ঢাকা     রোববার   ২১ ডিসেম্বর ২০২৫ ||  পৌষ ৭ ১৪৩২

Risingbd Online Bangla News Portal

আখতারুজ্জামান ইলিয়াস : সাহিত্যে রাষ্ট্র ও গণসংগ্রামের মিথস্ক্রিয়া

অলাত এহসান || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৬:২০, ১২ ফেব্রুয়ারি ২০১৫   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
আখতারুজ্জামান ইলিয়াস : সাহিত্যে রাষ্ট্র ও গণসংগ্রামের মিথস্ক্রিয়া

আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, কথাসাহিত্যিক

অলাত এহসান

লেখায় সততা, নির্মোহ দৃষ্টি-ভঙ্গী, গভীর জীবনবোধর মতো বিরল গুণাবলি বাংলা সাহিত্যের যে ক’জন লেখক অর্জন করতে সক্ষম হয়েছেন তাদের মধ্যে আখতারুজ্জামান ইলিয়াস অন্যতম। দায়বদ্ধতা থেকেই তিনি পরম-দরদে তুলে এনেছেন সমাজের নিচু তলার নিষ্পেশিত মানুষের শ্রেণিজীবন। এনেছেন তাদের বিচিত্র জীবনযাত্রা, বিশ্বাস, দুঃখ-আনন্দ, ক্ষোভ, সংস্কার, অনুভূতি, সংলাপ- ঠিক যেন রাষ্ট্রের চরিত্র ও মানুষের গণসংগ্রামের মিথস্ক্রিয়া। ক্ষণজন্মা এই লেখক কখনোই সস্তা জনপ্রিয়তা বা বণিক বুদ্ধিতে লেখেন নি। দু’টি উপন্যাস, পাঁচটি ছোট গল্পগ্রন্থ আর একটি প্রবন্ধ গ্রন্থই তার রচনা সম্ভার। তবে তার কালোত্তীর্ণ লেখা জন্ম-মৃত্যু নির্ধারিত জীবন অবলীলায় ছাড়িয়ে যায়।


তিনি অখণ্ড জীবনবোধে ইতিহাস ও রাজনৈতিক সচেতন ছিলেন। তা আকস্মিক কিছু না। পিতা বদিউজ্জামান মোহাম্মদ ইলিয়াস দেশ বিভাগের পূর্ব থেকে মুসলিম লীগের গুরুত্বপূর্ণ নেতা ছিলেন। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর তিনি প্রাদেশিক আইন পরিষদের পার্লামেন্টারি সেক্রেটারি নিযুক্ত হন। পিতার রাজনৈতিক চর্চার আবহে বেড়ে উঠলেও তিনি মুক্ত মানুষের মুক্ত সমাজের কথা ভাবতেন। মানুষকে কখনো ইতিহাস ও রাজনীতি থেকে বিচ্ছিন্ন ভাবেন নি। এ জন্য রাজনীতিকে গভীর অভিপ্রায়ে পর্যবেক্ষণ করেছেন। রাজনীতি কীভাবে ক্রিয়া করে জীবন ও মনোভাব নির্ধারণ করে দেখেছেন। তার গল্প-উপন্যাসের চরিত্রের দিকে তাকালেই তার প্রমাণ মেলে।


শিশু বেলা থেকেই সাহিত্যের প্রতি তার ঝোঁক দেখা যায়। বিশেষত মা বেগম মরিয়ম ইলিয়াস, দাদা  ও পরিবারের বয়জ্যেষ্ঠদের মুখে গল্প শুনতে শুনতে এর শুরু। ছোট বেলায় ছড়া, কবিতা লিখতেন। কোনো কোনোটা ছাপাও হতো তৎকালীন দৈনিকের শিশু পাতায়। কবিতার পাশাপাশি গল্পের শুরুও শৈশবে। পনের বছর বয়সে প্রথম প্রকাশিত হয় গল্প ‘সন্তু’। গল্পটি তাদের বাড়িতে আসা এক নাপিতকে নিয়ে লেখা। এরপর মূলত ১৯৫৯-৬০ সালে ঢাকা কলেজে ইন্টার মিডিয়েট পড়ার সময় থেকেই তার সাহিত্যে ব্যাপক উন্মেষ ঘটে। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে তা পূর্ণতা পায়। এ সময় গল্প-কবিতা সমান তালে চলে। কিন্তু ক্রমেই স্পষ্ট হয়ে যায় তার গল্পের শক্তি। এই অমিত শক্তি থাকার পরও তার গল্পসংখ্যা আশ্চর্য রকম কম! স্বাধীনতা উত্তর সময়ে তার লেখালেখি কমে যায়। তথাপি তার সমস্ত গ্রন্থগুলো এ সময় প্রকাশিত হয়। স্বাধীনতা উত্তর কবিতা লেখা চললেও তা নিয়ে কোনো বই হয় নি।


১৯৭৬ সালে প্রকাশ হয় তার প্রথম গল্পগ্রন্থ ‘অন্য ঘরে অন্য স্বর’। বইটির নাম তার প্রিয় কথাসাহিত্যিক ট্রুম্যান ক্যাপোটির ‘আদার ভয়েস, আদার রুমস্’ উপন্যাস থেকে নেয়া। বইটি তখন গুরুত্বপূর্ণ লেখক-সমালোচকদের আলোচনা আদায় করে নিতে সক্ষম হয়। প্রথম বই প্রকাশের ছয় বছর পর, ১৯৮২ সালে প্রকাশিত হয় দ্বিতীয় গল্পগ্রন্থ ‘খোঁয়ারি’। এরপর ১৯৮৫ সালে ‘দুধভাতে উৎপাত’, ৮৯-এ ‘দোজখের ওম’ এবং মৃত্যুর পর পরই প্রকাশিত হয় তার শেষ গল্পগ্রন্থ ‘জাল স্বপ্ন, স্বপ্নের জাল’। একমাত্র প্রবন্ধ গ্রন্থ ‘সংস্কৃতির ভাঙা সেতু’ তারপরই প্রকাশিত হয়। তার গল্পগ্রন্থগুলোর নামের দিকে তাকালেও তৎকালীন রাজনীতি ও জীবনের পরম্পরা খুঁজে পাওয়া যাবে। লেখনী শক্তি থাকা সত্ত্বেও তার প্রথম দু’টি গল্পগ্রন্থ বন্ধুবান্ধব ও নিকটতম মানুষের উদ্যোগে প্রকাশিত হয়। তার উপন্যাস প্রকাশের ইতিহাসেও রয়েছে বিষাদের গল্প।


১৯৭৫ সালে, ‘দৈনিক সংবাদ’ পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে প্রকাশ হতে থাকে তার প্রথম উপন্যাস ‘চিলেকোঠায়’ নামে। সরকারের রোষাণলের ভয়ে পত্রিকাটি তার লেখায় শব্দ পরিবর্তনের চেষ্টা করলে তিনি প্রতিবাদ করেন। ফলে লেখাটি আর প্রকাশিত হয় নি। তিনি বুঝতে সক্ষম হন ক্ষমতার হাত বদল হলেও রাজনীতির বদল হয়। তবু উপন্যাসটি বেশ আলোচিত হয় এবং আল মাহমুদ তার প্রথম গল্পগ্রন্থ তাকে ও মাহমুদুল হককে যৌথভাবে উৎসর্গ করেন। উপন্যাসটি ১৯৮৬ সালে ‘চিলেকোঠার সেপাই’ নামে প্রকাশ পায়। তার দ্বিতীয় উপন্যাসের ভাগ্যেও এমন ঘটনা ঘটে। ১৯৯৪ সালে ‘দৈনিক জনকণ্ঠ’ পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয় ‘খোয়াবনামা’ উপন্যাসটি। ১৯৯৫ সালে হঠাৎ করে পত্রিকাটি উপন্যাসটি ছাপানো বন্ধ করে দেয়। তিনি তখন দেশে ‘ব্লাসফেমি আইন’ প্রণয়ন চক্রান্তের প্রতিবাদে সাংগঠনিকভাবে আন্দোলন করছিলেন। চল্লিশের দশকের রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজ, মুসলমানদের জাতি বিচার ও মধ্যবিত্তের বিকাশ নিয়ে লেখা এই উপন্যাসটি এর পরের বছর প্রকাশিত হয়।


আখতারুজ্জামান ইলিয়াস কখনোই কায়েমি স্বার্থ মেনে নেন নি। প্রগতিশীল সাহিত্যকে দিশা দেখানোর জন্য ও সাংগঠনিকতার ভেতর দিয়ে চেতনা বিকাশের জন্য তিনি বাংলাদেশ লেখক শিবিরে যোগ দেন। সংগঠনের ‘তৃণমূল’ পত্রিকাটি তিনি সম্পাদনা করতেন। তার জীবন চর্চা ছিল সাধারণ মানুষের কাছাকাছি। রাষ্ট্রীয় নিপীড়ণ ও সাম্প্রদায়িক-মৌলবাদী শক্তির উত্থানের বিরুদ্ধে সোচ্চার থেকেছেন সর্বদা। তার সুস্পষ্ট উচ্চরণ, ‘শিল্প-সাহিত্য বিপ্লবকে দিক ভাষা, বিপ্লব শিল্প-সাহিত্যকে দেবে মুক্তি’।


আখতারুজ্জামান ইলিয়াস যেমন পঠন জরুরি, তা পরিচর্যা ও ধারণ করাও তেমনি জরুরি। এই রাষ্ট্র যেমন তার গল্পের চরিত্রদের জীবনের প্রশ্ন সমাধান করতে পারে নি, তেমনি নিজের দৈন্যও ধারণ করতে পারে নি। তবু দিয়ে গেছেন অম্লান সাহিত্য। তিনি বাংলাদেশ লেখক শিবিরের ‘হুমানয়ুন স্মৃতি পদক’ (১৯৭৭), ছোট গল্পের জন্য বাংলা একাডেমি পুরস্কার (১৯৮৩), ‘খোয়াবনামা’র জন্য কলকাতার আনন্দ পুরস্কার (১৯৯৬) এবং  ১৯৯৮ সালে মরণোত্তর একুশে পদকসহ বেশকিছু তাৎপর্যপূর্ণ পুরস্কার পেয়েছেন।


১৯৯৬-এর জানুয়ারিতে তার পায়ে ক্যান্সার ধরা পড়ে। মার্চে কলকাতায় এক অপারেশনের মাধ্যমে ডান-পা কেটে ফেলার পরও শেষ রক্ষা হয় নি। ১৯৯৭ সালেন ৪ জানুয়ারি ঢাকা কমিউনিটি হাসপাতালে শক্তিমান এই  লেখকের মহাপ্রয়াণ ঘটে। ১৯৩৪ সালের এই দিনে গাইবান্ধার সাঘাটায় তার জন্ম। মাতুলালয়ে জন্ম হলেও তিনি বেড়ে ওঠেন দাদা বাড়ি বগুড়া শহরের উপকণ্ঠে নারুলি গ্রামে। তার ডাক নাম ছিল ‘মঞ্জু’। ভারতের প্রখ্যাত লেখিকা মহাশ্বেতা দেবী তার ‘মাস্টার সাব’ বইটি আখতারুজ্জামান ইলিয়াসকে উৎসর্গ করে লেখেন, ‘...এবং আমি বিশ্বাস করি, কি পশ্চিমবাংলা কি বাংলাদেশ, সবটা মেলালে তিনি শ্রেষ্ঠ উপন্যাস লেখক। আমার চেয়ে অনেক বড় লেখক।’


তথ্যসূত্র :
১.    আখতারুজ্জামান ইলিয়াস রচনা সমগ্র ১ ও ৪, মাওলা ব্রাদার্স, ঢাকা।
২.    তৃণমূল, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস সংখ্যা, আনু মুহাম্মদ সম্পাদিত।
৩.    ইলিয়াস ও প্রশ্নের শক্তি, আনু মুহাম্মদ, শ্রাবণ প্রকাশ, ঢাকা।
৪.    আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, কাজী মহম্মদ আশরাফ, কথা প্রকাশ, ঢাকা।
৫.    বিভিন্ন দৈনিকের সাময়িকী।

অলাত এহসান : গল্পকার ও সাংবাদিক


রাইজিংবিডি/ঢাকা/১২ ফেব্রুয়ারি ২০১৫/তাপস রায়

রাইজিংবিডি.কম

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়