ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ০২ মে ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৯ ১৪৩১

বঙ্গবাজার নিমতলী অথবা চকবাজার, কান্নার শব্দ একই 

অলোক আচার্য || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৯:৩৩, ৪ এপ্রিল ২০২৩  
বঙ্গবাজার নিমতলী অথবা চকবাজার, কান্নার শব্দ একই 

আমাদের দেশে যে দুর্ঘটনাগুলো সচরাচর ঘটে এবং যে কারণে প্রাণহানি থেকে শুরু করে বিপুল পরিমাণ সম্পদের ক্ষয়ক্ষতি হয় সেটি হলো অগ্নিকাণ্ড। 

দেশের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ব্যবসায় কেন্দ্রস্থল এবং জনারণ্য এলাকা বঙ্গবাজারে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় যে বিপুল ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে তা সাম্প্রতিক কালের আরও একটি বড় দুর্ঘটনা। প্রায় সাড়ে ছয় ঘণ্টার প্রচেষ্টায় বঙ্গবাজারের আগুন নিয়ন্ত্রণে আসে। কিন্তু ততক্ষণে অনেকের স্বপ্ন পুড়ে শেষ! অনেকে হয়তো আর কখনোই জীবনযুদ্ধে ঘুরে দাঁড়াতে পারবেন না। 

প্রাথমিকভাবে গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদে জানা যায়, এ ঘটনায় প্রায় পাঁচ হাজার দোকান পুড়েছে। ক্ষতি হয়েছে আনুমানিক দুই হাজার কোটি টাকার। যাই হোক এ হিসাব প্রাথমিক। মাত্র কয়েকদিন আগে গুলশানে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। এরকম মাঝেমধ্যেই হচ্ছে। বিশেষভাবে রাজধানী ঢাকায় ঘনঘন আগুন লাগার ঘটনা ঘটছে। ফলে বিষয়টি কোনোভাবেই আর এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই। এসব ঘটনায় সম্পদ পুড়ছে। মানুষ মারা যাচ্ছে। শেষ সম্বলটুকু হারিয়ে পথে বসছে নিঃস্ব মানুষ। এই প্রতিটি মানুষের সঙ্গে একটি পরিবার জড়িত। এই অসহায় পরিবারগুলোর শেষ পরিণতির খবর শেষ পর্যন্ত পত্রিকার পাতায় আসে না। কারণ পত্রিকা ব্যস্ত থাকে নতুন ঘটনা নিয়ে। এ দেশে ঘটনার অভাব নেই। ঘটনা-দুর্ঘটনা হাত ধরে চলছে পাশাপাশি। 

অতীতে দেশে বড় কয়েকটি অগ্নিকাণ্ড এবং অসংখ্য মানুষের প্রাণহানির কারণ ছিল কেমিক্যাল বা রাসায়নিক পদার্থ। এ ছাড়াও শর্ট সার্কিট থেকে, বিভিন্ন অসতর্কতায় এমনকি সিগারেটের ফেলে দেওয়া টুকরো থেকেও অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটছে। দগ্ধ মানুষের আর্তচিৎকারে আকাশ-বাতাস ভারী হয়ে উঠেছে। সেই মুহূর্তগুলো সবচেয়ে বেশি করুণ, মর্মান্তিক! ফলে আমাদের সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন ছিল সতর্ক থাকার। বাস্তবে আমরা ততটা সতর্ক নই। সতর্ক থাকলে ছোট ছোট অনেক দুর্ঘটনা আমরা এড়াতে পারতাম। 

সম্প্রতি ফায়ার সার্ভিসের করা ২০২২ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত সারা দেশের ভবনগুলোর অগ্নিনিরাপত্তার বিভিন্ন বিষয় পরিদর্শন করে তৈরি করা প্রতিবেদনে দেখা যায়, দেশের ৩৭ দশমিক ৮৭ শতাংশ ভবন অগ্নিঝুঁকিতে রয়েছে। সবচেয়ে বেশি ঢাকায় ৫৪ দশমিক ৬৭ শতাংশ ভবন অগ্নিঝুঁকিতে রয়েছে। যখন ঘটনা ঘটে যায় তারপর বলি- এবার থেকে হবে। আসলে হচ্ছে হবে করে সময় কেটে যায়। এখন প্রশ্ন হলো- আর কত প্রাণ গেলে আমরা সতর্ক হবো?

ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্সের বাৎসরিক পরিসংখ্যান থেকে জানা যায়, দেশে গত ৫ বছরে ১ লাখ ১০ হাজার ৪৯২টি অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। এসব ঘটনায় ক্ষতি হয়েছে ১ হাজার ৫২৩ কোটি টাকা। নিহত হয়েছেন ৭৭২ জন সাধারণ মানুষ এবং ১৪ জন ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স কর্মী। সবচেয়ে বেশি সংখ্যক মানুষ অগ্নিকাণ্ডে নিহত হয়েছেন ২০২১ সালে। ওই বছর নিহত হন ২১৯ জন। প্রতিটি ঘটনার পেছনেই খুঁজতে গিয়ে বের হয়ে আসছে ভুল, অবহেলা, ত্রুটি। আমরা কি সেই ভুলগুলো শুধরে নেই? না। অতীত থেকে শিক্ষা নেয়ার অভ্যাস আমাদের নেই। আমরা অবহেলাগুলো জিইয়ে রেখে প্রতিদিনের পথ চলি। সচেতন হই না। ত্রুটি সারিয়ে নেয়ার গরজ আমাদের বরাবরই কম। চলছে যেমন চলুক- এই হলো আমাদের মনোভাব। 

অসাবধানতাবশত যে কোনো দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। হ্যাঁ, এটাও ঠিক দুর্ঘটনা বলেকয়ে আসে না। কিন্তু যখন কোনো দুর্ঘটনার পেছনে কারণ হিসেবে অবহেলা, ত্রুটি খুঁজে পাওয়া যায় তখন আসলে আফসোস ছাড়া আর কিছু করার থাকে না। অথচ একটু সচেতন হলে এই দুর্ঘটনা হয়তো এড়ানো যায়। 

প্রতিটি ঘটনা ঘটার পর তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। সেই ঘটনার কারণ বের হয়ে আসার পাশাপাশি ভবিষ্যতে যাতে এ ধরনের ঘটনা না ঘটে তার সুপারিশও করা হয় তদন্ত প্রতিবেদনে। কিন্তু তাতে কি লাভ হচ্ছে? সেই আবার কোথাও না কোথাও দুর্ঘটনা ঘটছে। তদন্তে কাছাকাছি একই বিষয় বেরিয়ে আসছে। প্রথম কিছুদিন সেসব নিয়ে তুমুল আলোচনা হচ্ছে। তারপর একসময় সব কিছু আগের মতো তথৈবচ। এভাবে আর কতদিন চলবে?

সাধারণ যে কারণগুলোতে সারাদেশে আগুন লাগার ঘটনা ঘটছে সে বিষয়ে মানুষকে সচেতন করতে হবে। আজকে যে বিষয়টি আমরা দেখলাম আগুন নেভানোর জন্য যথেষ্ট পানি না পেয়ে হিমশিম খাচ্ছেন দমকল কর্মীরা- এ বিষয়গুলোর সমাধান আগে থেকেই ভাবতে হবে। সবচেয়ে বড় ব্যাপার সমন্বিত একটি পরিকল্পনা থাকতে হবে। এর চেয়েও বড় কোনো দুর্ঘটনা ঘটলে; বিশেষ করে ভূমিকম্প হলে জান-মাল কীভাবে রক্ষা করা যায় ভাবতে হবে। ফায়ার সার্ভিসকে অত্যাধুনিক সরঞ্জামে আরও আধুনিক করে গড়তে হবে। এ জন্য বাজেট বরাদ্দ থাকতে হবে। কারণ দেশে মানুষ বাড়ছে। জমি বাড়ছে না। রাজধানীতে তার প্রভাব পড়বেই; পড়ছেও। কম জায়গায় বেশি মানুষের বাস যেখানে, সেখানে এ ধরনের দুর্ঘটনা আরো ভয়াবহ আকার ধারণ করে। ফলে সবাইকে সচেতন হতেই হবে। আপাতত এটাই সুরক্ষার পথ। না হলে অগ্নিকাণ্ডে প্রাণহানি এবং সম্পদের বিপুল ক্ষয়ক্ষতি বাড়তেই থাকবে।

লেখক : প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট  

তারা//

সম্পর্কিত বিষয়:

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়