অমর কথাসাহিত্যিক শওকত ওসমানের জন্মদিন
দীপংকর গৌতম || রাইজিংবিডি.কম
শওকত ওসমান
দীপংকর গৌতম : শওকত ওসমান বাংলা সাহিত্যের খ্যাতিমান কথাসাহিত্যিক। লেখার মধ্য দিয়ে তিনি প্রকাশ করেছেন জীবন দর্শন, দেশের প্রতি মমত্ববোধ এবং লেখকের দায়বদ্ধতা । তাঁর উপন্যাস ‘ক্রীতদাসের হাসি’র মধ্য দিয়ে তিনি তাঁর পরিচয় তুলে ধরেছেন। এই উপন্যাসে আমরা এমন এক লেখককে পাই যিনি বাংলা ভাষা ও সাহিত্যেরই শুধু নয়, দেশের তৎকালীন প্রগতিবাদী রাজনীতির একনিষ্ঠ সৈনিক হিসেবে আবির্ভূত হন, যিনি লেখনীর মধ্য দিয়ে বিকশিত চিন্তাকে তুলে ধরেন। ১৯৬২ সালে তিনি এ উপন্যাসটি রচনা করেন। ১৯৫৮ সালে জেনারেল আইয়ুব খানের সামরিক শাসন পাকিস্তানকে বর্বর স্বৈরশাসনের যাঁতাকলে আবদ্ধ করলো। সব ধরনের বাক-স্বাধীনতা হরণ করা হয়েছিল তখন। তৎকালীন পাকিস্তানের স্বৈরশাসক আইয়ুব খানের শাসন ব্যবস্থাকে ব্যঙ্গ করে এ উপন্যাস লেখেন তিনি।
সব স্বৈরাচারী শাসক গণতান্ত্রিক চেতনাকে ভয় পায়। এই চেতনাকে দমন করার জন্যই নেমে আসে সামরিক শাসন। কিন্তু লেখকের প্রতিবাদের ভাষা তখনও সোচ্চার। এই প্রতিবাদ রূপকভাবে প্রকাশিত হলেও শাসকগোষ্ঠী ঠিকই চিনে নিয়েছিল প্রগতিবাদী এই লেখককে। প্রতিবাদের ভাষার আল্পনায় আঁকা তাঁর এই উপন্যাসের সাহিত্যমূল্যও অপরিসীম। রূপকভাবে হলেও তিনি এ উপন্যাসে দেখিয়েছেন স্বাধীনতাকামী মানুষের হাসি কেউ বন্ধ করতে পারে না, যেমন পারা যায়নি উপন্যাসের প্রধান চরিত্র তাতারের হাসি বন্ধ করতে। হাসি বন্ধ করার চেয়ে মৃত্যুকে শ্রেয় মনে করেছে তাতার। দেশ বিভাজনের পূর্ববর্তী এবং পরবর্তী সময়ে রাজনৈতিক পটপরিবর্তন, নানা রকম উত্থান-পতনের ঘটনা নিবিড়ভাবে প্রত্যক্ষ করেছিলেন শওকত ওসমান। আর এসব ঘটনাই তার সাহিত্যিক মানসে গভীরভাবে প্রভাব ফেলেছিল। সমাজ ও রাষ্ট্রে নিগৃহীত, অধিকার বঞ্চিত, নিরন্ন মানুষের অন্তর্গূঢ় বেদনা তিনি গভীরভাবে উপলব্ধি করেছিলেন। এ জন্যই শাসক ও শোষকদের বিরুদ্ধে জ্বলে উঠতে পেরেছিলেন আজীবন আদর্শবাদী, স্বদেশের রক্তক্ষয়ী ইতিহাস ও ঐতিহ্যের প্রতি সুগভীর শ্রদ্ধাশীল শওকত ওসমান।
১৯৪৬ সালে দৈনিক আজাদে ‘বনী আদম’ উপন্যাস প্রকাশের পরপরই সাহিত্যাঙ্গনে তাঁর খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে। এরপর একের পর এক ছোটগল্প এবং উপন্যাস রচনা করে বাংলা সাহিত্যে স্বাতন্ত্রবোধের পরিচয় তুলে ধরেন। একাত্তরের মুক্তি সংগ্রামী চেতনায় উজ্জীবিত ছিলেন শওকত ওসমান। সে সময় পাকিস্তানি শাসক, শোষক ও দোসরদের হাতে অত্যাচারিত, নির্যাতিত মানুষের মর্মন্তুদ, বীভৎস দৃশ্য তিনি তুলে ধরেছেন তাঁর বিভিন্ন গল্প-উপন্যাসে। এ গল্প-উপন্যাসগুলো সেই দুঃসময়ের দলিল বা এক গভীর ক্ষতের কথা আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয়। আমৃত্যু মুক্তিযুদ্ধের চেতনা লালন এবং দেশের মানুষের প্রতি তার প্রগাঢ় মমত্ববোধ থাকলেও এ সংক্রান্ত তাঁর কোনো লেখাই পক্ষপাত দোষে দুষ্ট হয়ে ওঠেনি। জুনু আপা ও অন্যান্য গল্প, প্রস্তর ফলক, জন্ম যদি তব বঙ্গে, নিঃসঙ্গ নির্মাণ, মনিব ও তার কুকুর, পুরাতন খঞ্জর, ঈশ্বরের প্রতিদ্বন্দ্বী, জননী, ক্রীতদাসের হাসি, দুই সৈনিক, জাহান্নাম হইতে বিদায়, নেকড়ে অরণ্য ইত্যাদি গ্রন্থ শওকত ওসমানকে বাংলা সাহিত্যে মর্যাদার আসনে বসিয়েছে। এই ছোট্ট নিবন্ধে আমরা তার বিপুল নির্মাণের মধ্য থেকে একটি নাতিদীর্ঘ উপন্যাস ‘নেকড়ে অরণ্য’ বেছে নিয়েছি আলোচনার জন্য। বিশদ বাঙ্ময় এ উপন্যাস। নেকড়ে অরণ্য বলতে আমরা ভয়ংকর মাংসাশী জীবজন্তুর অভয়ারণ্যকেই বুঝি। এই অভয়ারণ্যের প্রতীক হয়ে উঠেছে একটি গুদামঘর, যার আলো রুগ্ন এবং ফিকে।
শওকত ওসমানের বর্ণনা অনুযায়ী টিনে ছাওয়া গোটা দালানটা সেভাবে তৈরি। সমতল মেঝে নেই। উঁচু উঁচু পোস্তা বাঁধা, যেন নিচ থেকে গুদাম ঘরটির স্যাতলা উঠে চাল-ডাল বা গুদামজাত অন্যান্য মাল নষ্ট না করে দেয়। আবার কুলিরা মাথায় করে বস্তা এনে পোস্তায় স্বাচ্ছন্দ্যে রাখতে পারে। ফলে দুই পোস্তার মাঝখানে পরিখার মতো সরু রাস্তা। গোটা গুদামজুড়ে এমন আড়াআড়ি লুকোচুরি খেলার বন্দোবস্ত রয়েছে। বিরাট আয়তনের তুলনায় বাল্বের সংখ্যা কম। তা-ও ষাট পাওয়ারের বেশি নয়। ফলে দিনের বেলায়ও আলো আঁধারীর ছকে জায়গাটা বন্দি থাকে। গুদাম ঘরটির এই আংশিক বর্ণনা থেকেই বোঝা যায় কথাশিল্পী শওকত ওসমান কতোটা শক্তিশালী কথাসাহিত্যিক। বর্ণনারীতির মধ্য দিয়েও তিনি একটি শক্তিশালী চিত্রকল্প নির্মাণ করেছেন। যেখানে কোনো কিছু তাঁর দৃষ্টি এড়াতে পারে না। চারপাশের তুচ্ছাতিতুচ্ছ জিনিসও নিপুণভাবে ফুটিয়ে তোলেন তিনি।
‘নেকড়ে অরণ্য’র প্রতীক হয়ে ওঠে গুদামঘরটি। ক্ষুধার্ত নিষ্ঠুর নেকড়ের কাছে নিরীহ অসহায় হরিণের দৌড়ঝাঁপ, কান্না যেমন অর্থহীন, তেমনি পাক হায়েনাদের কাছে অসহায় নারীদের অনুনয়, হাহাকার, মুক্তির প্রার্থনা, চিৎকার কোনো দয়া বা করুণার উদ্রেক করতে পারে না। সবই অর্থহীন, নিস্ফল। বন্দি শিবিরে তানিমা, জায়েদা, রশিদা, আমোদিনী, সখিনা প্রমুখ ধর্ষিত, নির্যাতিত নারীদের চূর্ণবিচূর্ণ হওয়া স্বপ্ন, দুঃসহ যন্ত্রণা, মানসিক বিপর্যস্ততা বা মানসিক বৈকল্যাবস্থা অত্যন্ত নির্মোহ দৃষ্টিতে তুলে ধরেছেন শওকত ওসমান। নরপশুদের নারী নির্যাতনের বীভৎসতায় আমরা হতবাক হয়ে পড়ি। আমাদের মনে পাকসেনা এবং তাদের দোসর আল-বদর, আল-শামস আর রাজাকারদের প্রতি স্বাভাবিকভাবে তৈরি হয় ঘৃণা। এখান থেকেই জন্ম নেয় আক্রোশ; জ্বলে উঠি ক্রোধের আগুনে। কারণ এই উপন্যাসে নারীরা প্রত্যেকেই হয়ে উঠেছেন একাত্তরে বন্দি শিবিরে বীরাঙ্গনা নারীদের প্রতিরূপ; যাদের ইজ্জত, রক্তঘাম আর আত্মাহুতির বিনিময়ে অর্জিত হয়েছে আমাদের স্বাধীনতা।
কথাসাহিত্যিক শওকত ওসমানের প্রকৃত নাম শেখ আজিজুর রহমান। জন্মেছিলেন ১৯১৭ সালের ২ জানুয়ারি হুগলির সবলসিংহপুর গ্রামে। দেশ বিভাজনের পর চলে আসেন এ দেশে। সাহিত্য জীবনের হাতেখড়ি কবিতা দিয়ে হলেও চল্লিশের দশকে তার আত্মপ্রকাশ ঘটে কথাশিল্পী হিসেবে। লেখালেখির স্বীকৃতিস্বরূপ পেয়েছেন একুশে পদক, বাংলা একাডেমি পুরস্কার, স্বাধীনতা দিবস পুরস্কারসহ অনেক পদক। অবহেলা, অনাদরে এই শক্তিমান কথাসাহিত্যিকের শেষ জীবন কেটেছে। ১৯৯৮ সালের ১৪ মে সকাল ৭.৪০ মিনিটে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। আজ কথাশিল্পী শওকত ওসমানের জন্মদিন। তাঁর স্মৃতির প্রতি রইল গভীর শ্রদ্ধা।
রাইজিংবিডি/ঢাকা/২ জানুয়ারি ২০১৫/তাপস রায়
রাইজিংবিডি.কম