ইন্দোনেশিয়ায় এক সপ্তাহ
ক্লাস এইটের বইতে সানাউল্লাহ নূরীর একটি ভ্রমণ কাহিনি ছিল- ‘দারুচিনি দ্বীপের দেশে’। সেই থেকে কল্পনায় ভেসে বেড়াচ্ছে ইন্দোনেশিয়া নামের দীপপুঞ্জ নিয়ে গঠিত দেশটি।
আরো বড়ো হয়ে পড়েছি গোল মরিচের কথা। যে গোল মরিচের লোভে ইউরোপীয়রা ভারতবর্ষে এসেছিল। এরও আগে আরবরা। অবশ্য ভারত থেকে অনেক ভালো গোল মরিচ মিলত মালাক্কা প্রণালীর ওদিককার দ্বীপপুঞ্জে। তাই চতুর ডাচরা ভারতে মন না দিয়ে চলে যায় সেখানে। ঘাঁটি গাড়ে বাটাভিয়ায়। সেই ঊর্বর বাটাভিয়া উপনিবেশের উত্থান-পতনের গল্প পড়েছি কত জায়গায়। সেই বাটাভিয়াই আজকের জাকার্তা। সুহার্ত নামের এক শাসককে দেখে দেখে বড়ো হয়েছি। আমাদের শৈশবে ইন্দোনেশিয়া আর সুহার্ত সমর্থক শব্দ হয়ে গিয়েছিল।
গত সেপ্টেম্বর মাসে সেই দারুচিনি দ্বীপের দেশ ভ্রমণের একটা আমন্ত্রণ পেয়ে গেলাম। আরো আনন্দের বিষয় হলো, যে কারণে ডাক পাওয়া- এথিক্স এডুকেশনের উপর একটি আন্তর্জাতিক কর্মশালায় যোগ দেওয়া। এ বিষয় নিয়ে অনেকদিন ধরে ভাবছি। টুকটাক লিখেছি। কিন্তু ভাবনা পরিপূর্ণ রুপ পায় নি। ভাবনার থৈ পেতেই যেন মশলার দ্বীপে যাওয়া।
আমার সফরসঙ্গী ছিলেন আজিমপুর গভর্নমেন্ট গার্লস স্কুল অ্যান্ড কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক গীতাঞ্জলি বড়ুয়া, বীরশ্রেষ্ঠ মুন্সী আব্দুর রউফ স্কুল অ্যান্ড কলেজের অধ্যক্ষ লে. কর্নেল জুনায়েদ আহমেদ, উদয়ন উচ্চ বিদ্যালয়ের অধ্যক্ষ জোহরা বেগম এবং মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের কর্মকর্তা এস এম শফিউল আলম।
রাতের আলোয় জুয়েল চাঙ্গি বিমানবন্দর, ছবি: ইন্টারনেট
১ অক্টোবর সন্ধ্যায় সদলবলে রওনা দিলাম বিমানবন্দরের উদ্দেশ্যে। কর্নেল জুনায়েদের সৌজন্যে স্কাইলাউঞ্জে নৈশভোজ হলো। এরপর চেপে বসলাম বিমানে। রাত ১১ টা ৫৫-এ হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে সিঙ্গাপুর এয়ারলাইন্সের A350-900 এয়ারক্রাফটটি টেইক অফ করল। এয়ারবাস কোম্পানির তৈরি। ৪৪০ জন যাত্রী ধারণক্ষমতার বিমানটিতে সেদিন যাত্রী ছিল ৩৮৬ জন। এমন আঁটসাট গদীর বিমানে এর আগে কখনো চড়িনি। বসতে বেশ কষ্ট হচ্ছিল। সিঙ্গাপুর এয়ারলাইন্স সম্পর্কে উচ্চ ধারণা ছিল। কিন্তু তেমন কোনো সার্ভিস চোখে পড়ল না। এমন লম্বা রুটের যাত্রায় সাধারণত এমিউনিটি কিট বক্স দেওয়া হয়। কিন্তু এ যাত্রায় পেলাম না। খাবার হিসেবে দেওয়া হলো বিশ্রি স্বাদের জাউভাতের মতো একটা খাবার। তৃপ্তি পেলাম না। খেয়ে-দেয়ে ঘুমিয়ে পড়লাম।
ঘুমের ঘোরেই শুনতে পেলাম সিট বেল্ট বাঁধার ঘোষণা। প্লেন ল্যান্ড করবে। জানালায় চোখ দিতেই অভাবিত দৃশ্য! ধরণীতলজুড়ে আলোর খেলা। ষষ্ঠীর চাঁদের আলোয় স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে সাগরের ওপর অজস্র জাহাজ যেন দৃষ্টিপ্রদীপ জ্বেলে তাকিয়ে আছে মহাশূন্যের দিকে। আরেকটু এগুতোই দেখা গেলো ঠাসবুনটের জরিদার কাপড়ের মতো ঝিলিক মারছে সিঙ্গাপুর সিটি। লি কুয়ানের সিঙ্গাপুরকে এ প্রথম দেখছি। কত গল্প পড়েছি এর। একটা জেলেপল্লী কীভাবে হয়ে উঠল পৃথিবীর অন্যতম ধনী অঞ্চল। আজ থেকে ৫০/৬০ বছর আগে পুরো দ্বীপ ছিল একটা বৃহৎ বস্তি। লোকজন ছুতো পেলেই দাঙ্গায় জড়িয়ে পড়ত। এই দাঙ্গার কারণে ১৯৬৫ সালে মালয়েশিয়া ফেডারেশন থেকে বহিষ্কার করা হয় একে। অনেক মাথা কুটে মালয়েশিয়ায় থাকতে পারেনি। আর আজ শান শওকতে মালয়েশিয়াকে ছাড়িয়ে গেছে। সংস্কৃত সিঁহাপুরা বা সিংহপুর থেকে সিঙ্গাপুর শব্দটি এসেছে। তাই এর আইকনিক সব স্থাপনে সিংহের মস্তক। একটা নেংটি ইঁদুরকে সত্যিকারের সিংহে রূপান্তর করেছেন লি কুয়ান। আধুনিক সিঙ্গাপুরের জনক।
৪ ঘণ্টা ১০ মিনিটের ওড়াল শেষে প্লেন সিঙ্গাপুরের মাটি স্পর্শ করল। স্থানীয় সময় সকাল ৬টা। কিন্তু বাইরে ঘুটঘুটে অন্ধকার। একটু অবাক হলাম! সিঙ্গপুরের সঙ্গে আমাদের সময়ের ব্যবধান ২ ঘণ্টা। অথচ দ্রাঘিমাংশের হিসাবে এগিয়ে থাকা জাকার্তার সঙ্গে আমাদের সময়ের ব্যবধান ১ ঘণ্টা। আসলে সিঙ্গাপুর তার ঘড়ির সময় ১ ঘণ্টা এগিয়ে রেখেছে। হয়তো বিদ্যুৎ সাশ্রয়ের জন্য। এমনটা একসময় আমরাও করেছিলাম।
সুকর্ণ-হাট্টা ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্টে ভ্রমণ-ক্লান্ত আমরা
সিঙ্গাপুর বিমানবন্দরে নেমে আমি তাজ্জব। বাইরে থেকে কাচ আর স্টিলের ছয়-ছুরতহীন একটা স্থাপনা মনে হলেও ভেতরে রাজকীয় আয়োজন। চত্বরজুড়ে আধুনিক নকশার কার্পেট। স্থানে স্থানে এতো সুন্দর বসার জায়গা, যেন কোন অভিজাত বাসাবাড়ি। অবাক হলাম সামনে স্কাই রেল দাঁড়িয়ে আছে দেখে। বিশাল বিমানবন্দরের এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় যাওয়ার জন্য স্কাই রেলের ব্যবস্থা। ৪ মিনিট পরপর স্কাই রেল। টাকা লাগে না। আমরা নেমেছি ৩ নম্বর টার্মিনালে। অনায়াসে স্কাই রেলে ১ নম্বর টার্মিনালে যাওয়া যায়। ১ নম্বর দিয়ে বেরিয়ে যেতে হয়। আবার আরেকটা স্কাই রেল তিন নম্বরের আরেক মাথায়।
সিঙ্গাপুরের জুয়েল চাঙ্গি বিমানবন্দরটিতে ৪টি টার্মিনাল রয়েছে। বিমানবন্দরটিকে উপর থেকে দেখলে অনেকটা রোমান H হরফের মতো দেখায়। H-এর উলম্বের রেখা দুটি যথাক্রমে ২ ও ৩ নম্বর টার্মিনাল। আর মধ্যের রেখাটি ১ নম্বর। আর বেশ দূরে বিচ্ছন্ন হয়ে আছে ৪ নম্বর। কিন্তু প্রত্যেকটি টার্মিনাল রেল ব্যবস্থার মাধ্যমে যুক্ত। এক নম্বর টার্মিনাল থেকে অনায়াসে প্রত্যেক টার্মিনালে যাওয়া যায়। আবার সবচেয়ে বড়ো টার্মিনাল ৩-এর ভেতরেই রয়েছে দুটো স্কাই রেল; যাত্রীদের কষ্ট লাঘবের জন্য। এ বিমানবন্দরে যাত্রীদের অবসার যাপনের জন্য ব্যাপক আয়োজন রাখা হয়েছে। ফ্রি মুভি শো, বাটারফ্লাই গার্ডেন, শপিং-এর জন্য বিশ্বের নামকরা সব ব্র্যান্ডের দোকান। তবে এ বিমানবন্দরের সবচেয়ে বড়ো আকর্ষণ দ্য রেইন ভরটেক্স। বিশ্বের বৃহত্তম এবং সবচেয়ে উঁচু ইনডোর জলপ্রপাত। ৪০ মিটার উঁচু থেকে এখানে পানি পড়ে। এর সঙ্গে দেড় লক্ষ বর্গফুট জুড়ে করা বিশাল ক্যানপি পার্ক। এসব দেখার জন্য মুখিয়ে ছিলাম। চাঙ্গিতে পা দিয়েই তল্লাশ করা শুরু করলাম। পরে শুনলাম সেখানে যেতে হলে ইমিগ্রেশন পার হতে হবে। ট্রানজিটের যাত্রীদের কপালে এটা দেখার সুযোগ নেই।
Skytrax জরিপে টানা ৮ বছর পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ এয়ারপোর্ট ছিল চাঙ্গি। পেন্ডামিকের আগের বছর ৬ কোটি ৮০ লাখ যাত্রী এ বিমানবন্দর ব্যবহার করেছিল। ভাবা যায়? আনন্দের বিষয় সিঙ্গাপুরের চাঙ্গি বিমানবন্দরের আদলে গড়ে তোলা হচ্ছে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে তৃতীয় টার্মিনাল। স্যামসাং সিঅ্যান্ডটি এ কাজ করছে। এই স্যামসাং চাঙ্গির ৪ নম্বর টার্মিনাল তৈরি করেছে। এমনকি বুর্জ খলিফা, পেট্রোনাস টুইন টাওয়ার, তাইপে ১০১-তেও তারা কাজ করেছে।
বিমানবন্দরের সবচেয়ে বড়ো আকর্ষণ দ্য রেইন ভরটেক্স, ছবি: ইন্টারনেট
ট্রানজিটের যাত্রীর জন্য বিমানবন্দরের সব কিছু খোলা থাকে না। অগত্যা শুয়ে বসে বাকিটা সময় কাটালাম। জাকার্তা যাওয়ার প্লেনও তিন নম্বর টার্মিনালে ছিল। তাই খুব একটা কষ্ট করা লাগল না। সি-১ গেইট দিয়ে উঠে পড়লাম সিঙ্গাপুর এয়ারলাইন্সের একই মডেলের বিমানে।
পৌনে দু’ঘন্টার যাত্রার বেশির ভাগ সময় কাটল জাভা সাগরের উপর দিয়ে। সাগর পেরিয়ে কেবল ফসলের খেত দেখা যায়। তার মধ্যে গুচ্ছ ঘর-বাড়ি। প্লেন মেঘের চূড়া থেকে নামতে শুরু করলে দৃষ্টিসীমায় আসতে শুরু করে কংক্রীটের জঙ্গল। তবে এর মধ্যে শৃঙ্খলা আছে। সোজা রাস্তাগুলো গ্রিডের মতো ভেসে ওঠে। বোঝা যায় একটা নিয়মের মধ্যে শহরটি বেড়ে উঠেছে। তবে এই শহর বেশি দিন ইন্দোনেশিয়ার রাজধানী থাকছে না। ইন্দোনেশিয়ার সবচেয়ে প্রভাবশালী দ্বীপ জাভা থেকে সবচেয়ে বড়ো দ্বীপ বোর্নিও। অবশ্য ইন্দোনেশিয়ার বলেন কালিমানটান প্রদেশ। এ দ্বীপের একটা অংশ অবশ্য মালয়েশিয়া ও ব্রুনাইয়ের দখলে। ২০১৯ সালে এ দ্বীপের নুসানতারায় নতুন রাজধানী সরিয়ে নেওয়ায় ঘোষণা দেওয়া হয়। এর জন্য ১০ বছর সময় চাওয়া হয়েছে। কিন্তু হঠাৎ করে রাজধানী সরানোর ঘোষণা কেন? আসলে সমুদ্রের উচ্চতা বৃদ্ধির কারণে জাকার্তার নিম্নাঞ্চলগুলো ক্রমেই সাগর গর্ভে হারিয়ে যাচ্ছে। কিছু কিছু জায়গায় স্থায়ী জলাবদ্ধতা দেখা দিয়েছে। দিন দিন বসবাসের অনুপযোগী হয়ে উঠছে শহরটি।
রমেশচন্দ্র মজুমদার ‘সুদূর প্রাচ্যে হিন্দু উপনিবেশ’ বইয়ে জাভা দ্বীপ সম্পর্কে লিখেছেন, মালয় দ্বীপপুঞ্জের মধ্যে জাভা একটি বড় দ্বীপ। জাভার উত্তরে ছোট-বড় অনেক দ্বীপ আছে, ইহার মধ্যে মাদুরা দ্বীপই প্রধান। মাদুরা ও জাভার মধ্যবর্তী প্রণালী খুবই সরু, কোন কোন জায়গায় এক মাইলেরও কম চওড়া। এইজন্য মাদুরা দ্বীপকে জাভার অংশ হিসাবে ধরা হয়। এক সারি পর্বতমালা জাভার মধ্যভাগে অবস্থিত হইয়া জাভা দ্বীপটিকে দুইভাবে বিভক্ত করিয়াছে। এখানে অনেক নদী আছে কিন্তু দুইটি ছাড়া অন্যগুলি সবই নৌচলাচলের অযোগ্য। (চলবে)
/তারা/
আরো পড়ুন