারি বা অতিমারি যাই বলি, তা দিয়ে ঢাকা যাবে না।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক কবিরুল বাশার বলেন, চলতি বছরের মে মাসে যখন বৃষ্টি শুরু হলো, তখন এডিস মশার ঘনত্ব বাড়তে শুরু করে। এরপর জুন, জুলাইয়ে গিয়ে ব্যাপক ডেঙ্গু রোগী পাওয়া যায়। জ্যামিতিক হারে এডিস মশা বেড়ে গেছে। এখান জুলাইয়ের শেষ। আগামী দুই মাস (আগস্ট ও সেপ্টেম্বর) আমাদের জন্য বেশ শঙ্কার। এবার মৃত্যুতে এবং ডেঙ্গু আক্রান্তের হার বাংলাদেশের ইতিহাস ছাড়িয়ে যাবে।

বাংলাদেশে ২০০০ সালে ডেঙ্গু শুরু হয়েছে, জানিয়ে কবিরুল বাশার বলেন, প্রতি বছর ডেঙ্গু জ্বরে মানুষ আক্রান্ত হচ্ছেন। এবার লক্ষ করছি সবচেয়ে খারাপ অবস্থা। বাংলাদেশের ইতিহাসে যত ডেঙ্গু হয়েছে, দেখবেন আগস্ট ও সেপ্টেম্বরে। ২০২১ সাল পর্যন্ত এ দুটি মাসের একটি মাসে ডেঙ্গু পিকে ছিল। ২০২১ সালে দেখেছি, অক্টোবর মাস পর্যন্ত ডেঙ্গু ছিল। এবার দেখলাম নভেম্বর, ডিসেম্বর পার হয়ে চলতি বছরের জানুয়ারি পর্যন্ত ডেঙ্গু চলে আসছে। এ জানুয়ারিতেও ৫০০ মতো ডেঙ্গু রোগী ছিল। এটা বাংলাদেশের ইতিহাসে ছিল না।

মেয়া/রফিক    

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ