ঢাকা     রোববার   ২৮ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৫ ১৪৩১

হিমলুং শিখরে রুদ্ধশ্বাস অভিযান: ষষ্ঠ পর্ব

ইকরামুল হাসান শাকিল || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৮:২২, ৯ সেপ্টেম্বর ২০২০   আপডেট: ১৮:৩১, ৯ সেপ্টেম্বর ২০২০
হিমলুং শিখরে রুদ্ধশ্বাস অভিযান: ষষ্ঠ পর্ব

হোটেল গঙ্গাপূর্ণায় দুপুরের খাবার শেষে গাড়িতে উঠে বসলাম। আমরা এখানে বেশিক্ষণ সময় কাটাতে পারলাম না। কারণ এখনো প্রায় ৬৫ কিলোমিটার পথ বাকি; পুরোটা পথ ভয়ানক বিপজ্জনক!

গাড়ির ভেতরে আমরা বসেছি, পেছনে ব্যাগগুলো পলি কাগজ দিয়ে ভালো করে ঢেকে রাখা। এই পাহাড়ি এলাকায় খেয়াল-খুশি মতো যখন-তখন বৃষ্টি নামে; কোনো পূর্বাভাস ছাড়াই। আর আমাদের জিনিসপত্র একবার ভিজে গেলে অভিযানের সমাপ্তি সেখানেই! বেসিশহর থেকে বেরিয়ে মেইন রাস্তা থেকে ডানের ঝিরিপথে নেমে এলাম। পানির উপর দিয়ে কিছুটা পথ এগিয়ে ঝিরি থেকে ওঠার পর কিছুটা স্বস্তি। তবে বিপদ হলো একটু পরেই। কারণ পাথরে ঢাকা পথ। মাঝেমধ্যে উঁচু পাহাড়ের ফাঁক দিয়ে শ্বেতশুভ্র বরফের শীতল পর্বত শিখর দেখা যাচ্ছে।

পাহাড়ি বিপজ্জনক পথ। সতর্ক না হলেই সর্বনাশ!

কিছু দূর আসার পরেই চারপাশ কালো মেঘে ছেয়ে গেলো। আমাদের গাড়িটা মেঘের ভেতর দিয়ে এগিয়ে চলছে। গিরিখাত ঘেঁষা আঁকাবাঁকা পথ মেঘের কারণে তেমন দেখা যাচ্ছে না। মেঘের সঙ্গে শুরু হলো ঝুম বৃষ্টি। এই পথ বৃষ্টির মধ্যে আরো বেশি ভয়ানক হয়ে ওঠে! সবচেয়ে বড় ভয় পাহাড় ধ্বস। আমাদের এক পাশে মার্শিয়ান্দি নদী তার খরস্রোতা জলের শব্দে উল্টো পথে ছুটে চলেছে। এই পথে আগেও একবার ভ্রমণের অভিজ্ঞতা আছে আমার। ২০১৭ সালে লারকে পিক অভিযান থেকে ফেরার সময় এই পথেই ফিরেছিলাম। যারা অন্নপূর্ণা সার্কিট ট্রেকিং করতে আসেন তারাও এই পথে আসেন। তাই এই পথের পরিচিতি সারা পৃথিবীর ট্রেকারদের কাছে ভালোভাবেই আছে।

প্রবাদ আছে ‘যেখানে বাঘের ভয় সেখানেই রাত হয়’। আমাদেরও তাই হলো। আমাদের আগে যেসব গাড়িগুলো এসেছে সেগুলো লাইন ধরে দাঁড়িয়ে আছে। যাত্রীরাও নেমে রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে আছে। আমরাও গাড়ি থেকে নেমে এলাম। সামনে এসে দেখি পাহাড় ধ্বসে পড়েছে। রাস্তার কোনো চিহ্নই নেই! সবারই একই চিন্তা কখন রাস্তা ঠিক হবে। বিকল্প অন্য কোনো রাস্তাও নেই। তাই এই রাস্তা ভালো না হওয়া পর্যন্ত এখানেই অপেক্ষা করতে হবে। ঘণ্টাখানেক আগেই ঘটনাটি ঘটেছে। স্থানীয় লোকজন ও সরকারি লোকেরা আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছে যতটা দ্রুত সম্ভব রাস্তা যান চলাচলের উপযোগী করার জন্য। অন্য অনেকের মতো আমরাও দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছি। মার্শিয়ান্দি নদীর অপর পাশে উঁচু সবুজ পাহাড়। প্রায় দেড় ঘণ্টার মতো সময় কেটে গেলো; রাস্তা ঠিক হয়নি। তবে অপেক্ষা করতে খারাপ লাগছে না। চারপাশে উঁচু সবুজ পাহাড়, সঙ্গে মার্শিয়ান্দি নদীর শীতল শব্দ অপেক্ষার কষ্ট ভুলিয়ে রাখছে। যাই হোক, অবশেষে কাঙ্খিত অপেক্ষার অবসান হলো। তবে গাড়িতে উঠতে পারলাম না। রাস্তাটা ভীষণ বিপজ্জনক হয়ে আছে! যে কারণে সবাই হেঁটে সেই অংশটুকু পার হয়ে তারপর গাড়িতে উঠে বসলাম।

যে ভয় করেছিলাম তাই ঘটেছে- সামনে পথ বন্ধ

বিশ্বের সেরা যতগুলো ট্রেকিং রোড আছে তার মধ্যে অন্নপূর্ণা সার্কিট অন্যতম। প্রকৃতির অপরূপ সৌন্দর্যে ভরপুর এই ট্রেককে ‘ট্রেকারদের স্বর্গ’ বলা যেতে পারে। তবে যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নত হওয়ার ফলে এই অনন্য ট্রেকের প্রাকৃতিক এবং নৈসর্গিক সৌন্দর্য কিছুটা ক্ষুণ্ন হয়েছে। তারপরও গাড়ি চলার রাস্তা এড়িয়ে ট্রেকাররা ট্রেকিং ট্রেইল ধরে তীব্র খরস্রোতা মার্শিয়ান্দি নদীর তীর ঘেঁষা উঁচু সবুজ পাহাড়ের উপত্যকা পথে চলতে পছন্দ করে।

জগতে চলে এসেছি। জগত একটি ছোট গ্রাম। এখানেও ট্রেকারদের থাকার জন্য লজ আছে। রাস্তার দু’পাশে ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা খেলছে। অনেক ট্রেকারও চোখে পড়ছে। জগত থেকে বেরিয়ে আমরা চামের দিকে এগিয়ে চলেছি। হাতের ডানে অনেকগুলো ঝরনা। একটি ঝরনা বেশ বড় এবং তন্ময় হয়ে তাকিয়ে দেখার মতো। এই ঝরনার দৃশ্য দেখার জন্য এখানে টি-হাউজ এবং চারদিকে কাঁচ দেওয়া জানালার রেস্টুরেন্ট আছে। সেখানে বসে চা, কফি পান করতে করতে ঝরনার দৃশ্য উপভোগ করা যায়। মার্শিয়ান্দি নদীতে প্রাকৃতিকভাবে সৃষ্ট বাঁধের পাশেই উন্মুক্ত উপত্যকার সমতল ভূমিতে তাল গ্রামের অবস্থান। গ্রামটি বেশি বড় নয়, ছোট ছিমছাম গ্রাম। এখানেও ট্রেকাররা রাতে থাকে। এখানে একটি নয়নাভিরাম উঁচু পাহাড়ি ঝরনা আছে।

হঠাৎ চোখে পড়ল নাম না-জানা পাখি

গভীর পাহাড়ি এলাকায় খুব তাড়াতাড়ি অন্ধকার নেমে আসে। দেখতে দেখতে সন্ধ্যা নেমে এলো। চারপাশ অন্ধকার হয়ে গেছে। ভয়ঙ্কর এই পাহাড়ি পথে অন্ধকারের বুক চিড়ে গাড়ির লাইটের আলোতে এগিয়ে যাচ্ছি। সন্ধ্যা সাড়ে সাতটার সময় আমরা ধারাপানি এসে পৌঁছলাম। গভীর গিরিখাদের পাশে কি এক শ্বাসরুদ্ধকর সৌন্দর্যের মধেই বুক তুলে দাঁড়িয়ে আছে ধারাপানি। এখানে যাত্রাবিরতি দেওয়া হলো। এখান থেকে গাড়িতে আমাদের এজেন্সির কিছু জিনিসপত্র উঠিয়ে নিতে হবে। এই সুযোগে আমরাও গাড়ি থেকে নেমে শরীরের ভাঁজ সোজা করে নিতে তৎপর হলাম। কারণ দীর্ঘ সময় এবড়োথেবড়ো পথের ঝাকুনিতে শরীরের জোড়ায় জোড়ায় ব্যথা হয়ে গেছে। একটি রেস্টুরেন্টে ঢুকে ফ্রেশ হয়ে সবাই আদা চা পান করে শরীরটাকে সতেজও করে নিলাম।

ধারাপানিতে এক রাত ছিলাম লারকে অভিযান থেকে ফেরার পথে। সেবারের আবহাওয়ার খামখেয়ালিপনায় সামিট ক্যাম্প থেকে ফিরে আসতে হয়েছিল। তখন লারকে পাস অতিক্রম করে এই ধারাপানি পর্যন্ত ট্রেকিং করে এসেছিলাম। তারপর এখান থেকে গাড়িতে বেসিশহর হয়ে কাঠমান্ডু ফিরেছিলাম। এখান থেকে ডান পাশের উপত্যকা ধরে একটা সাইড ট্রেইল আছে যা তিলচে, খারচে, ফুকতু খারকা হয়ে বিমথাং পর্যন্ত গিয়েছে। এই সাইড ট্রেইলটি মানাসলু সার্কিট ট্রেকের শেষ অংশ। অর্থাৎ মানাসলু সার্কিট ট্রেকের সর্বোচ্চ স্থান লারকে লা পার হয়ে বিমথাং এসে পরে এই ট্রেইলেই ধারাপানি হয়ে বেসিশহর ফিরে যায় সবাই। অনেকে মানাসলু সার্কিট শেষ করে এসে ধারাপানি থেকে আবার অন্নপূর্ণা সার্কিটে যুক্ত হয়ে সামনে এগিয়ে যায়। যাত্রা বিরতি শেষে আবার গাড়ি চলতে শুরু করলো। এদিকে রাস্তা আরো বেশি ভয়াবহ। রাতের অন্ধকার বলে চলার পথের সৌন্দর্য দেখতে পাচ্ছি না। এমন কি রাস্তার অবস্থাও দেখা যাচ্ছে না। শুধু গাড়ির তালে তালে লাফাচ্ছি আর দুলছি! অবশেষে রাত সোয়া নয়টার দিকে আমরা কটুতে এসে পৌঁছলাম।

পাহাড়ি বনফুল দেখলেই চোখ জুড়িয়ে যায়

কটু হচ্ছে ছোট্ট, ছিমছাম, শান্ত এবং পরিষ্কার একটি গ্রাম। যেখান থেকে দূরের সাদা পর্বতগুলোর এক অবর্ণনীয় রূপ দেখা যায়। এজেন্সির নির্ধারিত লজে আমাদের নিয়ে গেলেন ড্যান্ডি শেরপা। লজের নিচ তলায় আমাদের থাকার ঘর। প্রথমেই আমরা হাত-মুখ ধুয়ে লজের ডাইনিং-এ চলে এলাম। রাতের খাবার খেয়ে সোজা বিছানায়। এখান থেকেই ঠান্ডা শুরু। তাই শরীর উষ্ণ রাখতে লেপের ভেতরে ঢুকতেই হলো। মুহিত ভাইয়ের সঙ্গে গল্প করতে করতে এক সময় ঘুমিয়ে পড়লাম।

ঢাকা/তারা

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়