ঢাকা     শনিবার   ২৭ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৪ ১৪৩১

সপ্তম পর্ব

দোগারি পর্বতে বাংলাদেশের প্রথম অভিযান

ইকরামুল হাসান শাকিল || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৬:৫২, ২৫ জানুয়ারি ২০২৪   আপডেট: ১৬:৫৭, ২৫ জানুয়ারি ২০২৪
দোগারি পর্বতে বাংলাদেশের প্রথম অভিযান

রাত সাড়ে তিনটার দিকে আমরা কাংরি গ্রামে পৌঁছলাম। এখানেই আমাদের বাস জার্নি শেষ। বাস থেকে নেমে আমাদের জিনিসপত্র বুঝে নিলাম। এই বাস আবার কাঠমান্ডুতে ফিরে যাবে। 

ছোট্ট একটি গ্রাম। রাস্তার দুই পাশে মাত্র কয়েকটি বাড়ি। এখানে একটি ছোট রেস্টুরেন্ট আছে। আমরা সেই রেস্টুরেন্টে বসে অপেক্ষা করছি। এখান থেকে পাহাড়ের দুর্গম পথে উঠে যেতে হবে ফোরহুইলার জিপে করে। জিপও চলে এসেছে আমাদের নেওয়ার জন্য। জিপে মালপত্র ওঠাতে কিছুটা সময় লাগছে। আমরা এই সুযোগে চা খেতে খেতে মোবাইল ফোন চার্জ করে নিচ্ছি। এখানে বেশ ঠাণ্ডা পড়েছে। তাপমাত্রা মাইনাসে না গেলেও কাছাকাছিই হবে। 

দুইটা জিপে আমরা আবার যাত্রা শুরু করলাম। এখান থেকে শুরু হলো এক ভয়ঙ্কর জিপ যাত্রা। পাহাড়ের গায়ে খাঁজ কাটা এবং এবড়ো-থেবড়ো আঁকাবাঁকা রাস্তা উঠে গেছে উপরে। এখনো দিনে আলো ফোটেনি। গাড়ির হেডলাইটের আলোয় অন্ধকার ভেদ করে হেলেদুলে এগিয়ে চলছি। কখন যে চোখে ঘুম চলে এসেছে বুঝতেই পারিনি। বড় একটা ঝাঁকুনিতে যখন ঘুম ভাঙলো তখন দেখি গাড়ি সোজা নেমে যাচ্ছে নিচের দিকে। ভয়ে বুকটা ধক্ করে উঠলো। ভালো করে চোখ মেলে দেখি সরু রাস্তা দিয়ে নামছে। তাকিয়ে দেখি সবাই ঘুমিয়ে আছে। 

সাতটার দিকে আমরা একটা নদীর পাড়ে এসে থামলাম। এখানে কোনো বাড়ি নেই তবে একটি চা স্টল আছে। নদীর ওপাড়ে একটা বড় গ্রাম দেখা যাচ্ছে। চা স্টলে জিজ্ঞেস করলাম, সাউনি, অই গাঁও কো নাম? মাঝবয়সী মহিলা নাকের মাছ আকৃতির বড় নোলকে হাত বুলাতে বুলাতে বললো, গাঁও কো নাম তাকসারা। গাড়ির যাত্রা এখানেই শেষ। মালপত্র সব নামানো হলো। বড় একটি ঝুলন্ত ব্রিজ দিয়ে নদীটি পাড় হলাম। পশ্চিম দিকের পাহাড়ের গায়ে সূর্যের আলো পড়ে সোনালি হয়েছে। এখনো উঁচু পাহাড়ের আড়ালে সূর্য থাকায় আমাদের এখানে সূর্যের আলো এসে পড়েনি। গ্রামের মানুষ কাজে বেরিয়ে পড়েছে। নদীর পাড় ধরেই পথ। শুকনো মৌসুমে এই পথেও অনেকটা দূর গাড়ি চলাচল করে। 

আমরা সবাই তাকসারা গ্রামে ঢুকলাম। অনেক বড় একটি গ্রাম। গ্রামে প্রায় হাজারখানেক মানুষের বাস। বেশ বড় একটি খেলার মাঠ গ্রামের শুরুতেই। মাঠের পশ্চিম পাশে একটি স্থায়ী মঞ্চ করা আছে এবং পূর্ব পাশে গাঁও পালিকার কার্যালয়ের অফিস। গাঁও পালিকা হলো বাংলাদেশর ইউনিয়ন পরিষদের মতো। বেশ কয়েকটি ওয়ার্ড নিয়ে একটি গাঁও পালিকা পরিচালিত হয়। মাঠের পাশেই একটি খাবার হোটেল। এখানেই আমাদের সকালের নাস্তার বিরতি। 

খাবার তৈরি হতে হতে আমি মাঠ ও গ্রামের কিছুটা অংশ ঘুরে দেখলাম। অনেক পুরনো এই গ্রাম। কৃষি আর পশুপালনই গ্রামবাসীর জীবিকার প্রধান উৎস। এখানে হাইড্রো-প্ল্যান্টের মাধ্যমে জলবিদ্যুৎ উৎপাদন করে গ্রামে বিদ্যুতের চাহিদা পূরণ করা হয়েছে। পাহাড়ের ঢালে ছোট ছোট ঘরের ঘনবসতি। ঘরের চালা টালির মতো করে তক্তা বা পাথর দিয়ে করা। এখন নতুন ঘরে টিনের ব্যবহার চোখে পড়েছে। ঘরগুলো পাথর, কাঠ ও বাঁশের চাঁটাই দিয়ে বানানো। প্রতিটা বাড়িতে ঘরের বাইরে সুন্দর করে গম্বুজ আকৃতি করে ভুট্টা রাখা আছে। ভুট্টাকে নেপালীরা ‘মকাই’ বলে। গ্রামের মাঝখান দিয়ে রাস্তা চলে গেছে। ছোট ছোট শিশুরা রাস্তায় খেলা করছে। দূর থেকে বিপ্লব ভাই হাত দিয়ে ইশারায় ডাকছে। খাবার প্রস্তুত হয়েছে।

আমার বাইরে রোদের মধ্যে খেতে বসলাম। সবাই নডুলস  স্যুপ খাচ্ছে। শুধু আমি একাই রুটি খাচ্ছি। নডুলস স্যুপ আমি খেতে পারি না। রুটির সাথে ডিম ভাজি আর স্থানীয় মধু। খাবারটা আমার জন্য বেশ লোভনী। খাবার শেষে এক মগ আদা চা নিয়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে রেস্টুরেন্টের মালিকের সাথে গল্প করছি। তিনি উঠানেই আলু চাষ করেছেন। সেই আলুই তুলছেন। এরা বাড়ির উঠানে এবং আঙিনায় যে একটু আধটু জমি থাকে সেখানেই বিভিন্ন ধরনের সবজি চাষ করে। যদিও হিমালয়ের এই জমিতে উল্লেখ করার মতো খুব বেশি সবজি হয় না। আলু, ভুট্টা, রাইশাক, মিলেটই বেশি চাষ হয়। 

পোর্টাররা মালামাল নিয়ে রওনা হয়ে গেছে। আমাদের রওনা হওয়ার আগে মুহিত ভাই আমাদের একটি দলগত ছবি তুললেন। আমি আর বিপ্লব ভাই রওনা হয়ে গেলাম। মুহিত ভাই আর সানভি ভাই আমাদের পরে রওনা হলেন। কিলু ও নিমা রয়েছে মুহিত ভাইদের সাথে আসবেন। গ্রামের ভিতর দিয়ে হাঁটছি। আগেই বলেছি এই পথে শুকনো মৌসুমে গাড়ি চলে। নদীর উপরে ব্রিজের কাজ হচ্ছে। আশা করা যায় খুব শিঘ্রই সব সময়ের জন্য গাড়ি চলবে। তবে এখনও এই তাকসারা গ্রাম থেকে উপরের দিকে অনেকটা পথ গাড়ি যায়। বৃষ্টির কারণে রাস্তার বিভিন্ন স্থানে পাহাড় ধ্বস হয়ে গাড়ি চলাচল বন্ধ হয়ে আছে। নয়তো আমরা আরো অনেকটা পথ গাড়িতে যেতে পারতাম। আকাশে পরিষ্কার কোনো মেঘ নেই। রোদ উঠেছে। প্রথমে রোদের তাপ বেশ ভালো লাগলেও কিছু সময় হাঁটার পর প্রচন্ড গরম লাগতে শুরু করল। 

গ্রাম ছেড়ে একটু সামনে এগিয়েই স্কুল। পাহাড়ের গায়ে এই স্কুলটি দেখতে ভীষণ সুন্দর দেখাচ্ছে। স্কুলের সামনে বেশ বড় ও সমতল একটি খেলার মাঠ আছে। মাঠে ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা খেলা করছে। পথে বেশ কয়েকজন ছেলেমেয়ের সাথে দেখা হলো। তারা স্কুল ড্রেস পরে স্কুলে যাচ্ছে। দাঁড়িয়ে আমি আর বিপ্লব ভাই তাদের সাথে কথা বললাম। আমি একজনকে জিজ্ঞেস করলাম, তাপাই কো নাম? বাচ্চাটি উত্তর দিলো, মেরো নাম সাকশি মাগার। সে আমাকে জিজ্ঞেস করল, তাপাই কো ঘর? মেরো ঘর বাংলাদেশ, মেরো নাম শাকিল। এভাবেই ভাঙা ভাঙা দু’একটা কথা হলো। মুহিত ভাইও চলে এসেছে। এখন আমরা একসাথেই হাঁটছি। রাস্তার পাশে তিনটি শিশু খেলা করছে। তাদের পরিবারের লোক জমিতে কাজ করছে। তারা আমাদের ভীষণ কৌতূহল নিয়ে দেখছে। কী সুন্দর তাদের চোখের চাহনি! চোখ ফেরানো দায়। 

রাস্তার দুই পাশ রাঙিয়ে বাতাসে দোল খাচ্ছে রঙিন বুনো কসমস ফুল। ফুলে ফুলে রঙিন প্রজাপতি উড়ে বেড়াচ্ছে। এতো কসমস আমি আগে কখনো দেখিনি। মনে হচ্ছে ঘন কসমস বনের ভিতর দিয়ে হাঁটছি। বড় কোনো গাছ নেই। পাহাড়ের গায়ে সবুজ ঘাসের চাদর। আমাদের ডান পাশে উঠে গেছে পাহাড়ের ঢাল। বাম পাশ নেমে গেছে গভীর খাদে একদম নদীতে। নদীর উপারেই আবার উঠে গেছে আকাশ ছোঁয়া পাহাড়। পাহাড়ের ঢালে ছোট ছোট কৃষি জমি। এই জমিগুলোতেই চাষ হচ্ছে আলু, ভুট্টা, ধান। সাড়ে দশটা নাগাদ আমরা একটি ছোট গ্রামে এসে পৌঁছলাম। দূর থেকে দেখেই মনে হচ্ছে একটি সাজানো-গোছানো পরিকল্পিত গ্রাম। বড় একটি পুকুরে সূর্যের আলো চিকচিক করছে। পুকুরের এক পাশে স্কুল। স্কুল মাঠটিও বেশ বড় ও সমতল। পুকুরের চারপাশ সুন্দর হাঁটার রাস্তা। তিন পাশে তিনটি গোলাকৃতির ছাউনি আছে। যেখানে বসার জন্য বেঞ্চ রাখা আছে। গ্রামটিতে প্রায় শ’ খানেক মানুষের বাস। এখানেই আমদের আজকের দুপুরের খাবারের বিরতি। 

বলে রাখা ভালো গ্রামে কোনো খাবারের রেস্টুরেন্ট নেই। ছোট এটি দোকান আছে। এখানেই আমাদের কিচেন স্টাফরা দুপুরের খাবার রান্না করছে। খাবার প্রস্তুত হতে ঘণ্টাখানেক সময় লাগবে। এই সুযোগে আমি রুকস্যাক রেখে গ্রাম দেখতে বেড়িয়ে পড়লাম। (চলবে) 

পড়ুন ষষ্ঠ পর্ব : দোগারি পর্বতে বাংলাদেশের প্রথম অভিযান

তারা//

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়