ঢাকা     শনিবার   ২৭ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৪ ১৪৩১

কাঠমান্ডুর বৃষ্টি এবং বরফ গলার গল্প

উদয় হাকিম || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৭:১২, ২ জুন ২০১৪   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
কাঠমান্ডুর বৃষ্টি এবং বরফ গলার গল্প

সাদা মেঘ (বিমান থেকে তোলা)। ছবি- উদয় হাকিম

উদয় হাকিম, নেপাল থেকে : শান্ত সৌম্য বিকেল। একটু আগে মুষলধারে বৃষ্টি হয়েছে। ঝিরি ঝিরি ঝরছে এখনো। কাঠমান্ডুকে মনে হচ্ছে এক শান্ত শিষ্ট শান্তির শহর। চারদিক নীরব নিস্তব্ধ। আকাশ মেঘে ঢাকা। এরই মাঝে পূর্ব আকাশে এক দঙ্গল সাদা মেঘ আবির রাঙ্গা হয়ে ওঠেছে খানিকটা সূর্যের দেখা পেয়ে।

আর তাতেই যেনো নববধূর রূপ পেয়েছে কাঠমান্ডুর প্রাচী। মনে হচ্ছে, এ যেনো ‘প্রথম রজনী’ শেষে স্নান সেরে কূলে ওঠা এক নববধূর স্নিগ্ধ রূপ!

উঠেছি হোটেল তিব্বতে। জায়গাটার নাম লাজিমপাত। বারান্দা থেকে দেখা যায় শহরের পূর্ব পাশটা। দক্ষিণে বিশাল পাহাড়। পাহাড় আছে উত্তরেও। মোদ্দাকথা কাঠমান্ডুর চারপাশটাই পাহাড় দিয়ে ঘেরা। অঝোরে যখন বৃষ্টি শুরু হলো, বারান্দায় না গিয়ে থাকতে পারলাম না। পাহাড়ের গায়ে ধাক্কা খেয়ে মেঘ যেনো নিজেকে আর ধরে রাখতে পারছিল না। সবটুকু জল ঢেলে দিচ্ছিল কাঠমান্ডুর ওপর। নিরন্তর বৃষ্টির রিমঝিম শব্দে আবেগ ধরে রাখা দায়। অনেক দিন পর এমন অচেনা শহরে মুষল ধারায় বৃষ্টি দেখলাম।

আচ্ছা এভারেস্টেও কী এখন বৃষ্টি হচ্ছে? হঠাৎ প্রশ্ন জাগে মনে। সেটাতো এখান থেকে অনেক দূর! কতদূর?

ইন্টারনেট ঘেটে দেখলাম ৯৮.৯ মাইল। এটা সড়ক পথের দূরত্ব। আকাশ পথে নিশ্চয় আরো কম। কারণ, ঢাকা থেকে কাঠমান্ডু আসার পথে বিমানে ঘোষণা দেওয়া হচ্ছিল- ‘আমরা এখন কাঠমান্ডু থেকে ৮০ কিলোমিটার দূরে আছি। আমাদের ডান পাশে দেখা যাচ্ছে মাউন্ট এভারেস্ট।’ মনে পড়ল মিহিন লংকায় শ্রীলঙ্কা যাওয়ার সময় পাইলট ঘোষণা করেছিলেন, ডান পাশে এ্যাডামস পিক, বাম পাশে সাফারি পার্ক।

ঘোষণার পর পরই বাম পাশের জানালা ছেড়ে ডান পাশে গিয়েছিলাম। দেখলাম, পৃথিবীর সর্বোচ্চ শৃঙ্গ মাউন্ট এভারেস্ট। পিরামিডের মতো ভাঁজ খেয়ে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। গায়ে গা ঘেষে ত্রিভূজ আকৃতির আরো কয়েকটি শৃঙ্গ। কিন্তু এভারেস্ট আছে সবাইকে ছাড়িয়ে। বরফে ঢাকা ওর গায়ের ওপর দুপুরের রোদ্দুর। চকচক করছে মুক্তার দানার মত। এতদূর থেকেও ঝলমলে এভারেস্টের মোহনীয় রূপ সবাইকে মুগ্ধ করছে।

নিচে তাকালাম। পাহাড়ি এলাকা। অনেক উঁচু পাহাড়ের ওপরও মানুষের ঘরবাড়ি! সহযাত্রী আতাউর রহমান মোহন প্রশ্ন করলেন- এতো উঁচুতে মানুষ কীভাবে বসবাস করেন? বললাম, করতে পারে বলেই ওরা সেখানে থাকছেন দিনের পর দিন, বছরের পর বছর। পাহাড়ের পায়ের কাছেই আবার শুকনো নদী। পানি তেমন একটা নেই। সরু ঝরনার মতো জলধারা। শুকনো বালুই বেশি চোখে পড়ছে বিমান থেকে।

এর আগে দেখছিলাম মেঘের খেলা। বিমানে উঠলে এই একটি বিষয় আমি খুব উপভোগ করি-সেটা হলো মেঘ দর্শন। ছোটবেলা মেঘ উড়ে যেতে দেখেছি অনেক ওপর দিয়ে। বিমানে চড়লে সেটা বয়ে যায় আমাদের নিচ দিয়ে! এতো বিচিত্র মেঘের রূপ! কালিদাস কী কখনো বিমানে মেঘ দেখেছিলেন? না কি সে সৌভাগ্য তার হয়নি! নজরুল কী দেখেছিলেন? নজরুলের একটা গান মনে পড়ল ‘যাও মেঘদূত দিয়ো প্রিয়ার হাতে/ আমার বিরহ লিপি লেখা কেয়া পাতে॥’ ধবধবে সাদা মেঘের ওপর সূর্যের রশ্মি! যেনো ধাঁধিয়ে দিচ্ছে চরারচর।

হঠাৎ বিমানের অ্যানাউন্স শুনে ফিরে এলাম মেঘলোক থেকে। ঘড়িতে তখন বাংলাদেশ সময় বারোটা বেজে ২০ মিনিট। বলা হলো, ‘আমরা এখন ইন্ডিয়া পার হয়ে নেপালের ভূখন্ডে প্রবেশ করলাম। স্থানীয় সময় বিকেল আড়াইটা।’ ভদ্র মহিলা শুরু করেছিলেন গুড আফটারনুন দিয়ে। পরে স্যরি বলে গুড মর্নিং বলা হলো। আসলে স্থানীয় সময় তখন বেলা ১১ টা ৫০ মিনিট!

বাংলাদেশ বিমানের কাণ্ডকারখানা কে শোধরাবে? কাউন্টার থেকে বলা হলো ফ্লাইট ডিউ টাইমে যাবে। তারপরও আধা ঘন্টা লেট। নিয়মিত যাত্রীরা অবশ্য তাতেই খুশি। কারণ আধা ঘণ্টা লেট নাকি বিমানের কাছে ডিউ টাইম হিসেবেই বিবেচ্য! অথচ অনেক এয়ারলাইন্স দেখেছি, যেগুলো নির্ধারিত সময়ের আগেই ফ্লাই করে। যাক, তবুতো বাংলাদেশ বিমান এখনো আছে! এই-ই বা আমাদের কাছে কম কী?

আরেকটা দুঃখের কথা প্রাসঙ্গিক। আমি নেপাল যাব শুনে কয়েকজন বন্ধু আমার সঙ্গে আসতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তারা যোগাযোগ করে নাকি দেখেছে বিমানে সিট নেই! এরমধ্যে দুজনের টিকিট করা ছিল আগেই। তারা কেবল ভ্রমণের তারিখ বদলাতে চেয়েছিলেন। কিন্তু সিট নাকি নেই! খুব রাশ যাচ্ছে! অথচ বিমানে উঠে দেখি ৮০ ভাগ সিটই ফাঁকা! এক সহযাত্রী জানালেন, এই রুটে বাংলাদেশের একটি বেসরকারি এয়ারলাইনসের ফ্লাইট চলছে। এজন্য এরকম চলছে! সত্য মিথ্যা জানি না। তবে আমি আশাবাদি মানুষ। সমস্যা যখন দেখা দিয়েছে, শুভ সমাধানও একদিন হবে বলে আমার বিশ্বাস।

ঢাকা থেকেই ঠিক করেছিলাম, জানলার পাশে সিট পড়লে নদী দেখব গভীরভাবে। দেখলাম উজানের নদীগুলো। যমুনার পানি এখনো নিলচে। তারমানে হিমালয় থেকে নেমে আসা ঘোলা পানি নেই খুব একটা। ছোট নদীগুলো এখনো মরে আছে। জলধারার চেয়ে ধূ ধূ বালুই চোখে পড়ছে বেশি। এভারেস্টের কাছেও দেখলাম জলধারা ক্ষীণ। তার মানে আমাদের নদীগুলোতে জল বাড়তে এখনো অনেক দেরী। যদি অতি বৃষ্টি হয়ে নদী ভরে যায় তবেই মিলবে কাঙ্খিত পানি। তা না হলে অপেক্ষা করতে হবে। বরফ গলছে!

 

রাইজিংবিডি/কাঠমান্ডু/২ জুন ২০১৪/উদয়/সন্তোষ/কে. শাহীন

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ