ঢাকা     শুক্রবার   ১৭ মে ২০২৪ ||  জ্যৈষ্ঠ ৩ ১৪৩১

কৃষির উন্নতি হয়েছে, কৃষকের নয় : শাইখ সিরাজ

তানজিনা ইভা || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৪:৫৯, ২ মার্চ ২০১৪   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
কৃষির উন্নতি হয়েছে, কৃষকের নয় : শাইখ সিরাজ

সাক্ষাৎকার নিচ্ছেন তানজিনা ইভা। ছবি: মেহেদী জামান

দেশে কৃষির উন্নতি হয়েছে। খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতাও এসেছে। কিন্তু কৃষকের ভাগ্যের উন্নয়ন হয়নি। তারা ফসলের ন্যায্যমূল্য পাচ্ছেন না। কথাগুলো বলেছেন, শাইখ সিরাজ। যিনি ভাবেন কৃষি ও কৃষক নিয়ে। তিনি একাধারে ইমপ্রেস টেলিফিল্ম-চ্যানেল আইয়ের পরিচালক। চ্যানেলটির বার্তা বিভাগের প্রধানের দায়িত্বও তার।

সম্প্রতি এই গণমাধ্যম-ব্যক্তিত্ব রাইজিংবিডিকে একটি বিশেষ সাক্ষাৎকার দিয়েছেন। এতে দেশের কৃষি খাতের সমস্যা, সম্ভাবনা এবং করণীয় বিষয়ে তার ভাবনা উঠে এসেছে। সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন তানজিনা ইভা

রাইজিংবিডি : দেশের কৃষি এবং কৃষকদের নিয়ে কাজ করার ভাবনা কীভাবে এল আপনার?

শাইখ সিরাজ : ১৯৭৫ সালের মাঝামাঝি সময় থেকে টেলিভিশনের সঙ্গে জড়িত। যখন কাজ শুরু করি, তখন আজকের মতো অবস্থা ছিল না। সেই সময়ে দিনের চারটা-পাঁচটার সময় খেলাধুলা, প্রান্তরঙ্গ, যুবমেলা- এসব প্রচারিত হতো। কিন্তু খুব একটা জনপ্রিয় ছিল না অনুষ্ঠানগুলো। সত্তরের শেষের দিকে টেলিভিশনে একটি পলিসি প্রোগ্রাম শুরু হলো। লক্ষ্য, এর মাধ্যমে মানুষকে উদ্বুদ্ধ করা। দেশের শিল্পগুলোকে তুলে ধরার পাশাপাশি সার্বিকভাবে শিল্পায়নে কীভাবে এগিয়ে যেতে পারে বাংলাদেশ- এসব তুলে ধরা। তখন থেকেই মনে হয়, টেলিভিশনে বিনোদন থাকবে; কিন্তু এর পাশাপাশি শিক্ষাসহ নানা বিষয়েও তথ্য দেওয়া প্রয়োজন। জীবনমান উন্নয়নে এভাবে টেলিভিশনকে ব্যবহার করার একটি চিন্তা তখনই মাথায় আসে। টেলিভিশনকে সম্প্রসারণমুখী করতে এ ধরনের অনুষ্ঠান শুরু করি। শুরুর দিকে কাজের কথা নামে একটি অনুষ্ঠান ছিল টেলিভিশনে। যা ছিল খুবই অবহেলিত। আমি ‘শিল্পায়নে বাংলাদেশ’ অনুষ্ঠানের পর ‘কাজের কথা’ অনুষ্ঠানের সঙ্গে জড়িত হই কৃষি এবং কৃষকদের উন্নয়নের কথা ভেবে। পরবর্তী সময়ে অনুষ্ঠানটি ‘আমার দেশ’ নামে শুরু করলাম। ছিয়াশিতে এসে এই অনুষ্ঠানের নাম হয় ‘মাটি ও মানুষ’। এর উদ্দেশ্য, কৃষকদের নানা রকম উৎপাদনমুখী কাজ সম্পর্কে ধারণা দেওয়া এবং সাধারণ মানুষের কাছে টেলিভিশনকে নিয়ে যাওয়া। এর মাধ্যমে আমি আরো চেয়েছিলাম- কৃষি শুধু ধান আর পাট নয়; পুকুরে মাছ চাষ, সবজি চাষ, হাঁস-মুরগি পালন- এসব কিছুই আসতে পারে কৃষির আওতায়। আর কৃষক মানে শুধু গ্রামের কৃষক নন, একজন শিক্ষিত শহুরে তরুণ, একজন গৃহিণীও হতে পারেন কৃষক।

রাইজিংবিডি : সাম্প্রতিক রাজনৈতিক অস্থিরতায় কৃষকদের যে ক্ষতি হলো তা পোষানোর উপায় কী?

শাইখ সিরাজ : ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে কৃষকদের। ২০১৪-১৫ অর্থবছরে বাজেটের আগে চারটি জেলায় গিয়ে অন্তত ২০ হাজার কৃষকের সঙ্গে কথা বলেছি। তারা বলেছেন, জমিতে ফসল রয়েছে ঠিকই কিন্তু বিক্রি করতে পারেননি। আমি মনে করি, কৃষকদের যে ক্ষতি হয়েছে তা কাটিয়ে উঠতে তাদের উৎপাদিত ফসলের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করতে হবে সরকারকে।

রাইজিংবিডি : ফসলের ন্যায্য মূল্য কীভাবে নিশ্চিত করা যেতে পারে?

শাইখ সিরাজ : বাংলাদেশের আশি ভাগ কৃষক ঋণ নিয়ে চাষাবাদ করেন। ঋণের টাকা ঠিকমতো দিতে না পারলে পরবর্তী ফসল চাষের জন্য টাকা (ঋণ) পান না। এজন্য ফসল মাঠে থাকতে থাকতেই একজন কৃষককে ঋণ পরিশোধ করতে হয়। ফলে তাৎক্ষণিকভাবে ফসলটা বিক্রি করে দেন একজন ঋণগ্রস্ত কৃষক। আর তখন লাভের অংশটা চলে যায় মধ্যস্বত্বভোগীদের পকেটে। এ পরিস্থিতিতে যদি কৃষক তার উৎপাদিত ফসল মজুত করে রাখতে পারতেন এবং দাম বাড়লে বিক্রি করতে পারতেন কিংবা অন্য কোনোভাবে পণ্যের ন্যায্যমূল্য পেতেন, তাহলেই তার পক্ষে লাভের মুখ দেখা সম্ভব। আর এটা নিশ্চিত করতেই রাষ্ট্রের যথাযথ নীতি থাকতে হবে। সরকার সরাসরি ব্যবসা করবে না। কিন্তু বেসরকারি উদ্যোক্তাদের মাধ্যমে এর সমাধান করতে পারে। অর্থাৎ কৃষকের উৎপাদিত ফসল প্রিজারভেশন (সংরক্ষণ) ও প্রক্রিয়াজাতকরণে প্রয়োজন কার্যকর নীতি। রাষ্ট্র পৃষ্ঠপোষকতা করতে পারে শিল্পভিত্তিক নানা প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে। সরকার এই কাজগুলো করতে পারে বেসরকারি উদ্যোক্তাদের মাধ্যমে। আমি মনে করি, এ ক্ষেত্রে বেসরকারি উদ্যোক্তাদেরকে মোটিভেট (উদ্বুদ্ধ) করতে ব্যর্থ হয়েছে সরকার। ব্যবসায়ীরা মনে করেন, ব্যবসা মানে পোশাকশিল্প। যদি ব্যবসায়ীদের উদ্বুদ্ধ করা যেত, তাহলেই কৃষি সমস্যার সমাধান হতো। ব্যবসায়ীরা চান সঠিক পলিসি। আর সরকারের উচিত এই পলিসিটার নীতি নির্ধারণ করা।

রাইজিংবিডি : সরকার প্রতিবছর কৃষির জন্য যে বাজেট নির্ধারণ করে তা যথেষ্ট কি না?

শাইখ সিরাজ : সরকার প্রতিবছর কৃষি খাতে ভর্তুকি রেখেছে বলেই আজ কৃষির সম্প্রসারণ হয়েছে। তবে তা যথেষ্ট নয়। এ ভর্তুকি সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বাড়ানো প্রয়োজন। ওপেন মার্কেটের কথা বলা হচ্ছে। যেখানে বিদেশি কোনো পণ্যের মূল্যের চেয়ে দেশীয় একই পণ্যের মূল্য কম হতে পারে। অথচ আমার দেশে ওই পণ্যের মূল্য বিদেশিটার চেয়ে বেশি। এটা পলিসি হতে পারে না। সাধারণ মানুষ তো কম দামেরটাই কিনবেন। পলিসি এমন হতে হবে, যেন দেশি পণ্যটাই কেনেন দেশের মানুষ। যেমন- ভারতের পেঁয়াজ যখন বাংলাদেশ ঢোকে তখন তার দাম আর বাংলাদেশে উৎপাদিত পেঁয়াজের দাম এক হবে না। কিছুটা কম হবে দেশিটার। আর এসব নিয়ন্ত্রণে সরকারকে কাজ করতে হবে।

রাইজিংবিডি : আমাদের দেশে কিছু বিদেশি ফসল উৎপাদন করা হচ্ছে- এটাকে আপনি কীভাবে দেখছেন?

শাইখ সিরাজ : কৃষকের চোখ-কান খোলা। আগে যে জমিতে ধান চাষ করতেন এখন সেই জমিতেই তারা লাউ চাষ করেন, শাকসবজি চাষ করেন। এখন প্রশ্ন হলো- কেন করছেন? কারণ, কৃষক ধানের ন্যায্যমূল্য পান না। এজন্য যেটাতে লাভ হচ্ছে, সেই ফসলটা উৎপাদন করছেন কৃষক।

রাইজিংবিডি: এটা কি আমাদের জন্য হুমকিস্বরূপ নয়?

শাইখ সিরাজ : অবশ্যই। এটা আমাদের খাদ্যনিরাপত্তার জন্য হুমকি, রাষ্ট্রের জন্যও হুমকি। প্রাথমিকভাবে মনে হচ্ছে, এটা লাভের। কিন্তু এর সুদূরপ্রসারী ফল ভালো নয়। রাষ্ট্র কৃষকের ধানের সঠিক মূল্য নিশ্চিত করতে ব্যর্থ হয়েছে বলেই কৃষক অন্য ফসল আবাদ করছেন। খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা ধরে রাখতে কৃষককে ধান চাষে ধরে রাখতে হবে। বেশি করে ভর্তুকি দিতে হবে। তাদের ফসলের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করতে হবে।

রাইজিংবিডি : কৃষির উন্নয়নে তরুণদের ভূমিকা কী হতে পারে?

শাইখ সিরাজ : শুধু তরুণ প্রজন্ম নয়, অন্যদেরও ধারণা কৃষিকাজ শুধু কৃষকেরই। আমি মনে করি, একটা বিষয় সবারই জানা উচিত- এতগুলো মানুষের খাদ্য কীভাবে আসছে। কোন কারণে প্রাকৃতিক উদ্যোগ সৃষ্টি হলে দেশে দুর্ভিক্ষ সৃষ্টি হয়ে যাবে।

রাইজিংবিডি : কৃষকদের উন্নয়নে আপনার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কী?

শাইখ সিরাজ : আমি চাই, কৃষকরা সংগঠিত হোক। সেটা হতে হবে অরাজনৈতিকভাবে। যার মাধ্যমে কৃষকরা তাদের ন্যায্য দাবিগুলো আদায় করতে পারবেন। বাংলাদেশে সব মানুষের সংগঠন আছে। শুধু নেই কৃষকের। এটা খুব প্রয়োজন।

মূল্যবান সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।

শাইখ সিরাজ : ধন্যবাদ আপনাকে এবং রাইজিংবিডি পরিবারের সবাইকে ।

 

রাইজিংবিডি / ইভা / সন্তোষ / ক.কর্মকার / কে. শাহীন

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়