ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

ভাসমান পেয়ারা বাগানে অভিযান

গাজী মুনছুর আজিজ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৯:৫৭, ৪ মার্চ ২০১৯   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
ভাসমান পেয়ারা বাগানে অভিযান

গাজী মুনছুর আজিজ : স্বাদের জন্য ঝালকাঠীর পেয়ারার সুনাম যেমন, তেমনি এ পেয়ার বিক্রির জন্য ভিমরুলি গ্রামের ভাসমান হাট দেশজুড়ে পরিচিত। ঝালকাঠীর গামছাও সুখ্যাত। বাংলাদেশের একমাত্র কৃত্রিম নৌপথ গাবখান চ্যানেলও এই জেলায়। এই চ্যানেলের সঙ্গে সংযোগ জীবনানন্দ দাশের ধানসিঁড়ি নদীর।

তিনদিক থেকে তিনটি খাল এসে মিসেছে এক মোহনায়। তিন খালের মোহনাতে অসংখ্য ছোট নৌকায় পেয়ারার বেচাকেনা চলছে। এজন্য এই হাট বা বাজার ‘ভাসমান হাট’ নামে পরিচিত। ঝালকাঠী সদর উপজেলা থেকে প্রায় ১৫ কিলোমিটার দূরে ভিমরুলি গ্রামে বসে এই হাট। স্থানীয় সাংবাদিক আসিফ সিকদার মানিক ভাইকে নিয়ে এক দুপুরে ছোট ডিঙি নৌকায় চেপে গেলাম সেই হাটে। মানিক ভাইয়ের বাইকে প্রথমে এলাম শতাদশকাঠী খালপাড়। এরপর পেয়ারা চাষি রনজিতের ডিঙি নৌকায় রওনা হলাম হাটের উদ্দেশে। রনজিত পেয়ারা বিক্রি করে বাড়ি ফিরছিলেন। আমাদের অনুরোধে আবার হাটের দিকে রওনা হলেন।



আঁকাবাঁকা সরু খাল দিয়ে চলছি। খালের দুই পাড়ে পেয়ারার অনেক বাগান। বাগানের মাঝ দিয়ে সরু পানিপথ। এই পথ দিয়ে ছোট নৌকা চলাচল করতে পারে। অর্থাৎ বাগানের গাছগুলো সারিসারি করে কিছুটা উঁচু ঢিবির মতো মাটিতে লাগানো। আর ঢিবির পাশ দিয়ে মাটি কেটে অনেকটা সুরু খালের মতো তৈরি করা, ফলে সেখানে জমে বর্ষার পানি। আবার পেয়ারার মৌসুমও বর্ষাকাল। রনজিত জানান, ছোট এ ডিঙি নৌকা নিয়ে তারা বাগানে প্রবেশ করেন পেয়ারা সংগ্রহ করার জন্য।

প্রায় দেড় কিলোমিটার খাল পাড়ি দিয়ে হাটে এসে দেখি পেয়ারার বেচাকেনা চলছে জমজমাট। অসংখ্য ছোট ছোট নৌকা। সব নৌকাতেই সবুজ রঙের পেয়ারা বোঝাই। কিছু পেয়ারা পেকে হলুদ রং হয়ে আছে। মজার বিষয় হলো, হাটে আসা সব নৌকাই প্রায় একই নকশার ও একই রকম। যেনো সব নৌকাই একই কারিগর তৈরি করেছেন! পাইকাররা ছোট নৌকা থেকে পেয়ারা কিনে তুলছেন বড় নৌকায়। অন্যদিকে হাটের আড়ৎদার বসে আছেন খালের পাড়ে তৈরি করা অস্থায়ী মাচায়। রনজিত বললেন, সারা বছরই এখানে নানা পদের ফলমূল বা শাকসবজির পাইকারি হাট বসে। তবে জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর বা বর্ষার শুরু থেকে শরতের মাঝামাঝি পর্যন্ত হাটে বেচাকেনার প্রধান পণ্য পেয়ারা। আর পেয়ারার মৌসুমে বছরের অন্য সময়ের তুলনায় হাটে ক্রেতা-বিক্রেতার সমাগম বেশি হয়। হাট বসে প্রতিদিন। শুরু হয় সকালে, শেষ হয় বিকেলে।



তিনদিক থেকে যে তিনটি খাল এসে মিসেছে মোহনায় তার একটি এসেছে ঝালকাঠী সদরের দিক থেকে, একটি পিরোজপুরের স্বরুপকাঠী আর অন্যটি এসেছে কাউখালীর দিক থেকে। ঝালকাঠীর দিক থেকে আসা খালটি প্রথমে বাসন্ডা খাল, তারপর শতাদশকাঠী খাল হয়ে মিসেছে ভিমরুলিতে। এসব খাল ধরেই চাষিরা ডিঙি নৌকায় তাদের পেয়ারা নিয়ে আসেন। হাটে আসা পেয়ারা চাষি সন্তোষ বলেন, স্থানীয় ভাষায় পেয়ারাকে ‘গৈয়া’ বলে। কৃষি বিভাগের তথ্য অনুযায়ী ঝালকাঠী সদর, পিরোজপুরের স্বরুপকাঠী ও বরিশালের বানারিপাড়া উপজেলায় প্রায় ৩১ হাজার একর জমিতে দেশীয় প্রজাতির পেয়ারা চাষ হয়। এর প্রায় অর্ধেকের বেশি চাষ হয় ঝালকাঠীর ভিমরুল, শতাদশকাঠী, কীর্তিপাশা, মিরাকাঠী, নবগ্রাম, জগদীশপুর, বিয়নকাঠীসহ এর আশপাশের গ্রামে। আমরা সারা বছর পেয়ারা গাছের যত্ন নিই, পেয়ারা গাছের চারা রোপণ করি। বর্ষার শুরুতে ফল আসতে শুরু করে। তখন থেকে প্রতিদিন হাটে এনে পেয়ারা বিক্রি করি। যোগাযোগ ব্যবস্থা ও সংরক্ষণের অভাবে অনেক সময় পেয়ারার ভালো ফলন হলেও ন্যায্য দাম পাই না। এজন্য চাই উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা ও পেয়ারা সংরক্ষণের হিমাগার।

হাটের মহাজন মোহাম্মদ হাসান বলেন, প্রতিদিন এই হাট থেকে ১০০ থেকে ২০০ মণ পেয়ারা কিনি। এরপর পেয়ারা চালান করি দেশের বিভিন্ন জেলায়। প্রতিদিনই এই হাটে ৫ থেকে ৬ হাজার মণ পেয়ারা বেচাকেনা হয়। হাটের বিক্রেতারা জানান, ভিমরুলি ছাড়াও পেয়ারার অরেকটি বড় হাট বসে স্বরুপকাঠীর আটঘরে। এটিও ভাসমান। এছাড়া বরিশালের বানারিপাড়াসহ এ অঞ্চলের আরও কয়েকটি স্থানে পেয়ারার হাট বসে। তবে ভিমরুলির হাটই সবচেয়ে বড়। অন্যদিকে স্বরুপকাঠীর কুড়িয়ানায় বসে ভাসমান নৌকার হাট। এখানে কেনাবেচা হয় ছোট ছোট নৌকা। বেশ কিছুক্ষণ হাটে ঘুরি, কথা বলি পেয়ারা চাষি ও বিক্রেতাদের সঙ্গে। ইতিমধ্যেই কয়েকটি নৌকা থেকে আমাদের পেয়ারা খেতে দিয়েছেন চাষিরা। সেই পেয়ারা খেতে খেতেই ফিরতে শুরু করি। শহরে না গিয়ে আসি গামছার তাঁতপল্লী বাসন্ডা গ্রামে। এ গ্রামেই জন্মেছেন বিট্রিশ ভারতের প্রথম মহিলা কবি কামিনী রায়। সুখ্যাত ‘ঝালকাঠীর গামছা’ বোনা হয় এই বাসন্ডা গ্রামেই। এখানকার তাঁতি নীরু বেগম জানান, একসময় বাসন্ডা, ইছানিল ও আশপাশের গ্রামে তিন শতাধিক পরিবার গামছা বুনত। এখন বাসন্ডায় নয় থেকে দশটি ও ইছানিলে দুটি পরিবার গামছা বুনছেন।



গামছাপল্লী ঘুরে আসি গাবখান চ্যানেলের উপর নির্মিত পঞ্চম বাংলাদেশ-চীন মৈত্রী সেতু দেখতে। এতো উঁচু সেতু এদেশে খুব কমই আছে। গাবখান চ্যানেল বাংলাদেশের একমাত্র কৃত্রিম নৌপথ। এ কারণে একে ‘বাংলার সুয়েজখাল’ও বলা হয়। এই চ্যানেলের সঙ্গেই সংযোগ রয়েছে জীবনানন্দ দাশের ধানসিঁড়ি নদীর। দূর থেকেই দেখি ধানসিঁড়ি। এরপর হযরত মাওলানা মুহাম্মদ আযীযুর রহমান নেছারাবাদীর (কায়েদ ছাহেব হুজুর) দরবার শরীফ ও তার প্রতিষ্ঠিত নেছারাবাদ কামিল মাদ্রাসা কমপ্লেক্সে ঘুরে আসি শহরে। দেশী ভোজ রেস্তরাঁয় খাই দুপুরের খাবার। খেয়ে শহরের পাটির পট্টিতে আসি। দেখি কারিগররা পাটি বুননে ব্যস্ত। একসময় এখানকার শীতল পাটির সুনাম ছিল দেশজুড়ে। পাটির আড়ৎদার গনেশচন্দ্র দেব, কারিগর সন্তোষ কুমার, মোস্তাক, বকুল রাণীসহ অনেকের দাবি, আগের চেয়ে এখন পাটি বিক্রি কম হয়। পাটির পট্টি ঘুরতে ঘুরতেই সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসে।

ছবি : লেখক



রাইজিংবিডি/ঢাকা/৪ মার্চ ২০১৯/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়