ঢাকা     শনিবার   ২৭ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৪ ১৪৩১

পহেলা বৈশাখের গল্পটি লেখা হলো না || মুম রহমান

মুম রহমান || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৯:৫৪, ১৩ এপ্রিল ২০১৬   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
পহেলা বৈশাখের গল্পটি লেখা হলো না || মুম রহমান

অলংকরণ অপূর্ব খন্দকার

১.

সম্পাদক বললো, বস, পহেলা বৈশাখের একটা গল্প দেন।

আমি সিজন্যাল গল্প লিখি না।

দেন একটা। যে পারে সে সব সময়ই পারে।

আরে মুরগিও তো চাইলেই ডিম পারতে পারে না!

তর্কে পারুম না ওস্তাদ। রিকোয়েস্ট, পহেলা বৈশাখের লুতুপুতু একটা গল্প দেন। পাঠক এইসব খায়। 

লুতুপুতু কি জিনিস?

মানে একটু ওগো, হ্যাগো কইরা নায়ক নায়িকার হাত ধরাধরি, মেলায় ঘুরাঘুরি এইসব আর কি। পারলে একটা চুমার সুযোগ...

তোরা কি লেখারে গার্মেন্টেসের মাল পাইছোস? অর্ডার মাফিক সাপ্লাই।

বস, এতো কথা নাই, আপনের জন্য জায়গা খালি রাখতাছি, ১০ তারিখে গল্প দিবেন। অখন যাই, আমি আছি প্যানার মধ্যে। 

প্যানা?

ঝামেলা। আগে আছিল দুই ঈদ, এখন যোগ হইছে বিজয় দিবস, আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস, ভ্যালেন্টাইন, পহেলা বৈশাখ... সবই উৎসব। পোশাক আশাক কিনতে হইবো। নাইলে বউ গোস্বা। বউ গোস্বা তো জীবন অশান্তি।

কস কি!

আপনে তো বিয়া শাদি করলেন না, আপনের মতো সুখি মানুষ আমাগোর দুঃখ কী বুঝবো। বউ তো বউ, শালিও চায় বৈশাখে লাল শাড়ি। আমার তো লাল সুতা বাইর হয়!

ক্যান, দিবি! শালি তো মধুর!

 

শালি তো না, সমগ্র বাংলাদেশ পাঁচ টন। এতো মোটা, এক শাড়িতে ধরতে চায় না। জামাই অক্সিজেনের মতো ঘুষ খায়। তারে কিছু দিয়া আমি খুশি করতে পারমু! আমার যে বাজেট, তাতে তো শালির ব্লাউজও হয় না। যাই দিমু, কইবো, দুলাভাই আপনি কিপ্টা সম্রাট। আরে আমি কি তোমার জামাইয়ের মতো জনগণের গোডাউন থাইকা টাকা কামাই? এইবার আবার সরকার নাকি তার কর্মচারীদের বৈশাখি বোনাস দিতেছে। 

সেটা তো খুবই ভালো। কর্মীদের যতো ইনটেনসিভ দেয়া যায় তারা ততো খুশি মনে কাজ করবে।

শোনেন, আপনে বিদেশে থাইকা থাইকা ইন্টেলেকচুয়াল হয়ে গেছেন, দেশের হাল হকিকত কিছুই বোঝেন না। সিএনজি চড়ছেন কখনো?

সে কি মাঝে মাঝে তো চড়তেই হয়। সব সময় তো গাড়ি পাওয়া যায় না। আর ঢাকা শহরে আমি ড্রাইভ করতে পারি না। আমি তো লেফটহ্যান্ড ড্রাইভার। তা সিএনজির কথা কেনো?

কয়েক দফায় সিএনজির ভাড়া বাড়ছে। তাও তিনারা ভাড়ায় যাবেন না। জ্যামের অজুহাত দিবে। আপনে বলেন, ঢাকা শহরে জ্যামের অজুহাত দেওয়া আর সমুদ্রে বইসা ঢেউয়ের ভয় দেখানো কি এক কথা না। আমাগোর সরকারি অফিসাররা হইলো সিএনজি ড্রাইভারের মতো। বেতন, বোনাস যাই বাড়ান বাজার দরের অজুহাত দিবো, ঘুষ খাইবোই। থোন, এইসব প্যাঁচাল পারলে নিশি ভোর হইয়া যাবে। আপনের লগে কথা ফাইনাল, ১০ তারিখ গল্প দেবেন, পহেলা বৈশাখের বিশেষ সংখ্যা। বিজ্ঞাপনে আপনের নাম দিয়া দিতাছি। 

না শোনো, ইয়ে...

 

২. 

আদরের সম্পাদক না শুনেই ফোন কেটে দিলো। ও ব্যাটা নাছোড়বান্দা। আখ চিপে যেমন রস বের করে ও তেমনি চিপে চিপে লেখা বের করে ছাড়বে। আমি কনফার্ম, আগামী কালই ফোন দিয়ে বলবে, লেখার কতদূর! এমন ডিমান্ড এ- সাপ্লাইয়ের হিসাবে গল্প লেখা যায়! কিন্তু পড়েছো সম্পাদকের হাতে...

আমি কম্পিউটার খুলে বসি, পহেলা বৈশাখের ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি ইত্যাদি নিয়ে পড়তে থাকি। তথ্য টুকে রাখি। রিসার্চ ছাড়া আমি লিখতে পারি না। যারা বসলেই লিখতে পারে তাদের আমি ঈর্ষা করি। আমি গিফটেড লেখক না। অনেক গবেষণা করেই একটা গল্প মাথায় আসে।

যাহোক পড়ালেখার একটা সুবিধা আছে। ঠিকই গল্প বেরিয়ে আসে। এখন নির্বাচনের পালা। কয়েকটি গল্পের আইডিয়া মাথায় এলো। সেগুলো নোট ডাউন করি :

১. এটা হতে পারে পান্তা-ইলিশের গল্প। এক জেলে নিয়মিত ইলিশ ধরতে যায়। এবার তার শখ বড় একটা ইলিশ মেয়েটির জন্য নিয়ে আসবে। মেয়েটি টিভিতে দেখেছে পহেলা বৈশাখে সবাই পান্তা ইলিশ খায়। মরিচ পোড়া দিয়ে... ইত্যাদি ইত্যাদি। কিন্ত শেষ পর্যন্ত ইলিশটি আর আনা হবে না। পথেই আরেকজন বেশি টাকা দিয়ে ইলিশটি কিনে নেবে তার মেয়ের জন্য। গল্পের নাম হতে পারে, ‘মেয়েটি পান্তা ইলিশ খেতে চেয়েছিলো’- আজকাল এমন নামকরণ চলছে। অথবা গল্পের নাম হতে পারে, ‘জেলের আছে একটি ইলিশ’।

 

২. ইয়াং জেনারেশন থার্টি ফাস্ট নাইট পছন্দ করে। ওইদিন ফরেন এলকোহল টানা যায়, ডিজে পার্টি হয়, গার্লফ্রেন্ড নিয়ে পার্টি শেষে রুম ডেট। ইয়াং জেনারেশনের মধ্যে তানভীর নামের একটা কুলাঙ্গার আছে। সে ইংলিশ মিডিয়ামে পড়লেও তার মাথায় কেমন করে যেন বাংলা সংস্কৃতি-ফংস্কৃতি ঢুকে গেছে। সে চিন্তা করে পহেলা বৈশাখকে নতুন প্রজন্মের কাছে তুলে ধরতে হবে। সে বন্ধু শফিক, তুহিন এদেরকে নিয়ে নেমে পড়ে, পহেলা বৈশাখকে জাগিয়ে তুলতে। তারা তিন বন্ধু মিলে ওয়েবসাইট খোলে পহেলা বৈশাখ ডট কম। সেই ওয়েব সাইট খোলা, ডোমেইন কেনা, হোস্টিং, ওয়েব ডিজাইন ইত্যাদি নিয়ে গল্পটি সাজানো হবে। গল্পের নাম হতে পারে ‘ডিজিটাল পহেলা বৈশাখ’ অথবা ‘ফার্স্ট বৈশাখ ডট কম’। 

 

৩. ইলিয়াসকে নিয়েও একটি গল্প লেখা যেতে পারে। গল্পটি হবে জাদু বাস্তবতার। ইলিয়াস গান বাজনা করে। এখনও খ্যাতি অর্জন করে নাই। কিন্তু তার প্রতিভা আছে। রমনার বটমূলে ভিড়ের মধ্যে বসে সে-ও গাইছে ‘এসো হে বৈশাখ এসো এসো’। কিন্তু ইলিয়াসের মন খারাপ। বৈশাখ নিয়ে সে-ও একটা গান লিখেছে। কিন্তু সে গান কে শুনবে? ‘এসো হে বৈশাখ’ গাইতে গাইতে ইলিয়াসের কণ্ঠ রুদ্ধ হয়ে আসে। এমন সময় সবাইকে অবাক করে দিয়ে মাইকে হাজির হলেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ। তিনি বললেন, ‘আজি হতে শতবর্ষ পরে তোমরা আমার গান গাহিছো প্রাণ ভরে, আমি অভিভূত। তবুও আমার হৃদয় দোলাচলে পূর্ণ। কেন তোমরা নতুন শিল্পীদের সুযোগ দিচ্ছো না। ঘরে ঘরে রবীন্দ্রনাথ তৈরিতে উৎসাহ দিতে হবে। আমি আজ এসেছি নতুন শিল্পীর নতুন গান শুনতে।’

 

বলেই রবীন্দ্রনাথ নিজেই ‘এসো এসো আমার ঘরে এসো’ - গাইতে শুরু করলেন। আনন্দে ইলিয়াসের চোখে পানি এসে গেলো। এতোদিনে সে পারবে পহেলা বৈশাখ নিয়ে নতুন গান শোনাতে। ইলিয়াস দলের মাঝখান থেকে উঠতে যাবে, কে যেন তার পাঞ্জাবির কোণা টেনে ধরলো। এই এক জাতি, খালি পেছন টেনে ধরে। কিন্তু ইলিয়াস হেঁচকা টানে উঠে পড়লেন। তার পাঞ্জাবির কোণা ছিঁড়ে গেলো। আর ইলিয়াস দেখলেন মঞ্চে দাঁড়িয়ে কবিতা পড়ছেন নির্মলেন্দু গুণ। 

 

৩.

আবার সম্পাদকের ফোন, বস, গল্পের কি অবস্থা? নাম ধাম বলেন, ইলাস্ট্রেশন করায়া ফালাই।

ইয়ে, গল্প নিয়ে তো সমস্যায় আছি।

কন কি, আপনের নামে বিজ্ঞাপন গেছে। অন্য কোনখানে না, এইবার আপনি শুধু আমাদেরই গল্প দিবেন।

আচ্ছা তোমার সাথে একটু পরামর্শ করি। আমি আসলে ছয়টা গল্পের ভাবনা তৈরি করেছি। 

কন কি! ছয়টা। একটাও লিখতে চান নাই, এখন ছয়টা লিখবেন! মাশাল্লা, দিয়া দেন, এই বৈশাখের সেরা চমক আপনের লেখা হাফ ডজন গপ্পো। আইজ থাইকা বিজ্ঞাপন বদলায়া দেই। আপনেরও সুবিধা হইলো, প্রকাশকরে জানায়া দেন, বৈশাখী গল্প নামে একটা বই হয়া যাবে। বাংলা সাহিত্যে এমন বই আর নাই। পুরস্কারও কনফার্ম। 

আহা, একটাও তো লিখি নাই। আসলে একটা গল্প লিখলে তার আগে পিছে অনেক গল্প আসে। সব তো লেখা যায় না। একটা লিখবো তার আড়ালে অনেক গল্পই রয়ে যাবে। তাই বলছি তুমি শোনো, আসো আলোচনা করি, কোনটা লিখবো।

মাপ কইরা দেন বস। আমি আছি দৌঁড়ের ওপরে। একটুও টাইম নাই। আপনে যাই হোক একটা কিছু লিইখ্যা দেন। আমি ছাপি। আর কিন্তু টাইম নাই। 

যা খুশি তাই লিখবো?

হ বস, আপনে এখন আগডুম বাগডুম ঘোড়াডুম লিখলে বাঙালি খাইবো। আপনে তো হিট লেখক। 

আমাকে মাফ করো, আমি লিখবো না।

আমারে খুন করেন। আই টাচ ইয়োর ফুট। প্যানা দিয়েন না। গল্পটা কাইল দিয়া দিয়েন। লক্ষ্মী বস, জোস বস, রাখি। 

 

৪.

সম্পাদক ফোন রেখে দিলেন। লেখক কী বোর্ড হাতড়াচ্ছেন। বিশ্বের সেরা ১০০টি ক্ষুদ্র বইয়ের তালিকা ছেপেছে কোন এক ওয়েব সাইট, লেখক নিবিষ্ট মনে সেটা পড়তে থাকলেন। কী হয় লিখে, যদি সেটা সেরা লেখা না হয়! লেখক ভাবতে থাকেন, মাত্র দুটি লাইনও যদি এ জীবনে লিখতে পারতেন যা মানুষের মনে থাকতো! 

পহেলা বৈশাখের পরিকল্পিত গল্পগুলো পড়ে থাকে। লেখক অন্য সব কিছু নিয়ে ভাবতে থাকেন। হয়তো সম্পাদক রাগ করে আর কোনদিন লেখাই চাইবে না। কিন্তু যে কোন একটি গল্প লিখতে ইচ্ছে করছে না আর।

 

 

 

রাইজিংবিডি/ঢাকা/১৩ এপ্রিল ২০১৬/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ