ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ০২ মে ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৯ ১৪৩১

আদর্শ শিক্ষকের জন্য প্রত্যাশা

যতীন সরকার || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৮:৩৫, ৫ অক্টোবর ২০২০   আপডেট: ১১:৫৮, ৫ অক্টোবর ২০২০
আদর্শ শিক্ষকের জন্য প্রত্যাশা

আমার সৌভাগ্য যে আমি মাস্টার হতে চেয়েছিলাম, মাস্টারই হতে পেরেছি। ছেলেবেলাতেই কী করে জানি কিছু আদর্শের পোকা আমার মাথায় ঢুকে গিয়েছিল। তবুও, স্কুলে পড়ার সময়েই রবীন্দ্রনাথের ‘একরাত্রি’ গল্পটি পড়ে সেই আদর্শগুলোকে সামলে রাখার প্রয়োজনটাও উপলব্ধি করেছিলাম। যদিও জীবিকার ক্ষেত্রে মাস্টার হওয়াটাই আমার জীবনের লক্ষ্য ছিল, তবু ‘একরাত্রি’ গল্পটি থেকেই শিখেছিলাম যে আমি যে-সকল আদর্শের কথা ভাবি তা ক্লাসরুমে ছাত্রদের কাছে প্রচার করা যাবে না। ক্লাসে আদর্শের প্রচার করলে আমার মাস্টারি টিকবে না।

কাজেই মাস্টারি করতে এসে আমি মাস্টারিই করেছি। সুতরাং কোনো হেডমাস্টার বা প্রিন্সিপাল আমার উপর রাগ করতে পারেন নি। তবে ব্যক্তিগতভাবে এতে আমি সন্তুষ্ট ছিলাম না। কী করে এর ভেতর দিয়েই আমার লালিত আদর্শগুলোকে ছাত্রদের মধ্যে চারিয়ে দেওয়া যায় তার ফাঁকফোকর খুঁজে নিয়েছি। এর কারণ, ছেলেবেলায় এমন কিছু মাস্টারের কাছে আমি পড়েছি যারা সত্যিকারের আদর্শ মাস্টার হিলেন। সে-সময়ে, অন্তত আমাদের পাড়া গাঁয়ে, মাস্টারের আদর্শ বজায় রাখার মতো অবস্থা কিছুটা হলেও বিদ্যমান ছিল। আমাদের গাঁয়ের স্কুলে আমি জয়চন্দ্র রায়ের মতো শিক্ষক পেয়েছি। তিনি ক্লাসে আমাদের প্রায় সব বিষয়েই পড়াতেন। সেই পাকিস্তান আমলের গোড়ার দিকে গ্রামের স্কুলগুলোর অবস্থা ছিল খুবই করুণ। হিন্দু শিক্ষকদের অনেকেই দেশত্যাগ করেছেন। মুসলমানরা তখন সহজেই অন্য চাকরি পেয়ে যেতেন, গাঁয়ের স্কুলের শিক্ষিত মাস্টার হতে চাইতেন না।

এ-রকমই একটি স্কুল, নেত্রকোনার একটি গ্রামে আশুজিয়া হাই স্কুলের ছাত্র ছিলাম আমি। এবং সৌভাগ্যক্রমে, তখনও, বৃদ্ধ জয়চন্দ্র রায় সেই স্কুলের শিক্ষক ছিলেন। তিনি ছিলেন আন্ডার গ্রাজুয়েট, কিন্তু খুবই বিদ্বান ছিলেন। স্কুল-অন্ত প্রাণ। এই স্কুলটা, বলতে গেলে তিনিই প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। স্কুলের প্রতিটি ছাত্রের জন্য তিনি এমন দরদ অনুভব করতেন যে সময় পেলেই ছাত্রদের বাড়ি গিয়ে তাদের পড়া দেখিয়ে দিতেন এবং তাদের সব খোঁজ-খবর নিতেন। শুধু তাই নয়, নিজে যদিও ছিলেন একজন দরিদ্র মানুষ, তাঁর ঘর ছিল খড়ের ছাউনি, তবুও ঝড়ের রাত্রিতে নিজের ঘরটির চেয়ে স্কুল ঘরটির জন্য

বেশি উদ্বেগ বোধ করতেন। ক্লাসে পড়ানোর সময় এমন সব ঘটনার বর্ণনা দিতেন যা আমাদের মনে একটা আদর্শবোধ তৈরি করত। যেমন তিনি ধর্ম নিয়ে বলতেন, ‘ধর্ম জিনিসটা বাইরের লোক দেখানো কোনো বিষয় নয়, কোনো আচার-অনুষ্ঠান নয়। ধর্ম হচ্ছে অন্তরের ব্যাপার।’

এ-রকমই আরও একজন শিক্ষককে পেয়েছিলাম। তাঁর নাম কুমুদ চন্দ্র ভট্টাচার্য। তিনি আমাদের ইংরেজি পড়াতেন। ইংরেজি পড়াতে গিয়ে তিনি ‘অমৃতবাজার’ পত্রিকা নিয়ে ক্লাসরুমে ঢুকতেন। ঢুকেই হাঁক ছাড়তেন- Translate into Bengali. পত্রিকার পাতা থেকেই বিভিন্ন খবর বা মন্তব্য প্রতিবেদনের বঙ্গানুবাদ করতে শেখাতেন। শুধু বঙ্গানুবাদ নয়, সব খবর বা মন্তব্য প্রতিবেদনের পটভূমিসহ পুরো রাজনীতিটা আমাদের সামনে তুলে ধরতেন। তাতে আমাদের পরীক্ষা পাসের ব্যাপারে কোনো ব্যাঘাত ঘটত না, কিন্তু আমাদের আদর্শের জগৎটা বিস্তৃতি লাভ করতো।

যাই হোক, ছাত্রজীবনেই আমি বুঝে নিয়েছিলাম যে আদর্শ শিক্ষক হতে হলে একটু কৌশল করে চলতে হয়। তাই ছাত্রজীবনের শেষে শিক্ষক হয়েও ক্লাসে ব্যাকরণের কথাই বলেছি বটে, কিন্তু মাঝে মাঝে এর ফাঁকে এমন কিছু কথা বলেছি যাতে অন্তত বুদ্ধিমান ছাত্ররা নড়েচড়ে বসেছে। ক্লাসের বাইরে এসে তারা সিলেবাস-বহির্ভূত নানা বিষয় সম্পর্কে জানতে চেয়েছে। তখন সেইসব ছাত্রকে নিয়ে ক্লাসের বাইরে পাঠচক্র গড়ে তুলেছি। এর মধ্য দিয়েই হেডমাস্টার বা প্রিন্সিপালকে খুশি রেখেও কীভাবে ছাত্রদের মধ্যে আদর্শবাদের বিস্তার ঘটিয়ে আদর্শ শিক্ষকের দায়িত্ব পালন করা যায় (এবং স্কুল বা কলেজের মাস্টারের চাকরিটা বজায় রেখে ব্যক্তিক ও পারিবারিক জীবন কষ্টেসৃষ্টে হলেও চালিয়ে নেওয়া যায়) তার চেষ্টা আমি করেছি। কতটুকু সফল হতে পেরেছি জানি না। তবে আজ জীবনের শেষ প্রান্তে এসে একটা আত্মতৃপ্তি যে অনুভব করি তাতে সন্দেহ নেই। কিন্তু আমি এ-ও বুঝি যে, এ-রকম আত্মতৃপ্তিতে বুঁদ হয়ে থাকলে এটি আত্মপ্রতারণা ছাড়া আর কিছুই হবে না। কেন একজন মাস্টারকে সত্য কথা বলতে গিয়েও নানা ছল ছুঁতার আশ্রয় নিতে হবে? কেন কলঙ্কিনী রাধিকার মতো ধোঁয়ার ছলে কাঁদতে হবে? সকল আদর্শবাদী শিক্ষকের পক্ষেই কি এমন কৌশল করে চলা সম্ভব? তারচেয়েও বড় কথা, ক’জন আদর্শবাদী মানুষ মাস্টারিকে জীবিকা রূপে গ্রহণ করতে চান? কিংবা ক’জন মানুষ পারেন মাস্টারিকে নিজের জন্য আদর্শ জীবিকা রূপে গ্রহণ করতে? দীর্ঘকাল ধরে মাস্টারি করতে করতে এ-রকম অনেক প্রশ্নই আমার মনে বারবার হানা দিয়েছে।

মাস্টারিকে যে আদর্শ জীবিকারূপে গ্রহণ করা খুবই কঠিন, তার কারণটি আমাদের সামাজিক মনোবিন্যাসের মধ্যেই নিহিত আছে। মাস্টারদের প্রতি এক ধরনের ধোঁয়াটে সম্মান আমাদের সমাজের মানুষ দেখায় বটে, কিন্তু প্রায় সবাই ‘আহা বেচারা’ বলে মাস্টারদের প্রতি মনে মনে করুণাই পোষণ করে কেবল। অন্য চাকরি বা পেশার বদলে তাদের ছেলেটি মাস্টার হোক, এ-রকম খুব কম মা-বাবাই চান। পরিবার পরিজন বা অন্য সব শুভানুধ্যায়ীদেরও একই মনোভঙ্গি।

আমি যখন বি-এ পাস করি, তখন আমাদের গ্রামাঞ্চলে বিএ পাস লোকের সংখ্যা খুব বেশি ছিল না। গ্রামের যে-কোনো লোকের সঙ্গে দেখা হলেই বলত, ‘তুমি বিএ পাস করেছ শুনে খুবই খুশি হয়েছি। তা, এখন কী করছ?’
আমি যেই বলতাম যে ‘মাস্টারি করছি’, তখনই আমার এই শুভাকাঙ্ক্ষীদের মুখ কালো হয়ে যেতে দেখেছি। অনেকেই জিজ্ঞেস করত, ‘মাস্টারি করছ কেন? একটা কাজটাজ পেলে না?’

তার মানে মাস্টারিটা কোনো কাজের মধ্যেই পড়ে না। আমি স্কুলে মাস্টারি করতে এসে আমারই বয়সী একজন বিএসসি পাস মাস্টারকে পেয়েছিলাম। সব সময় তিনি মনমরা হয়ে থাকতেন। এখানে-ওখানে চাকরির জন্য দরখাস্ত পাঠাতেন,আর কোনো সাড়া না পেয়ে আরো বেশি মনমরা হয়ে পড়তেন। মাস্টারির কাজটা তাঁর এত অপছন্দের কেন?

আমার এ-রকম প্রশ্নে তিনি একেবারে ফোঁস করে উঠতেন- ‘মাস্টারি কি কোনো কাজ হলো নাকি?... জানেন, মাস্টারি করি বলে আমার কাছে কোনো বাবা তার মেয়ে বিয়ে দিতে রাজি হয় না!’

এই যেখানে অবস্থা, সমাজে যেখানে মাস্টারদের প্রতি এ-রকম দৃষ্টিভঙ্গি, সেখানে কোনো মানুষ কেবল আদর্শের জন্য মাস্টারি করতে আসবে জীবিকার অন্য সব অবলম্বনকে ছেড়ে দিয়ে তেমনটি হতেই পারে না। ‘বিদ্যাদান’-এর মতো একটি ওজনদার শব্দ আমাদের ভাষায় চালু আছে। যদিও ‘বিদ্যাদান’ বলে আসলে কিছুই নেই। যা আছে তা হলো বিদ্যার ক্রয়-বিক্রয়। এক সময় হয়তো মাস্টাররা বিদ্যা বিক্রি করতেন, এখন তা-ও করেন না। এখন আর মাস্টারদের কাছে বিদ্যা ক্রয় করতেও কেউ আসে না। আসে পরীক্ষার নাম্বার কিনে নিতে। এখন আর কোনো বিদ্যার্থী বা শিক্ষার্থীও নেই, আছে কেবল পরীক্ষার্থী। আরও স্পষ্ট করে বললে বলতে হয়: পরীক্ষার্থীও এখন নেই, এখন সবাই নাম্বারার্থী। যে-মাস্টার ছাত্রকে পরীক্ষায় বেশি নাম্বার পাইয়ে দিতে পারবেন, তার কদর বা মর্যাদা তত বেশি। কাজেই কোচিং সেন্টার খুলেই হোক, কিংবা বাড়িতে টিউশনি করেই হোক, ছাত্রের জন্য বেশি বেশি নাম্বারের ব্যবস্থা করে দিতে পারেন যে-মাস্টার, জীবিকার ক্ষেত্রে তারই হয় বাড়বাড়ন্ত।

এ-রকম পরিস্থিতিতে আদর্শ শিক্ষকের স্থান কোথাও নেই। কেউ যদি আদর্শ শিক্ষক হওয়ার অভীপ্সা নিয়ে স্কুল-কলেজে প্রবেশ করেনও, তিনি নিশ্চিতভাবেই হতাশ হবেন। তবু বর্তমান কালটি এমন দুর্বিনীত হলেও শুভ সুন্দর ভবিষ্যৎ কালের প্রত্যাশা না করে পারেন না কোনো শুভবুদ্ধিসম্পন্ন সুন্দর মনের মানুষ। তেমন মানুষেরা অবশ্যই আদর্শ শিক্ষকের প্রয়োজন মর্মে মর্মে উপলব্ধি করেন ও করবেন। সেই প্রয়োজন মেটানোর জন্যই প্রয়োজন আদর্শ শিক্ষকের উপযোগী একটা আদর্শ শিক্ষাব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা। না, যে-সমাজ ব্যবস্থায় আমরা বসবাস করছি সেই সমাজব্যবস্থাটি অক্ষুণ্ন রেখে প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থায় কোনো পরিবর্তন কেউ ইচ্ছা করলেই আনতে পারবেন না। কোনো কমিটি বা কমিশন বসিয়ে যে শিক্ষাব্যবস্থায় কাঙ্ক্ষিত পরিবর্তনটি আনা যায় না, সে-অভিজ্ঞতা ইতোমধ্যেই আমরা লাভ করে ফেলেছি। শিক্ষাব্যবস্থায় প্রকৃত পরিবর্তন ঘটাতে চাইলে পুরো সমাজ ব্যবস্থাটিরই খোল-নলচে পাল্টে ফেলতে হবে। অর্থাৎ ঘটাতে হবে সমাজবিপ্লব।

স্কুল-কলেজের মাস্টারদের দিয়ে নিশ্চয়ই সমাজবিপ্লব ঘটানো যাবে না। তবে মাস্টাররা অবশ্যই কাঙ্ক্ষিত সমাজবিপ্লবের অনুঘটক হতে পারেন। ‘একরাত্রি’ গল্পের নায়ক সে-রকম অনুঘটকই হতে চেয়েছিল। কিন্তু সে একা একাই কাজটি করতে চেয়েছিল বলে তাকে ব্যর্থ হতে হয়েছিল। আদর্শের পোকা যাদের মাথায় কিলবিল করে তাদের একা থাকলে চলবে না। তাদের খুঁজে বের করতে হবে এ-রকম পোকা কার কার মাথায় আছে। তাদের সকলকে নিয়ে জোট বাঁধতে হবে। শুধু জোট বাঁধলেই হবে না। সেই জোটকে বিজ্ঞানসম্মত পন্থায় আন্দোলনে নামতে হবে। সেই আন্দোলনে অন্যদেরও শামিল করে নিয়ে এগিয়ে যেতে পারলেই এক সময় বিপ্লবী শক্তির অভ্যুদয় ঘটবে। দুঃখ এই, এ-রকম জোট আজও তৈরি হলো না।

মাস্টারদের যে জোট নেই, তা নয়। বাহারি নামের অনেক শিক্ষক সমিতি বা ফেডারেশনেই স্কুল-কলেজের মাস্টারদের আমরা জোটবদ্ধ হতে দেখি। আমিও মাস্টারি করতে গিয়ে এ-রকম জোটের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিলাম। কিন্তু বেদনার সঙ্গে লক্ষ্য করেছি যে, মাস্টারদের এ-সব জোট বা সমিতি বা ফেডারেশনগুলো নিজেদের মাইনে বা পদমর্যাদা বাড়ানোর বাইরে অন্য কিছু নিয়ে মাথা ঘামায় না। সমাজব্যবস্থা বদলাবার কথা দূরে থাক, শিক্ষাব্যবস্থার ব্যাপারেও কিছু মামুলি বুলির উদ্গার ঘটানো ছাড়া মাস্টারদের এইসব জোট আর কিছুই করে না। আমার মাস্টারি জীবনের শেষ পর্যায়ে ‘বাংলাদেশ কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি’ নামে শিক্ষকদের একটি সমিতি গড়ে উঠেছিল। সে-সমিতির আদর্শ-উদ্দেশ্য রূপে শিক্ষাব্যবস্থাসহ সমাজব্যবস্থার বৈপ্লবিক পরিবর্তনের জন্য আন্দোলনের কথা বলা হয়েছিল। প্রচণ্ড উৎসাহ নিয়ে, আগেরকার সংগঠন ছেড়ে, নবগঠিত এই সমিতিটির সঙ্গে আমি সংশ্লিষ্ট হয়েছিলাম। কিন্তু সে-উৎসাহ খুব যে একটা কাজে এসেছে, তেমন নয়। পরাজিতই হতে হয়েছে আমাকে। তবুও বারবার পরাজয়ের পর ভরসা রাখি জোটবদ্ধ আন্দোলন-সংগ্রামের ওপরই। এ ছাড়া অন্য কোনো উপায় তো দেখি না।

লেখক: শিক্ষাবিদ, প্রাবন্ধিক

ঢাকা/তারা

সম্পর্কিত বিষয়:

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়