ঢাকা     রোববার   ১৯ মে ২০২৪ ||  জ্যৈষ্ঠ ৫ ১৪৩১

মানসিক স্বাস্থ্যের তত্ত্ব-তালাশ প্রয়োজন

জোবাইদা নাসরীন || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৪:৫৯, ১৬ ফেব্রুয়ারি ২০২২   আপডেট: ১৫:১৩, ১৬ ফেব্রুয়ারি ২০২২
মানসিক স্বাস্থ্যের তত্ত্ব-তালাশ প্রয়োজন

কয়েক বছর ধরে আত্মহত্যা নিয়ে বেশ আলোচনা হচ্ছে। বিশেষ করে ফেইসবুক লাইভে এসে একজন ব্যবসায়ীর আত্মহত্যার পর এটি অনেকটাই সামনে চলে আসে। তবে গত দুই বছর ধরেই এ বিষয়ে কম-বেশি আলোচনা হয়েছে।

বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্য থেকে জানা যায় দেশের বিশ্ববিদ্যালয়সহ উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ২০২১ সালে ১০১ জন শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছেন। আঁচল ফাউন্ডেশনের গবেষণায় পাওয়া গেছে এসব তথ্য। গবেষণা থেকে আরও জানা যায়- আত্মহত্যাকারীদের ৬১ শতাংশের বেশি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। আর আত্মহত্যার প্রবণতা ছাত্রীদের চেয়ে ছাত্রদের বেশি। ( ২৯ জানুয়ারী ২০২২, দৈনিক প্রথম আলো) 

হঠাৎ করে পরিসংখ্যানটি অনেক এগিয়ে যাওয়ার কারণ আগে আত্মহত্যা করলেও সেটি নিয়ে বেশি কথাবার্তা হতো না। এটিকে গোপন রাখার প্রবণতা ছিল। অনেকেরই জিজ্ঞাসা কেন মানুষ আত্মহত্যা করে? এটি কি অপরাধ নাকি নিজেকে শেষ করে দেওয়ার অধিকার মানুষের আছে? এসব বিষয়ে নানা ধরনের বিতর্ক সব সময় জারী ছিল, এখনও আছে। তবে শেষ সিদ্ধান্তে পৌঁছানো সত্যিই কঠিন। 

নৃবিজ্ঞানের শিক্ষার্থী হিসেবে আত্মহত্যা প্রসঙ্গে কথা বলতে গেলে সবার আগে আসে এমিল ড্যুরখেইমের কথা।  তিনি তার গবেষণালব্ধ প্রাপ্ত তথ্য থেকে জানিয়েছিলেন সম্ভবত ১০ হাজারে ১ থেকে ৩ জন লোক আত্মহত্যা করেন। কিন্তু আমাদের দেশের পরিসংখ্যানের হার হয়তো ড্যুরখেইমের দাবি খারিজ করে দেয়। তবে এটিও সত্য যে, পরিসংখ্যানে সকল আত্মহত্যার খবর যোগ হয় না। পরিসংখ্যান নিয়ে মতবিরোধ থাকলেও ড্যুরখেইমের আত্মহত্যার তত্ত্ব অনেকেই আমলে নিয়েছেন এই মেনে যে, আত্মহত্যা একটি সামাজিক ঘটনা। আত্মহত্যার প্রবণতা সমাজের মধ্যেই উৎপন্ন হয়। যদিও ড্যুরখেইম চার ধরনের আত্মহত্যার কথা বলেন: আত্মকেন্দ্রিক, নৈরাজ্যমূলক, পরার্থমূলক এবং নিয়তিবাদী। বাংলাদেশে সম্ভবত আত্মকেন্দ্রিক আত্মহত্যারই ধরন বেশি। 

তবে আত্মহত্যার পরে বিভিন্ন সময় দেখা যায় তার আশপাশের মানুষকে দোষারোপ করা শুরু হয়। যেমন হয়েছে সাম্প্রতিক একটা আত্মহত্যা নিয়ে। কেন তিনি একা থাকতেন? পরিবারের সদস্যরা কেন তাকে একা রাখলেন? আমরা শুধু দোষ খোঁজা এবং অন্যকে দোষারোপের সংস্কৃতি লালন করছি। আমরা একটি ব্যবস্থাপনার দিকে না তাকিয়ে ব্যক্তিকে দোষারোপের মধ্য দিয়েই সমস্যার সমাধান খোঁজার চেষ্টা করি। এতেই বিপদ হচ্ছে। কিন্তু আসলে বিষয়টি এমন নয়। অনেক মানুষের মধ্য থেকেও কেউ আত্মহত্যার সিদ্ধান্ত নিতে পারেন। একাকী মনে হওয়া বা একা থাকার সঙ্গে বিষয়টি সব সময় যুক্ত নাও হতে পারে। 

প্রতিটি মানুষের জীবনেই সংকট আছে, বেদনা আছে; মন খারাপ করার মতো বিষয়ের মুখোমুখি আমরা প্রতিনিয়ত হই। কিন্তু কারো সঙ্গে কারো সংকট মিলবে না। টিনএজারদের সঙ্গে যেমন মিলবে না একজন বিবাহিত নারীর আত্মহত্যা করার কারণ, তেমনি পুরুষতন্ত্রের শিকার যে শুধু নারীই হচ্ছে তা নয়, পুরুষতন্ত্রের চাপ সহ্য করতে না পেরে অনেক পুরুষও আত্মহত্যা করছে। কারণ পুরুষতন্ত্র পুরুষকে শেখাচ্ছে সব দায়িত্ব তাকেই নিতে হবে। তার মানসিক চাপ অন্যকে জানতে দেয়া যাবে না। তাহলে তার পৌরষত্ব হুমকির মুখে পড়বে। 

পুঁজিবাদ আমাদের থেকে অনেক কিছু কেড়ে নেওয়ার পাশাপাশি অনেকটাই যেন ছিনিয়ে নিয়েছে মানুষের সঙ্গে মানুষের বিশ্বস্ততার সম্পর্কটিও। এখন আর আমরা কেউ কাউকে বিশ্বাস করতে পারছি না। বাবা মায়েরা বিশ্বাস করছেন না সন্তানকে। সন্তান করছে না বাবা-মাকে। কান্নার জন্যও মানুষের নির্ভরযোগ্য কাঁধ দরকার হয়। কিন্তু সেই কাঁধ কোথায়? বন্ধুত্বগুলো অনেকটাই ফাঁপা। প্রতিনিয়ত এই নির্ভরশীলতার অভাব মানুষ নিজের মধ্যে নিজেকে লুকিয়ে রাখছে ক্রমশই। আমাদের মানুষকেই দরকার বেশি। কিন্তু কোথাও সেই নির্ভরতার মানুষ খুঁজে পাই না। মানুষ আছে, কিন্তু কোথাও প্রাণের মানুষ, মনের মানুষ নেই। আর এই নেই-নেই মনটাই কেমন করে যেন মৃত্যুকে আলিঙ্গন করে হয়তো। 

এ কথাও আমাদের মেনে নিতে হবে যে, কিন্তু আমাদের দেশে মানসিক চিকিৎসা নিয়েও আছে ট্যাবু। আমরা জ্বর এলে চিন্তিত হই, শরীর কোথাও ব্যথা হলে দৌড়ে ছুটে যাই ডাক্তারের কাছে। কিন্তু আমরা মানসিকভাবে কখনও আক্রান্ত হলে মনোরোগ বিশেষজ্ঞের কাছে যেতে চাই না। এটা এখনও আমাদের কাছে লজ্জার বিষয়। অনেকেই বলেন যে ‘আমি কী পাগল যে মানসিক ডাক্তারের কাছে যাবো?’ 

ফলে অনেকের নিজের কাছেই এক ধরনের ‘ডিনাইয়েল’ মনস্কতা তৈরি হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রায় প্রতিটি আবাসিক হলে মনোচিকিৎসক রয়েছেন। এর পাশাপাশি কেন্দ্রীয়ভাবে টিএসসিতেও রয়েছে কাউন্সেলিংয়ের ব্যবস্থা। কিন্তু বাস্তবতা হলো এই যে দুই-চার শিক্ষার্থীর বাইরে এই সেবা নিতে খুব বেশি শিক্ষার্থী আগ্রহ বোধ করেন না। কারণ আমরা মানসিক স্বাস্থ্যের যত্ন বিষয়ে খুব একটা আগ্রহী নই এবং এজন্য এগুলোকে আমলে নেই না। 

আবার যারা নিয়মিত মানসিক স্বাস্থ্যের পরিচর্যা করেন তাদের নিয়েও আনেক সময় হাসাহাসি হয় এবং এটি অন্যরা জানতে পারলে তাদের বিভিন্ন জায়গা থেকে বাতিল করে দেওয়া কিংবা কম গুরুত্ব দেওয়ার প্রবণতা থাকে। এসব কারণে যারা নিয়মিত চিকিৎসা সেবা গ্রহণ করেন তারাও এক ধরনের চাপের মধ্যে থাকেন। আবার অনেকেই এই চাপের বিষয় জানেন বলেই মানসিক স্বাস্থ্যের যত্ন নেওয়া প্রয়োজন বোধ করলেও দ্বিধায় ভোগেন। যার কারণে মানসিক স্বাস্থ্য অনেকটাই হয়ে পড়ছে অবহেলিত।
এছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়সহ অল্প কিছু প্রতিষ্ঠানে এই সেবা আছে। মনোচিকিৎসক বা যারা কাউন্সেলিংয়ের মাধ্যমে মানসিক স্বাস্থ্যসেবা দেন, তাদের সাহায্য নেওয়ার সুযোগ জেলা-উপজেলা পর্যায়ে একেবারেই নেই। এমনকী রাজধানীর বাইরের বড় শহরগুলোতেও থাকলেও তা খুবই সীমিত পর্যায়ে। আমরা গ্রামে-গঞ্জে চিকিৎসকের জন্য তাগাদা দেই, কিন্তু কখনও মনের অস্থিরতার চিকিৎসার কথা ভাবি না। প্রত্যেকটি আত্মহত্যার জন্য আসলে আমরা সবাই দায়ী। তাই মানসিক স্বাস্থ্যকে প্রাধান্য দেওয়ার সময় এখনই।

লেখক : শিক্ষক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
 

/তারা/ 

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ