ঢাকা     রোববার   ১৯ মে ২০২৪ ||  জ্যৈষ্ঠ ৫ ১৪৩১

শিক্ষাবিদরা উপাচার্য কেন হবেন?

জোবাইদা নাসরীন || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৫:৩৭, ৩ এপ্রিল ২০২২   আপডেট: ১৫:৪০, ৩ এপ্রিল ২০২২
শিক্ষাবিদরা উপাচার্য কেন হবেন?

গত ২৯ মার্চ সংসদে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, পিরোজপুর বিল পাস হয়। সেই বিলের ওপর আলোচনায় শিক্ষামন্ত্রী দীপুমনি জানান, দেশের বরেণ্য শিক্ষাবিদদের অনেকেই বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের দায়িত্ব নিতে চান না। এটি বাংলাদেশের বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থার জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি তথ্য।

শুধু তাই নয়, কীভাবে ভিসি নিয়োগ হয় সেই বিষয়ে উত্তর দিতে গেয়ে শিক্ষামন্ত্রী জানান, প্রথমত বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য নিয়োগের জন্য প্যানেল প্রস্তুত করে আচর্যের (রাষ্ট্রপতি) কাছে পাঠানো হয়। কয়েকটি বিষয়ের ওপর ভিত্তি করে ওই তালিকা প্রস্তুত করা হয়। প্রথম দেখা হয় তাদের একাডেমিক যোগ্যতা, দ্বিতীয়ত তাদের গবেষণা। একইসঙ্গে তাদের নেতৃত্ব দেয়ার ক্ষমতাও মূল্যায়ন করা হয়। অর্থাৎ প্রতিষ্ঠানে নেতৃত্ব দিয়েছেন কিনা, সেখানকার সমিতিসহ নানা জায়গায় নেতৃত্ব দেয়ার আভিজ্ঞতা আছে কিনা। তিনি আরও জানান, উপাচার্য হওয়ার জন্য শুধু একাডেমিক গুণাবলীই নয় পাশাপাশি নেতৃত্ব দেয়ার গুণাবলীও থাকতে হবে। তা ছাড়াও বিভিন্ন ধরনের প্রাশাসনিক কাজ করার অভিজ্ঞতা থাকতে হবে। সবকিছু বিবেচনায় যাদের সবচাইতে ভালো মনে হয় তাদের নামই প্রস্তাব করা হয়।

আমরা সবাই জানি বাংলাদেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের (চারটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় বাদে) ভিসি নিয়োগের প্রস্তাব যায় শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে। চারটি স্বায়ত্তশাসিত বিশ্ববিদ্যালয়েই নির্বাচিত সিনেট সদস্যরা ভোটের মাধ্যমে ভিসি প্যানেল নির্ধারণ করেন। সেখান থেকে রাষ্ট্রপতি একজনকে নির্বাচন করেন। আর বাকি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্যানেল তৈরি করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। পৃথিবীর খুব বেশি দেশে এই ধরনের নিয়ম নেই। কারণ সবাই জানে, বোঝে ভিসি নিয়োগের ক্ষেত্রে আমলাদের মতামত শুধু আপ্রয়োজনীয়ই নয়, অসঙ্গতিপূর্ণও। বেশির ভাগ দেশেই যারা শিক্ষা নিয়ে ভাবে তারা শুধু ভিসি নয়, বিশ্ববিদ্যালয়ের গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়োগের জন্য একটি সার্চ কমিটি গঠন করে। সেই সার্চ কমিটিতে অন্যান্য স্কলার থাকেন। সেটি একেবারেই রাজনীতি বিমুক্ত। এই প্রক্রিয়ার বিভিন্ন ধাপ এই সার্চ কমিটিই করেন। রাষ্ট্র তো দূরের বিষয়, সেই বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্যান্যরাও খুব বেশি জানতে পারেন না।

দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ভিসি নিয়োগ নিযে শিক্ষামন্ত্রীর এই বক্তব্য অনেক দিক থেকেই বেশ গুরুত্বপূর্ণ। প্রথমত, তিনি স্বীকার করেছেন যারা বর্তমানে ভিসি আছেন তারা বরেণ্য শিক্ষাবিদ নন। শিক্ষামন্ত্রীর এই বক্তব্য থেকে আরও বোঝা যায় যে, বরেণ্য শিক্ষাবিদরা উপাচার্য হতে চান না বলেই বতর্মানে আসীন উপাচার্যদের পদ দিতে হয়েছে। আসলে মূল বিষয়টি কী? বরেণ্য শিক্ষাবিদরা কেন উপাচার্য হতে চান না সেই প্রশ্ন করতে চাই মাননীয় শিক্ষামন্ত্রীকে। শিক্ষাবিদরা উপাচার্য হতে ভয় পান কেন?

আসলে তারা জেনে গেছেন তাদের মাপামাপির মানদণ্ড কী হবে? কারা তাদের যোগ্যতার মাপযোগ করবেন? উপাচার্য হলে তাদের কী কী করতে হবে? আর কী কী বিষয়ে অন্ধ থাকতে হবে? কী কী বিষয়ে কোন ধরনের ব্যক্তিত্বের প্রকাশ ঘটানো চলবে না? এখন যদি আমি প্রশ্ন রাখি, মোটের ওপর কিংবা উপাচার্য হবার দৌড়ের প্রধান এবং প্রথম যোগ্যতা কী? যোগ্যতার মাপকাঠি আসলে কী? এটি বিশ্লেষণ করলেই বোঝা যাবে শিক্ষাবিদদের অনাগ্রহের কারণ।

শিক্ষামন্ত্রী দীপুমনি একটি বিষয় বলেন নি। কিন্তু আমরা সবাই তা জানি। তিনি আড়াল করলেও এটি সবচেয়ে বেশি প্রকাশ্য। সেটি হলো—দলীয় আনুগত্য। শিক্ষামন্ত্রী বলেছেন, শিক্ষকদের একাডেমিক যোগ্যতার পাশাপাশি তার নেতৃত্ব দেয়ার যোগ্যতাকেও দেখা হয়। এটি কোন নেতৃত্ব? এটি কী শিক্ষা আন্দোলেনের নেতৃত্ব? এটি কী সমাজ সংস্কার বা বিশ্ববিদ্যালয় সংস্কারের নেতৃত্ব? একবারেই না। এটি আসলে দলীয় নেতৃত্ব। সম্ভবত একমাত্র সাউথ এশিয়াতেই উপাচার্য পদে রাজনৈতিক দল বিবেচনায় আসে!

কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে যখন নতুন উপাচার্য নিয়োগ দেয়া হয় তখন গণাধ্যমে সেই উপাচার্যের যোগ্যতাসহ তার পরিচিতি তুলে ধরা হয়। মজার বিষয় হলো, সেই পরিচিতিতে তার একাডেমিক যোগ্যতার পাশাপাশি লেখা হয় তিনি কোন কোন সময়ে ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠনের সদস্য ছিলেন এবং নেতৃত্ব দিয়েছেন। সুতরাং এই বিষয়ে স্পষ্ট যে, উপাচার্য হওয়ার জন্য আর যা-ই হোক বরেণ্য শিক্ষাবিদদের দরকার নেই। এখন সবচেয় বড় যোগ্যতা দলীয় আনুগত্য। শিক্ষামন্ত্রণালয় প্যানেল তৈরি করে বলেই দলীয় শিক্ষাবিদরা ধরনা দেয় মন্ত্রনালয়ে। তারা অন্য যোগ্যতার প্রতি আগ্রহী নন।

কেন বরেন্য শিক্ষাবিদরা আগ্রহী হবেন? কেননা তারা জেনে গেছেন এই পদে যাওযা মানেই মান-সম্মান নষ্টের ঝুঁকি। চিন্তার-কাজের স্বাধীনতা নষ্ট হওয়া। সারাক্ষণ গদি নেয়ে চিন্তা করা। চব্বিশ ঘণ্টা ক্ষমতাসীন ছাত্র সংগঠনের নেতাদের চাপ এবং তাপ। পাশাপাশি আরও নানা ধরনের ঝুট-ঝামেলার মধ্যে শিক্ষা নিয়ে ভাবা প্রায়ই অসম্ভব হয়ে পড়ছে। আরেকটি বিষয়ও খুব যুক্ত। কয়েক বছর ধরে দেখা যাচ্ছে, বিশ্ববিদ্যালয়ে যখন ছাত্র আন্দোলন হয় তখন সরকার সেটিকে সরকারবিরোধী হিসেবে পাঠ করা শুরু করে এবং সেটিকে প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা করে। সেক্ষেত্রে প্রথমে ব্যবহার করা হয় ক্ষমতাসীন ছাত্র সংগঠনকে। তারপর বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন পুলিশকে দিয়ে দমাতে চায়। আর তখন সমস্যা আরও প্রকট হয়। এসব বাস্তবতা বিশ্লেষণ করলে খালি চোখেই বোঝা যায়, বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য পদে শিক্ষাবিদরা দলীয় বিবেচনার বাইরে গিয়ে খুব বেশি অবদান রাখতে পারবেন না বলেই তারা উপাচার্য হতে আগ্রহী হন না।

মাননীয় শিক্ষামন্ত্রী, নিজেই উত্তরটি নিয়ে আগে ভাবুন, আপনারা যদি শিক্ষাবিদদের উপাচার্য হিসেবে দেখতে চান তাহলে সেই পরিবেশ তৈরি করুন। শিক্ষাবিদরা স্বাধীনভাবে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে সাজাবে, সেই স্বাধীনতা পেলে তবেই তো তারা আগ্রহী হবেন। সমস্যাগুলো আপনার অজানা নয় বরং সেটি থেকে এখন বের হবার পথ খোঁজ করুন।

ঢাকা/শান্ত

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ