ঢাকা     শনিবার   ২৭ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৪ ১৪৩১

ঘুচল ‘নিজভূমে পরবাসী’র গ্লানি

নওশের || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৮:৩১, ৩১ জুলাই ২০১৫   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
ঘুচল ‘নিজভূমে পরবাসী’র গ্লানি

নিজস্ব প্রতিবেদক, লালমনিরহাট ও নীলফামারী প্রতিনিধি : অবশেষে ১৬২ ছিটমহলের ৫০ হাজার মানুষের দীর্ঘ প্রতীক্ষার অবসান ঘটল। বদলে গেল পতাকা, পরিচয়। ঘুচল ‘নিজভূমে পরবাসী’র গ্লানি।

বাংলাদেশ-ভারতের স্থলসীমান্ত চুক্তি অনুযায়ী শুক্রবার রাত ১২টা ১ মিনিটে ক্যালেন্ডারের তারিখ ১ অাগস্টে পৌঁছানোর সঙ্গে সঙ্গে কার্যকর হল ছিটমহল বিনিময়। ৬৮ প্রদীপে প্রজ্জ্বলিত হলো প্রতিটি বাড়ি।

এর ফলে বাংলাদেশের ভেতরে থাকা ১৭ হাজার ১৬০ দশমিক ৬৩ একর আয়তনের ভারতের ১১১ ছিটমহল হলো  বাংলাদেশি ভূখণ্ডের অংশ। অন্যদিকে ভারতের মধ্যে থাকা ৭ হাজার ১১০ দশমিক ২ একর আয়তনের বাংলাদেশের ৫১ ছিটমহল মিলে গেল ভারতের মানচিত্রে ।


এতদিন যে ছিটমহলের মালিক ছিল ভারত, এখন সেখানে উড়বে বাংলাদেশের পতাকা। একইভাবে ভারতের পতাকা উড়বে এতদিন বাংলাদেশের মালিকানায় থাকা ছিটমহলগুলোতে। দীর্ঘদিনের অমীমাংসিত এই সমস্যার অবসানের মধ্য দিয়ে পূর্ণতা পেল বাংলাদেশ ও ভারতের মানচিত্র।


মুক্ত জীবনের প্রত্যাশায় উন্মুখ হয়ে থাকা ছিটমহলগুলোতে তাই উৎসবের আমেজ। শুক্রবার মধ্যরাতের পর ছিটমহল শব্দটি ঠাঁই নিল ইতিহাসের পাতায়। সীমান্তে আর কোনো জনপদকে ‘ছিটমহল’ হিসেবে পরিচিত হতে হবে না। বাসিন্দারা পাবেন নাগরিক সুযোগ-সুবিধা, দেশের আর সবার মতো স্বাভাবিক জীবনে ফিরলেন তারা।

১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ শাসনের অবসানে দেশ ভাগের সময় সিরিল রেডক্লিফ কমিশনের তাড়াহুড়োয় চিহ্নিত করা সীমান্তে ছিটমহল জটিলতার শুরু। উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া এই সমস্যার অবসানে ১৯৭৪ সালে মুজিব-ইন্দিরা চুক্তি হয়। এরপর তা কার্যকরে প্রোটোকল স্বাক্ষরিত হয় ২০১১ সালে। গত ৭ মে ভারতের সংবিধান সংশোধনের মাধ্যমে ওই চুক্তি বাস্তবায়নের পথ তৈরি হলে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ঢাকা সফরে অনুসমর্থনের দলিল হস্তান্তর হয়।

বাংলাদেশের ভূমি মন্ত্রণালয় এরই মধ্যে ১৬২ ছিটমহল, অপদখলীয় ভূমি এবং অচিহ্নিত সীমানার বিষয়ে গেজেট প্রকাশ করে।

বাংলাদেশে নতুনভাবে অন্তর্ভুক্ত জমি সংযুক্ত করে এবং বহির্ভূত জমি বাদ দিয়ে বৃহস্পতিবার ভূমি মন্ত্রণালয়ের গেজেটে বাংলাদেশ ও ভারত কী পরিমাণ ভূমি পেল এবং কী পরিমাণ ছেড়ে দিল তার বিস্তারিত তথ্য তুলে ধরা হয়।

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, শনিবার ভোরে বাংলাদেশ ভূখণ্ডে অন্তর্ভুক্ত ১১১টি ছিটমহলে বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা উত্তোলন করা হবে।

 
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় (রাজনৈতিক অধিশাখা-১) থেকে জানানো হয়, বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে স্থলসীমানা-সংক্রান্ত সমস্যা সমাধানে ১৯৭৪ সালের ১৬ মে ‘স্বাক্ষরিত স্থলসীমানা ১৯৭৪ (মুজিব-ইন্দিরা) চুক্তি’ এবং পরবর্তীতে ২০১১ সালে স্বাক্ষরিত এ সংক্রান্ত প্রটোকলের আলোকে ৩১ জুলাই শুক্রবার মধ্যরাতে ভূমি বিনিময় সম্পন্ন বলে গণ্য হবে।
 
বাংলাদেশের ভূখণ্ড হিসেবে অন্তর্ভুক্ত ১১১টি ছিটমহলে বসবাসরত ভারতীয় নাগরিক হিসেবে থাকতে আগ্রহীরা ব্যতীত অন্যান্য বাসিন্দাদের বাংলাদেশের নাগরিকত্ব দেওয়া হবে।

এদিকে, এ মুক্তির আনন্দকে ঘিরে ছিটমহলগুলোতে চলছে বাধভাঙা বিজয় উল্লাস। লালমনিরহাট ছিটমহল থেকে আমাদের প্রতিনিধি মোয়াজ্জেম হোসেন জানান, লালমনিরহাটের ৪২টি ছিটমহলে এখন কেবলই বিজয়োল্লাস। ৬৮ বছরের নাগরিকত্বহীণ জীবন থেকে বেরিয়ে নতুন বাংলাদেশি হওয়ার মুহূর্তে ছিটমহলবাসীর এ আনন্দ যেন বাধ ভাঙা।

সরেজমিন ছিটমহলগুলো ঘুরে দেখা যায়, এতদিন নিজভূমে পরবাসী থাকা মানুষগুলো বাংলাদেশি হওয়ার আনন্দকে নানা কর্মসূচিতে উদ্‌যাপন করছে। ভারতে যেতে আগ্রহী ৬২ সনাতনধর্মী নারী-পুরুষও এই কর্মযজ্ঞে একাকার। কারণ দীর্ঘ ৬৮ বছর পর নির্দিষ্ট দেশের নাগরিকত্ব পাচ্ছেন তারাও। ভারতে চলে যাওয়াটাকে তারা দেশান্তরি মানতেও নারাজ। তাদের দাবি, ‘এতদিন ভারতেই ছিলাম। এখনও ভারতেই ফিরছি। তবে আগে পরিচয়হীণ ছিলাম, এখন মাথা উঁচু করে বলতে পারি আমাদেরও দেশ আছে।’

জেলার ৫৯টি ছিটমহলের মধ্যে জনবসতিহীন ১৯টি বাদে ৪২টি ছিটমহলেই এ বাধভাঙা আনন্দ উল্লাস। রাত ১২টা ১ মিনিটে ৬৮টি মোমবাতি ও প্রদীপ জ্বালিয়ে অভিশপ্ত জীবনের ইতি টানে ছিটমহলবাসী। এরপর জাতীয় সংগীত গেয়ে,  মশাল জ্বালিয়ে নতুন বাংলাদেশি হয়ে আলোকিত জীবন গড়ার প্রত্যয় ব্যক্ত করে তারা। কোনো কোনো ছিটমহলে সারারাত সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, আবৃত্তি ও শতবাধা পেরোনোর গল্প করে রাত কাটানোর কর্মসূচি রয়েছে বলেও নিশ্চিত করেছেন আয়োজকেরা।

ওদিকে, নীলফামারী থেকে আমাদের প্রতিনিধি ইয়াছিন মোহাম্মদ সিথুন জানান, শুক্রবার রাত ১২টা ১ মিনিটে  মোমবাতি প্রজ্বলনের পর পরই বিজয়োল্লাসে ফেটে পড়েন জেলার  ডিমলা উপজেলার ৪ ছিটমহলের বাসিন্দারা। নাচ, গানসহ নানা আনন্দ আয়োজনের শেষে পরস্পরকে ভুড়িভোজেও আপ্যায়িত করেন স্থানীয়রা।


এ ছাড়া সকালে সূরযোদয়ের পর পরই রয়েছে জেলা ও উপজেলা প্রশাসনের জাতীয় পতাকা উত্তোলন কর্মসূচি। এ সময় জাতীয় সংগীত গাওয়াসহ শিশুদের খেলাধুলার নানা আয়োজনও রাখা হয়েছে। এসব কর্মসূচিতে স্থানীয় সংসদ সদস্য, জেলা প্রশাসক, পুলিশ সুপার, ইউএনওসহ সরকারি-বেসরকারি কর্মকর্তা এবং স্থানীয় জনপ্রতিনিধিসহ সর্বস্তরের মানুষ অংশ নেবেন।

অন্যদিকে, জাতিসত্ত্বার আত্মস্বীকৃতি পাওয়ায় ছিটমহলবাসীকে অভিনন্দন জানিয়েছেন রাষ্ট্রপতি মোহাম্মদ আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

 



রাইজিংবিডি/লালমনিরহাট/নীলফামারী/১ আগস্ট ২০১৫/নওশের/মোয়াজ্জেম হোসেন/ইয়াছিন মোহাম্মদ সিথুন/সুমন মুস্তাফিজ

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ