ঢাকা     শুক্রবার   ২৬ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৩ ১৪৩১

নিঃসন্তান নওশের-মাহমুদা অনেক শিশুর বাবা-মা

মো. আনোয়ার হোসেন শাহীন || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৫:৫৮, ২৮ এপ্রিল ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
নিঃসন্তান নওশের-মাহমুদা অনেক শিশুর বাবা-মা

মো. আনোয়ার হোসেন শাহীন, মাগুরা : নিজেদের অর্থায়নে প্রতিষ্ঠিত স্কুলে হতদরিদ্র পরিবারের শিশুদের বিনা বেতনে পড়াশুনার সুযোগ দিয়ে মাগুরার নিঃসন্তান শিক্ষক দম্পতি এখন অনেক শিশুর বাবা-মা হিসেবে পরিচিত।

তাদের প্রতিষ্ঠিত ‘বগুড়া আদর্শ শিশু বিকাশ কিন্ডারগার্টেন স্কুল’ এখন সুবিধা-বঞ্চিত শিশুদের পদচারণা আর কলকাকলিতে মুখরিত।

মাগুরা সদর উপজেলার হাজীপুর ইউনিয়নের বগুড়া গ্রামের নওশের আলম এলাকায় ‘নওশের স্যার’ হিসেবে পরিচিত। তিনি ও তার স্ত্রী মাহমুদা আলমের আন্তরিক সহযোগিতায় এলাকায় আলোকিত মানুষ গড়ে তোলার এই মহৎ কাজটি করে চলেছেন প্রায় ১৮ বছর ধরে।

পৈতৃক সূত্রে পাওয়া নিজ বাড়িসংলগ্ন ৪৪ শতক জমির ওপর টিনের ছাউনি আর বাঁশের বেড়া দিয়ে শ্রেণিকক্ষ তৈরি করে সেখানে এলাকার গরিব ছেলেমেয়েদের প্লে-গ্রুপ থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত বিনা খরচে লেখাপড়া করাচ্ছেন।

হাজীপুর ইউনিয়ন পরিষদের প্রাক্তন চেয়ারম্যান আবুল কাশেম টিটব বললেন, নওশের দম্পতি তাদের স্কুলে হতদরিদ্র শিশুদের শুধু বিনা বেতনে লেখাপড়া করান তাই নয়, তারা এদের খাতা, কলম, পেন্সিল কিনে দেওয়া ছাড়াও প্রয়োজনে তাদের জামা-কাপড়ও কিনে দেন। যে কারণে বগুড়া আদর্শ শিশু বিকাশ কিন্ডারগার্টেন স্কুলটি এই এলাকার গরিব শিশুদের জন্য জাগরণের ডাক হিসেবে দেখা দিয়েছে।

মাত্র ১২ জন শিশু নিয়ে ১৯৯৮ সালে এ স্কুলটির যাত্রা শুরু হলেও বর্তমানে এখানে ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা ৭১ জনে দাঁড়িয়েছে বলে জানায় স্কুল কর্তৃপক্ষ।

স্কুলসংলগ্ন এলাকায় এ প্রতিনিধির সঙ্গে দেখা হলো, এই স্কুলের প্রথম শ্রেণির ছাত্র রাহুলের মা ঝুমুর বেগমের সঙ্গে। কথা প্রসঙ্গে তিনি জানালেন তার ছেলেকে এই স্কুলে ভর্তি করার কাহিনি।

ঝুমুর বেগম বললেন, ‘গত বছরের প্রথমদিকে নওশের স্যার একদিন আমার বাড়িতে গিয়ে আমার ছেলেকে স্কুলে পাঠানোর জন্য অনুরোধ করলেন। আমি ভাবলাম কেন নয়? এই স্কুলে পাঠানোর আগের দিনগুলোতে রাহুল সকালে খাওয়ার পর পরই বাড়ি থেকে বেরিয়ে যেত, গ্রামময় ঘুরে বেড়াত এবং সব সময় অন্যদের সঙ্গে ঝগড়া করাসহ নানা ধরনের বিরক্তিকর কর্মকাণ্ডে লিপ্ত থাকত। সে জন্য নওশের স্যার বলার সঙ্গে সঙ্গেই আমি তাকে স্কুলে পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিলাম। আমি ভাবলাম লেখাপড়া যাই হোক না কেন, স্কুলে থাকার সময়টুকু অন্তত রাহুল ঝামেলামুক্ত থাকবে।’

ঝুমুর বেগমের মতে, তিনি তার ছেলের ব্যাপারে সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্তই নিয়েছিলেন। বগুড়া আদর্শ শিশু বিকাশ কিন্ডারগার্টেন স্কুল অঙ্গনে পৌঁছানোর পর রাহুল এ প্রতিনিধিকে ‘আসসালামু আলাইকুম’ বলে স্বাগত জানাল। শুধু তাই নয়, এর সামান্য কয়েক মিনিট পরই সে একটি ছড়া শোনাল। এ প্রতিনিধির পশ্নের উত্তরে রাহুল জানালো যে, ছড়াটি সে মাহমুদা আপার কাছে শিখেছে।

চতুর্থ শ্রেণির ছাত্রী শম্পা ফেরদৌসী জানায়, তাদের শিক্ষকেরা ছাত্রছাত্রীদের খুব ভালোবাসেন এবং তারা কখনো কখনো তাদের চকলেট ও ললিপপ দেন। এ ছাড়া ভালোভাবে পড়ালেখা করলে কলম, পেন্সিল ও খাতাও কিনে দেন।



এ প্রতিনিধির সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে নওশের আলম বলেন, ‘আমি ছোটবেলা থেকেই এলাকার শিশুদের মেধা ও মননের যথাযথ বিকাশের মাধ্যমে তাদের শিক্ষিত করে তোলার স্বপ্ন দেখতাম। যেহেতু আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি যে, শৈশবকালই হচ্ছে মানুষের মধ্যে সৃজনশীলতা এবং চেতনা গ্রথিত করার উপযুক্ত সময়, সে কারণে আমি শিক্ষাকে এলাকার গরিব শিশুদের নাগালের মধ্যে আনার লক্ষ্য নিয়েই এ স্কুলটি প্রতিষ্ঠা করেছি।’

নওশের আলম ১৯৮২ সালে যশোর শহরের ঘোপপাড়া এলাকার শিক্ষিত নারী মাহমুদা খাতুনকে বিয়ে করেন। বিয়ের ১৫ বছর পরেও একটি সন্তান লাভে ব্যর্থ হয়ে স্বামী স্ত্রী দুজনেই হতাশ হন। নিজেদের শিশুর প্রতি গভীর স্নেহ প্রকাশ করার সুযোগ না পেয়ে ব্যথিত হন তারা।

তবে, এক সময় তারা এলাকার গরিব শিশুদের নিজেদের সন্তান হিসেবে মেনে নিয়ে তাদের শিক্ষিত করে তোলার সিদ্ধান্ত নেন।

এরপর, বাবা সাখাওয়াত হোসেনের কাছ থেকে পাওয়া ৫৫ বিঘা জমির মালিক নওশের আলম তার নিজের জমিতে স্ত্রী মাহমুদার সহযোগিতায় স্কুলটি প্রতিষ্ঠা করেন।

নওশেরের মহতী এ পদক্ষেপে উৎসাহিত হন এলাকার আরো শিক্ষিত মানুষ। তারাও হাত মেলান নওশেরের সঙ্গে।

এদের মধ্যে পার্শ্ববর্তী এলাকার ফুলবাড়ি মাধ্যমিক বিদ্যালযের সাবেক সহকারী শিক্ষক কাজী আসাদুজ্জামান প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব নেন।

এক প্রশ্নের জবাবে কাজী আসাদুজ্জামান জানালেন যে, নওশের স্যারের ত্যাগে উৎসাহিত হয়ে এবং জাতি গঠনে অবদান রাখার ধারণা থেকেই মূলত আমি ও এ স্কুলের আরো পাঁচজন শিক্ষক স্বেচ্ছাশ্রম দিয়ে থাকি। তবে নওশের আলম প্রতি মাসে আমাদের বিভিন্ন উৎসব উপলক্ষে সামান্য কিছু সম্মানি ও ভাতা দেন।’

তিনি জানান, নওশের দম্পতিই এ স্কুলের সম্পূর্ণ ব্যয়ভার বহন করেন।

স্কুল পরিচালনার ব্যয় সম্পর্কে নওশের আলম বলেন, ‘আমরা যেহেতু নিঃসন্তান, আমাদের জমিজমাসহ বিভিন্ন খাতের উপার্জনের একটি বড় অংশই আমরা স্কুলের জন্য ব্যয় করি।’

মাহমুদা আলম এ প্রতিনিধিকে বলেন, ‘এক সময় নিঃসন্তান হওয়ার কারণে কষ্ট পেতাম। কিন্তু এই স্কুলের মাধ্যমে পরম করুণাময় আমাদের অনেক শিশুর বাবা-মা হওয়ার সুযোগ করে দিয়েছেন।’




রাইজিংবিডি/মাগুরা/২৮ এপ্রিল ২০১৭/মো. আনোয়ার হোসেন শাহীন/এসএন

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়