ঢাকা     শনিবার   ০৪ মে ২০২৪ ||  বৈশাখ ২১ ১৪৩১

আফগানিস্তানে তালেবানের উত্থান, ভারত-বাংলাদেশের সংকট 

জব্বার আল নাঈম || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৮:৫২, ২৮ আগস্ট ২০২১  
আফগানিস্তানে তালেবানের উত্থান, ভারত-বাংলাদেশের সংকট 

সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর আফগানিস্তানে অনেকগুলো রাজনৈতিক ও ইসলামী দলের জন্ম হয়ছে। আফগানিস্তানের ৩৪টি প্রদেশের মধ্যে রয়েছে পশতুন, তাজিক, হাজারা, উজবেক, আইমাক, তুর্কমেন, বেলুচসহ অন্যান্য জাতিগোষ্ঠী। এদের মত ও পথ আলাদা; চিন্তার ধরন, জীবন ও যাপনে রয়েছে ভিন্নতা। কথা ও কর্মে রয়েছে পার্থক্য, একেক প্রদেশে একেক নিয়মের প্রচলন। সব মিলিয়ে তাদের মধ্যে কোনো ঐক্য নেই, কেবল ধর্ম ছাড়া।

২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর টুইন টাওয়ারে সন্ত্রাসী হামলার প্রতিবাদে যুক্তরাষ্ট্র আক্রমণ করে আফগানিস্তান, ক্ষমতা থেকে উৎখাত হয় তালেবান। ২০০৪ সালে মার্কিন সরকারের সমর্থনে লেখা হয় নতুন সংবিধান, যার নিয়ন্ত্রণে চালু হয়— রাষ্ট্রপতিভিত্তিক গণতান্ত্রিক সরকারব্যবস্থা। এসব মেনে নেয়নি তালেবানরা। মার্কিনিদের প্রতিরোধে শুরু হয় গেরিলা যুদ্ধ, মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধ, কূটনৈতিক যুদ্ধ।

তালেবানরাও পিছিয়ে থাকতে চায়নি কূটনৈতিক যুদ্ধে। একক পাকিস্তানের ওপর ভরসা না রেখে মোল্লা বারাদার হাত বাড়ান ইরান, চীন, রাশিয়া ও তুরস্কের দিকে। এর আগে ২০১০ সালে গ্রেফতার হওয়া মোল্লা আবদুল গনি বারাদারকে ২০১৮ সালে ট্রাম্পের অনুরোধে মুক্তি দিতে বাধ্য হয় পাকিস্তান। বারাদার উঠে বসেন দোহার বিমানে। তিনি সমন্বয়ের টেবিলে আনেন গেরিলা, মনস্তাত্ত্বিক ও কূটনৈতিক পরিকল্পনা। যার ফলে ২০২১ সালের আগস্টে সমঝোতার ভিত্তিতে কাবুল ছাড়ার ঘোষণা দেয় বর্তমান মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। এ ঘটনায় ভয় পেয়েছিল পাকিস্তান, হেসেছিল ভারত, কৌশল খুঁজেছিল চীন, রাজনীতি করেছিল তুরস্ক, নীরব দর্শকের ভূমিকায় ছিল ইরান, আর কোনো প্রতিক্রিয়া ছিল না বাংলাদেশের।

০২
কাবুল দখলের পর সরকার গঠনের পরিকল্পনা দীর্ঘ ছকে ফেলে খুবই ধীরস্থিরভাবে অগ্রসর হন তালেবান  নেতা আবদুল গনি বারাদার ও হাইবাতুল্লাহ আখুনজাদা। তারা বৈশ্বিক বন্ধুত্ব চায়। মুখপাত্র জাবিহউল্লাহ মুজাহিদের উদার উচ্চারণ, ‘কারো প্রতি ইসলামিক এমিরেটের শত্রুতা বা বৈরিতা নেই৷ বৈরিতার অবসান হয়েছে এবং আমরা শান্তিপূর্ণভাবে বসবাস করতে চাই৷ আমরা কোন অভ্যন্তরীণ বা বহিরাগত শত্রু চাই না’।

এই উচ্চারণে কতটা উদার কিংবা কৌশল লুকিয়ে আছে তা পরখ করার আগেই পাক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান শুভেচ্ছার মালায় বরণ করলেন তাদের। বললেন, ‘আফগানিস্তানে দাসত্বের শেকল ভেঙেছে তালেবান’। এই সুন্দর কথা আসলে অতটা সুন্দর না হলেও এর মূল অনেক দূর পর্যন্ত বিস্তৃত। কারণ, ভারতের সঙ্গে তালেবান পূর্ববর্তী আফগান সরকারের সুসম্পর্ক নষ্ট হওয়ার পরিকল্পনার বাস্তবায়ন। তালেবানরাও কয়েক কদম এগিয়ে বলে, ‘আফগানিস্তানের ৩০ লাখ শরণার্থীকে আশ্রয় দেয়ায় পাকিস্তানকে ধন্যবাদ’।

নরেন্দ্র মোদি আপোসের বন্দনা না করে গাইলেন, ‘সন্ত্রাসের ওপর ভিত্তি করে একটি সাম্রাজ্য হয়তো কিছু সময়ের জন্য আধিপত্য বিস্তার করতে পারে, তবে তার অস্তিত্ব কখনো স্থায়ী হতে পারে না।’ এমন বলার পেছনে কারণ রয়েছে। ভারত দীর্ঘমেয়াদি প্রকল্পে প্রায় ৩০০ কোটি ডলার বিনিয়োগ করেছিল আফগানিস্তানে। কাবুলে আফগান পার্লামেন্ট বানাতে ভারত খরচ করেছিল ৯ কোটি ডলার। যার উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে ছিলেন ভারত সরকার প্রধান নরেন্দ্র মোদী। কাবুল, কান্দাহার, গজনি, মাজহর-ই-শরিফ ও হেরাতের প্রায় ২১৮ কি.মি. রাস্তা সংস্কারও করেছে ভারতের বর্ডার রোড অর্গানাইজেশন। জরঞ্জ-দেলারাম নামের সড়ক দিয়ে ইরানের চাবাহার বন্দর ব্যবহারের পরিকল্পনা ছিল দিল্লির। এসব যখন হচ্ছিল পাকিস্তানিরা দেখেছে কীভাবে দখল হয়ে গেল অতি স্নেহের আফগানিস্তান।

এর মানে এই নয়, আফগানিস্তান নিজের শরীরের দিকে নজর রাখত না। তারা তা রাখতো খুব সচেতনভাবে। কারণ, আফগানরা জাতিতে যোদ্ধা। স্বাধীনচেতা, বহুগোত্রে বিভক্ত আফগানরা কাউকেই স্থায়ী শত্রু বা মিত্র হিসেবে মানে না। প্রথমে রুশ ও পরে মার্কিনিদের অভিজ্ঞতা থেকেই সেটা স্পষ্ট৷ আফগানিস্তানের রাজনীতিতে নাক গলানোর আগে চীন-পাকিস্তান দুই দেশেরই সেটা মনে রাখা উচিত। তবে, পাকিস্তান সেখানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ও প্রভাব বিস্তার করবে ‘হাক্কানি নেটওয়ার্ক’ নামক সংগঠনটির মাধ্যমে। এর মূল নেতা ছিলেন জালালউদ্দিন হাক্কানি। বর্তমানে দলের দায়িত্বে ছেলে অনিস হাক্কানি এবং ভাই সিরাজউদ্দিন হাক্কানি। এদের সঙ্গে সমঝোতা ছাড়া তালেবান সরকারের আফগানিস্তানে টিকে থাকাও হবে অসম্ভব। হতে পারে হাক্কানি নেটওয়ার্ক পাকিস্তানের এজেন্ট বাস্তবায়নকারী।

একই সূত্রে অগ্রসর হচ্ছে জনবহুল রাষ্ট্র চীন। উইঘুর নিয়ে বিশ্বরাজনীতিতে তারা আছে কিছুটা দ্বিধায়। আফগানিস্তানের পূর্ব প্রান্তে পাকিস্তান, উত্তর-পূর্বে ক্ষুদ্রতম সীমান্ত ওয়াখান। চীনের সঙ্গে ওয়াখান করিডর নামক সীমান্ত কৌশলগতভাবে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। চীনের উইঘুর মুসলিম-অধ্যুষিত অঞ্চলের সঙ্গে এবং চীন-পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডর সংযোগের পথ। এই যোগাযোগ নেটওয়ার্ক কারাকোরাম হাইওয়ে নামে পরিচিত এবং চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভের (বিআরআই) অংশ। উইঘুরের কাছাকাছি তালেবরা যেন ঘেঁষতে না পারে, তাই চীনও চায় বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সমন্বয়ে গঠিত হোক আফগানিস্তান সরকার।

০৩
আফগানিস্তানের সঙ্গে সীমান্ত নেই ভারতের। অনেকটা বাংলাদেশের মতোই৷ বাংলাদেশ থেকে আফগানিস্তানের দূরত্ব প্রায় আড়াই হাজার কিলোমিটার। গত পঞ্চাশ বছরে নেই কোনো বাণিজ্যিক সম্পর্কও। সেই হিসেবে বাংলাদেশে আফগানভীতি থাকার কথাও নয়। ভারতের সঙ্গে সীমানা না থাকার পরও ভারতের আছে তালেবান-ভীতি। কারণ তালেবানদের সঙ্গে নতুনভাবে যুক্ত হয়েছে তুরস্ক-ইরান-পাকিস্তান-চীন জোট। তাই নাক গলাতে হচ্ছে দিল্লির। তালেবানরা ১৯৯৯ সালে এয়ার ইন্ডিয়ার বিমান ছিনতাইয়ের ঘটনায় ছিনতাইকারীদের সহযোগিতা করেছিল এখনো মনে করে ভারত৷ অন্যদিকে বুরহানউদ্দিন রব্বানী-আহমেদ শাহ মাসুদের নর্দার্ন অ্যালায়েন্সের সঙ্গে ঐতিহাসিক মিত্রতা রয়েছে তাদের, তালেবানের সঙ্গে যাদের আবার শত্রুতার সম্পর্ক৷ তালেবান সরকারকে স্বীকৃতি দেয়া কিংবা না দেয়া নিয়ে ভারতের সামনে অপেক্ষা করছে চ্যালেঞ্জ। এদিকে তালেবানের সঙ্গে কাজ করার ইঙ্গিত দিয়েছে চীন, রাশিয়া, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, তুরস্ক, ইরান, ফ্রান্স ও পাকিস্তান।

চীনের প্রভাবে দক্ষিণ এশিয়ায় কোণঠাসা নরেন্দ্র মোদী সরকার। লাদাখ সীমান্ত নিয়ে আছে চরম দ্বন্দ্ব। চীন-ভীতি কাটাতে সেখানে মোতায়েন করা হয়েছে ৫০ হাজার সৈন্য। পাকিস্তান-চীন জোট সামাল দিতে রীতিমতো হাপিত্যেশ মোদী-অমিত শাহ জুটির। এখন তালেবানের উত্থানে বাড়ছে ভয়, থেমে থাকবে না লস্কর-ই তৈয়বার মতো জঙ্গি সংগঠন। দলিত শ্রেণির মানুষের অধিকার আদায় ও মুসলমানদের সম্মান রক্ষার্থে থেমে থাকবে না দেওবন্দি আলেম সমাজ। তবে, বুদ্ধিমান মোদী সরকার সেই তুরি কাজে লাগিয়ে ক্ষমতায় আসতে চাইবেন তৃতীয়বারের মতো। তালেবান-ভীতির আরেক কারণ হলো কাশ্মির ইস্যু। মোদী-শাহ জুটি কাশ্মিরের স্বায়ত্তশাসন কেড়ে নিয়ে শান্ত থাকেনি। বঞ্চিত রেখেছে কাশ্মিরকে রাজ্য হওয়া থেকে। ভয় হচ্ছে, পাকিস্তানি তালেবানদের সঙ্গে আফগান তালেবানরাও কাশ্মির ইস্যুতে নাক গলালে সুযোগ পাবে ভারতের স্বাধীনতাকামী নাগাল্যান্ড, মণিপুর, অরুণাচল প্রদেশ, মিজোরাম ও নাগালিম। কারণ তারা বহুদিন ধরে স্বাধীনতার লড়াই করে যাচ্ছে। 

আফগানিস্তানে তালেবানদের একক আধিপত্য চায় না বিশ্বরাজনীতির তুমুল স্ট্রাইকার রিসেফ তাইয়েফ এরদোয়ান। এরকম হলে অস্ত্র ও প্রযুক্তি বিক্রি করতে সমস্যা হবে জ্ঞাতি ভাইদের কাছে। কমে যাবে মূল্যায়ন। ইরানের সুপ্রিম লিডার আলি খামেনেয়ী রাজনীতির মাঠে সবচেয়ে অভিজ্ঞ একজন। কোনোভাবেই চাইবে না হেরে যেতে দাবা খেলায় কিংবা খোরাসান বাহিনীর মুখোমুখি হতে। কাল্পনিক খোরাসান বর্তমান ইরানের উত্তরপূর্ব অঞ্চল, প্রায় সমগ্র আফগানিস্তান, দক্ষিণ তুর্কমেনিস্তান, তাজিকিস্তান ও উজবেকিস্তানের এক বিস্তীর্ণ ভূমি। খোরাসান বাহিনীর ভীতি আছে সিরিয়া ও ইসরায়েলের। মূলত ‘ডিল অব দ্য সেঞ্চুরি’ রূপকল্পে ‘গ্রেট ইসরায়েল’ ঠেকাতেই খোরাসান বাহিনীর আগমন। তখন হাসবে সৌদি আরব ও যুক্তরাষ্ট্র। শোনা যায়, খোরাসান বাহিনী গঠিত হয়েছে মূলত তালেবান, আল-কায়েদা ও তেহরিক-ই-ইনসাফ সদস্যদের সমন্বয়ে। যাদের মূল আবার আইএস। তাই বলে উজবেক ও তাজিকরা আধুনিক আফগানিস্তানের প্রতিষ্ঠাতা আহমদ শাহ দুররানীর বংশধর ও পশতুন মোল্লা আবদুল গণি বারদারকে সমর্থন করতে পারে না। এর ফলে বৈধতা পেতে পারে খোরাসান বাহিনী। এই বাহিনী-ভীতি শুধু যে ইরান, ইরাক, উজবেকিস্তান, তাজিকস্তান, তুরস্ক বলয়ে সীমাবদ্ধ তা নয়। উত্তাপ এসে লাগবে চীন ও ভারত সাম্রাজ্যে।

আফগানিস্তানে ভারতের শেষ ভরসা ছিল নর্দার্ন অ্যালায়েন্সের টাইগার আহমদ শাহ মাসুদের ছেলের তালেবান প্রতিরোধ দেখা। শোনা যায় পালিয়ে যাওয়ার পর তাকে সমর্থন করেছেন বালখ প্রদেশের লৌহমানব উজবেক বংশোদ্ভূত আবদুল রশিদ দোস্তাম। সমর্থন করেছেন বালখ প্রদেশের সাবেক গভর্নর ও তাজিক বংশোদ্ভূত আতা মোহাম্মদ নূর। নূর ছিলেন আফগানিস্তানের শ্রেষ্ঠ ধনী ব্যক্তি। মুক্ত থাকলে আহমদ মাসুদের প্রতিরোধে সমর্থন দিতেন হেরাত প্রদেশের তালেবানবিরোধী কমান্ডারখ্যাত ইসমাইল খান। অথচ তিনি রয়েছেন তালেবানের হাতে বন্দি। সেই আশায় শেষ পেরেক বসাতে চাইছেন সিআইএ'র প্রধান বার্নস ও তালেবান বারদার বৈঠকে। সেখানে জানানো হয়েছে পঞ্জাশির নেতা আহমদ মাসুদ বিদেশি অস্ত্র, রসদ ও সৈন্যবাহিনীর অভাবে তালেবান প্রতিরোধ থেকে সরে এসেছেন। 

তালেবানের সঙ্গে সমন্বয় করলে সরকারে রাখতে হবে সিংহপূত্র আহমদ মাসুদকে। এ কারণেই আফগানিস্তান রাষ্ট্রে কৌশল প্রয়োগে চীন-পাকিস্তান-ভারত যেন মরিয়া। ভারত সবচেয়ে বেশি মরিয়া। কারণ, বিনিয়োগের তিনশ কোটি ডলার। বাণিজ্যরুট করতে না পারা। জঙ্গি আতঙ্ক। অভ্যন্তরীণ পাঁচ প্রদেশের বিভাজন হুমকি। আঞ্চলিক রাজনীতিতে চীন ও পাকিস্তানের পোক্ত অবস্থান। সব মিলিয়ে সরল অঙ্ক ছেড়ে গরল অঙ্কের দিকে ধাবিত হচ্ছে প্রতিবেশী ভারত। বাংলাদেশেরও উচিত ভেবে-চিন্তে তালেবান সরকার গঠিত আফগানিস্তানের দিকে অগ্রসর হওয়া।

লেখক : কবি ও কথাসাহিত্যিক
 

ঢাকা/তারা

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়