ঢাকা     শুক্রবার   ২৬ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৩ ১৪৩১

পঁচিশে পলাশীর চাইনিজ পরোটা

আমিনুল ইসলাম || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৭:৪৯, ২৯ জুলাই ২০১৬   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
পঁচিশে পলাশীর চাইনিজ পরোটা

চাইনিজ পরোটা ভাজছেন মো. আলাউদ্দিন

আমিনুল ইসলাম : ১৯৮৮ সাল। জীবিকার সন্ধানে চাঁদপুর থেকে ঢাকা শহরে আসেন মো. আলাউদ্দিন। স্থান হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায়। বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন হলের ক্যান্টিনে কাজ করেন তিনি। আস্তে আস্তে শিখে নেন সিঙ্গারা, সমুচা, পেঁয়াজু, আলুর চপ, পুরিসহ নানা রকমের জল খাবার তৈরির কাজ। এভাবেই চলতে থাকে বেশ কয়েক বছর।

 

১৯৯২ সাল। আলাউদ্দিন নিজেই কিছু করার সিদ্ধান্ত নেন। গেল কয়েক বছরে তিনি যা শিখেছেন তার বাস্তব প্রয়োগ দেখাতে চান। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) মাঝখানের পলাশী মোড়ে খোলা আকাশের নিচেই সিঙ্গারা, সমুচা, পেঁয়াজু, আলুর চপ, পুরি বানিয়ে বিক্রি করতে শুরু করেন। সীমিত পূঁজি। সীমিত আয়। একদিন সিদ্ধান্ত নিলেন ব্যবসা আর একটু বড় করবেন। সে অনুযায়ী দোকানে পরোটা, ভাজি, ডিমের আয়োজনও রাখতে শুরু করলেন। আস্তে আস্তে সে এলাকার ছাত্রদের কাছে জনপ্রিয় হয়ে উঠতে লাগল তার পরোটা। বাড়তে থাকল বেচা-বিক্রি।

 

ছাত্ররা ভাজি ও ডিম আলাদা না নিয়ে অনেক সময় একসঙ্গে দিতে বলতেন। চাঁদপুরের আঞ্চলিক ভাষায় যাকে ‘লটপটি’ বলা হয়। কিন্তু বুয়েটের ছাত্রদের কাছে নামটি পছন্দ হয়নি। তারা শখ করে কিংবা নিছক মজা করেই এটির নাম দিলেন ‘চাইনিজ’। সেই শুরু। এরপর দেখতে দেখতে পলাশীর চাইনিজ পরোটা পেরিয়ে গেছে দুই যুগ (১৯৯২-২০১৬)। পলাশীর মোড়ের অনেক কিছুর পরিবর্তিত হয়েছে। অনেক শানশওকত হয়েছে এখানে। কিন্তু আলাউদ্দিনের সেই চাইনিজ পরোটা এখনো স্বমহিমায় ভাস্বর। সেই পুরনো স্বাদ এখনো অপরিবর্তিত।

 

তাইতো বুয়েট কিংবা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা প্রাক্তন হয়ে গেলেও পলাশীর চাইনিজ পরোটার কথা ভুলতে পারেন না। কালেভদ্রে কখনো যদি বিকেলে কিংবা সন্ধ্যার পরে ক্যাম্পাসে আসা হয়, তাহলে আলাউদ্দিনের চাইনিজ পরোটা খেতে ভোলেন না তারা। যারা উচ্চশিক্ষার জন্য কিংবা চাকরির জন্য বিদেশ চলে গেছেন, তারাও আলাউদ্দিনকে ফোন করে তার চাইনিজ পরোটা মিস করার কথা জানান।

 

 

আলাউদ্দিনের অবস্থার পরিবর্তন হয়েছে। তিনি এখন আর দোকানে বসেন না। তার ৭ জন কর্মচারী সব সামলান। তিনি শুধু মাঝে মাঝে এসে একটু তদারকি করে যান। সন্ধ্যা ৬টা থেকে ভোর পর্যন্ত চলে পরোটা বিকিকিনি। তাতে যা আয় হয়, তা দিয়ে ৭ কর্মচারীর বেতন দিয়েও তিনি স্বচ্ছল জীবনযাপন করেন। তার কর্মচারীদের কেউ কেউ দৈনিক ২৫০ টাকার উপরে মাইনে পান। তবে ১৫০ টাকার নিচে পান না কেউ। আলাউদ্দিনের সংসার হয়েছে। দুটি ছেলে-মেয়ে স্কুলে পড়ছে। তাদের পড়াশোনা শিখিয়ে মানুষের মতো মানুষ করা এখন তার জীবনের আরেকটি লক্ষ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে।

 

তার ছোট্ট এই খুপড়ি দোকানে ২৫ কেজি থেকে একমণ পর্যন্ত আটা লাগে দৈনিক। প্রতিদিন ডিম লাগে ১৫০ থেকে ২০০টি। যে মৌসুমে যে সবজি পাওয়া যায় তার প্রায় সবগুলো একসঙ্গে দিয়ে, তার সঙ্গে ডিম ভেজে মিশিয়ে তৈরি করেন চাইনিজ। যার স্বাদই অন্যরকম। কেউ চাইলে শুধু ডিম দিয়ে কিংবা শুধু পাঁচ মিশালি সবজি দিয়ে খেতে পারেন পরোটা।

 

তার এই চাইনিজ পরোটা জনপ্রিয়তা পাওয়ার পেছনের কারণ- ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও বুয়েটের বিভিন্ন হলের ছাত্ররা। ক্যান্টিনের একঘেয়ে খাবার খেতে খেতে তারা রীতিমতো অতিষ্ট। তাই একটু ভিন্নতা আনতে মাঝে মধ্যেই ঢুঁ মারেন পলাশী মোড়ে। হালকা তেলে ভাজা পরোটা, সঙ্গে চাইনিজ কিছুটা হলেও হলের একঘেয়ে খাবারের চেয়ে মুখে ভিন্ন স্বাদের সঞ্চার করে।

 

তাছাড়া হলগুলোতে রাত সাড়ে নয়টার পর খুব কম সময়ই খাবার পাওয়া যায়। অধিকাংশ ছাত্ররা ঢাকার বিভিন্ন স্থানে টিউশনি করেন। টিউশনি শেষে জ্যামের নগরী ঢাকাতে নির্দিষ্ট সময়ে হলে পৌঁছানো সম্ভব হয় না। ফলে ঠিকমতো ক্যান্টিনের কিংবা মেসের খাবারও জোটে না। তখন অন্যতম ভরসা এই আলাউদ্দিনের চাইনিজ পরোটা। তীব্র ক্ষুধা পেটে পলাশীর চাইনিজ পরোটা তখন অমৃতকেও হার মানায়।

 

 

তবে আলাউদ্দিনের চাইনিজ পরোটার সেই রমরমা অবস্থা এখন আর নেই। মানুষের আর্থিক অবস্থার পরিবর্তন হয়েছে। বেড়েছে মাথাপিছু আয়। খাদ্যাভাসেও আসছে পরিবর্তন। সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে পাল্টে যাচ্ছে রুচি ও রুচিবোধ। পলাশীর মোড়ের আশেপাশে হয়েছে বেশ কয়েকটি চাইনিজ ও ফাস্ট ফুডের দোকান। সেখানে আরো কয়েকটি সিঙ্গারা, সমুচা, চপ ও পুরির দোকানও হয়েছে। যা বেশ প্রভাব ফেলছে আলাউদ্দিনের দোকানের বেচাকেনায়।

 

তারপরও পলাশীর আলাউদ্দিনের চাইনিজ পরোটা টিকে আছে মাথা উঁচু করে। কারণ, আলাউদ্দিনের সততা ও নিষ্ঠা। এই দুটি গুণের কারণেই ২৪ বছর ধরে তিনি টিকে আছেন। টিকে আছে তার চাইনিজ পরোটা।

 

 

রাইজিংবিডি/ঢাকা/২৯ জুলাই ২০১৬/আমিনুল/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়