ঢাকা     শুক্রবার   ২৬ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৩ ১৪৩১

মুক্তির অপেক্ষায় ছিটমহলবাসী

শফিক/হাসিবুল করিম || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১২:১২, ৩১ জুলাই ২০১৫   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
মুক্তির অপেক্ষায় ছিটমহলবাসী

ফাইল ফটো

নিজস্ব প্রতিবেদক ও পঞ্চগড় প্রতিনিধি : শুক্রবার মধ্যরাতের পর ছিটমহল শব্দ ঠাঁই নেবে ইতিহাসের পাতায়। এরপর সীমান্তে আর কোনো জনপদ ‘ছিটমহল’ হিসেবে পরিচিত হবে না। এখানকার বাসিন্দারা পাবেন নাগরিক সব সুযোগ-সুবিধা। অন্য সবার মতো স্বাভাবিক জীবনে ফিরবেন তারা।

 

১৬২ ছিটমহলের বাড়িতে বাড়িতে মধ্যরাতে জ্বলে উঠবে প্রদীপ। বদলে যাবে পতাকা, পরিচয়। অবসান ঘটবে ৫০ হাজার মানুষের দীর্ঘ প্রতীক্ষার। ভারত-বাংলাদেশ স্থলসীমান্ত চুক্তি অনুযায়ী শুক্রবার রাত ১২টা ১ মিনিটে ক্যালেন্ডারের তারিখ ১ আগস্টে পৌঁছানোর সঙ্গে সঙ্গে ছিটমহল বিনিময় কার্যকর হবে।

 

আর এদিন থেকে বাংলাদেশের ভেতরে থাকা ১৭ হাজার ১৬০ দশমিক ৬৩ একর আয়তনের ভারতের ১১১ ছিটমহল হবে বাংলাদেশের ভূখণ্ডের অংশ। অন্যদিকে ভারতের মধ্যে থাকা ৭ হাজার ১১০ দশমিক ২ একর আয়তনের বাংলাদেশের ৫১টি ছিটমহল ভারতের মানচিত্রে মিলে যাবে।

 

যেসব ছিটমহলের মালিক ছিল ভারত, সেখানে উড়বে বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা। আর বাংলাদেশের মালিকানায় থাকা ছিটমহলগুলোতে উড়বে ভারতের পতাকা।

 

এদিকে, বাংলাদেশের ভূমি মন্ত্রণালয় এরই মধ্যে ১৬২টি ছিটমহল, অপদখলীয় ভূমি এবং অচিহ্নিত সীমানার বিষয়ে গেজেট প্রকাশ করেছে।

 

বাংলাদেশে নতুনভাবে অন্তর্ভুক্ত জমি সংযুক্ত করে এবং বহির্ভূত জমি বাদ দিয়ে বৃহস্পতিবার ভূমি মন্ত্রণালয়ের গেজেটে বাংলাদেশ ও ভারত কী পরিমাণ ভূমি পেল এবং কী পরিমাণ ছেড়ে দিল তার বিস্তারিত তথ্য রয়েছে।

 

চুক্তি বাস্তবায়নের মাধ্যমে বাংলাদেশের ভেতরে ভারতীয় ১১১টি ছিটমহলের ১৭ হাজার ১৬০ দশমিক ৬৩ একর জমি বাংলাদেশি ভূখণ্ডে যুক্ত হবে। এসব ছিটমহলের অধিবাসী বাংলাদেশের নাগরিক হবেন।

 

অন্যদিকে ভারতের ভেতরে অবস্থিত বাংলাদেশের ৫১ ছিটমহলের ৭ হাজার ১১০ দশমিক ২ একর জমি ভারতের ভূখণ্ডের সঙ্গে যুক্ত হবে। ওইসব ছিটমহলের অধিবাসী পরিচিত হবেন ভারতের নাগরিক হিসেবে। 

 

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, শনিবার ভোরে বাংলাদেশ ভূখণ্ডে অন্তর্ভুক্ত ১১১টি ছিটমহলে বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা উত্তোলন করা হবে।

 

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় (রাজনৈতিক অধিশাখা-১) থেকে জানানো হয়েছে, বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে স্থলসীমানা-সংক্রান্ত সমস্যা সমাধানে ১৯৭৪ সালের ১৬ মে ‘স্বাক্ষরিত স্থলসীমানা ১৯৭৪ (মুজিব-ইন্দিরা) চুক্তি’ এবং পরবর্তীতে ২০১১ সালে স্বাক্ষরিত এ সংক্রান্ত প্রটোকলের আলোকে জুলাই শুক্রবার মধ্যরাতে ভূমি বিনিময় সম্পন্ন বলে গণ্য হবে।

 

বাংলাদেশের ভূখণ্ড হিসেবে অন্তর্ভুক্ত ১১১টি ছিটমহলে বসবাসরত ভারতীয় নাগরিক হিসেবে থাকতে আগ্রহীরা ব্যতীত অন্যান্য বাসিন্দাদের বাংলাদেশের নাগরিকত্ব দেওয়া হবে।

 

ভারতের অভ্যন্তরে বাংলাদেশের ৫১টি ছিটমহল শুক্রবার দিবাগত মধ্য রাত থেকে ভারতীয় ভূখণ্ড হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হবে। এসব ছিটের বাসিন্দা ভারতীয় নাগরিক হিসেবে বিবেচিত হবেন।

 

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ভারতীয় ছিটমহলে যেসব বাসিন্দা ভারতীয় নাগরিকত্ব গ্রহণের জন্য আবেদন করেছেন তাদের এ বছরের ৩০ নভেম্বরের মধ্যে বাংলাদেশ ত্যাগ করতে হবে।

 

যারা ভারতে যাবেন তারা টাকা-পয়সাসহ অস্থাবর সম্পত্তি সঙ্গে নিয়ে যেতে পারবেন। ভবিষ্যৎ জটিলতা এড়ানোর জন্য ছিটমহল এলাকায় জমি ক্রয়-বিক্রয় সাময়িকভাবে বন্ধ রাখা হয়েছে।

 

যারা ভারতে যাওয়ার জন্য আবেদন করেছেন তারা জেলা প্রশাসনের সহায়তায় ১ আগস্ট শনিবার থেকে ৩০ নভেম্বরের মধ্যে তাদের জমি বিক্রি করতে পারবেন।

 

এ দিনটির জন্য ছিটবাসীদের অপেক্ষা করতে হয়েছে ৬৮ বছর। আজকের দিনটিকে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত স্মরণে রাখবেন বাংলাদেশ ও ভারতের অভ্যন্তরের ১৬২ ছিটমহলের ৫৬ হাজারেরও বেশি মানুষ। এক দেশের নাগরিক হয়ে আরেক দেশের অবস্থান করায় নাগরিকত্বহীন এসব মানুষের হচ্ছে নির্দিষ্ট ঠিকানা। এই খুশির আনন্দে ভাসছে এসব ছিটমহলের মানুষগুলো।

 

ছিটমহলের নাগরিকরা এখন মাস নয়, সপ্তাহ নয়, শুধু সময়ের অপেক্ষা করছে। আজকের দিনটিকে ঘিরে কয়েক দিন ধরে চলছে ব্যাপক আয়োজনের প্রস্তুতি। সারা দিন বিভিন্ন খেলাধুলা শেষে সন্ধ্যার পরই আলোতে ডুববে গোটা ছিটমহল। বাড়ি বাড়ি জ্বলবে মোমবাতি আর প্রদীপ। আতশবাজি ফুটিয়ে আর আলো জ্বালিয়ে আনন্দ প্রকাশ করবে ছিটবাসী।

 

২০১১ সালের যৌথ হেড কাউন্টিং বা জনগণনা অনুযায়ী বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ভারতের ১১১ ছিটমহলে মোট জনসংখ্যা ছিল ৩৭ হাজার ৩৬৪ জন। আর ভারতের অভ্যন্তরে বাংলাদেশের ৫১ ছিটমহলে জনসংখ্যা ছিল ১৪ হাজার ২২৫ জন। চলতি মাসে যৌথ জনগণনায় বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ভারতের ছিটমহলে জনসংখ্যা ৩ হাজার ৭১৮ জন বেড়ে হয়েছে ৪১ হাজার ৪৪৯ জন। আর ভারতের অভ্যন্তরের বাংলাদেশি ছিটহলের জনসংখ্যা ৬৩১ জন বেড়ে হয়েছে ১৪ হাজার ৮৫৬ জন।

 

উভয় দেশের মধ্যকার ১৬২ ছিটমহলের বর্তমান জনসংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৫৬ হাজার ৩০৫ জন। ভারতের অভ্যন্তরের বাংলাদেশি ছিটমহল থেকে কোনো নাগরিক বাংলাদেশে আসার জন্য ফরম পূরণ করেনি। তবে বাংলাদেশের অভ্যন্তরের ছিটমহল থেকে ৯৭৯ জন ভারতে যাওয়ার জন্য চূড়ান্তভাবে নিবন্ধিত হয়েছেন। এর মধ্যে পঞ্চগড়ের ৩৬ ছিটমহল থেকে ৪৮৩ জন, লালমনিরহাটের ৫৯ ছিটমহলের ১৯৫ জন এবং কুড়িগ্রামের ১২ ছিটমহল থেকে ৩০১ জন।

 

নীলফামারীর চার ছিটমহল থেকে কেউ ভারতে যাওয়ার জন্য ফরম পূরণ করেনি। বাংলাদেশ থেকে যাওয়া এসব নাগরিকদের থাকার জন্য আপাতত ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের কোচবিহার এলাকায় অস্থায়ী শিবির নির্মাণের পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। সেখানে তাদের রেখে পরে তাদের জন্য স্থায়ী আবাসনসহ কাজের ব্যবস্থা করবে রাজ্য সরকার।

 

পঞ্চগড় জেলা সদরের গারাতি ছিটমহলের শালবাগানের অধিবাসী বয়োবৃদ্ধ আনার আলী (৭০)। তিনি বলেন, ‘আমার জন্ম বাংলাদেশে হলেও কালক্রমে ছিটমহলের নাগরিক হয়ে গেছি। কিন্তু ছিটমহলের ছোট্ট ভূখণ্ডের চারপাশ বাংলাদেশি এলাকা হওয়ায় বন্দি জীবনযাপন করতাম। চুরিচামারি করে বাংলাদেশের বাসিন্দা দেখিয়ে সন্তানদের স্কুলে পাঠাতাম। কিন্তু ছিটমহলের নাগরিক হিসেবে জানাজানি হওয়ায় তাদের লেখাপড়ার ইতি ঘটত।’

 

আনার আলী আরো বলেন, ‘দীর্ঘদিনের ঘটনাবহুল ইতিহাসের সফল পরিসমাপ্তির দ্বারপ্রান্তে আমরা। এখন সব দুঃখ ভুলে গেছি। এখন জীবনের শেষ সময়টুকু একটি স্বাধীন দেশের নাগরিক হিসেবে নিজেকে দেখে যেতে পারব। খাঁচায় বন্দিদশা থেকে বেরিয়ে আমরা আসছি আলোয়। এর চেয়ে আর কী আনন্দ হতে পারি।’

 

এ ব্যাপারে ওই ছিটমহলের নাগরিক কমিটির চেয়ারম্যান এবং বাংলাদেশ-ভারত ছিটমহল বিনিময় সমন্বয় কমিটি পঞ্চগড় ও নীলফামারী জেলার সভাপতি মফিজার রহমান বলেন, ছিটমহল বিনিময়ের দিনটিকে স্মরণীয় করে রাখতে আমরা দিনে-রাতে বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করেছি। আজ শুক্রবার আমাদের ছিটমহলে দিনব্যাপী চলবে বিভিন্ন ধরনের খেলাধুলা। বিকেলে ‘চুক্তির মুক্তি’ নামের একটি নাটক মঞ্চস্থ হবে।

 

সূর্যাস্তের পরই প্রতিটি মুসলমান সম্প্রদায়ের বাড়িতে ৬৮টি করে মোমবাতি ও হিন্দু সম্প্রদায়ের বাড়িতে ৬৮টি করে প্রদীপ জ্বালিয়ে সব অন্ধকার দূর করে দেব। আর রাতভর চলবে গান-বাজনা আর আলোর খেলা। রাতে পটকা ফুটিয়ে জানান দেব আমরা আজ থেকে বাংলাদেশি নাগরিক।

 

বাংলাদেশ-ভারত ছিটমহল বিনিময় সমন্বয় কমিটির বাংলাদেশ শাখার সহসভাপতি ও পঞ্চগড় সদর উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান আনোয়ার সাদাত সম্রাট বলেন, ৩১ জুলাই ছিটমহল বিনিময়ের পর আমরা উপজেলা পরিষদের উদ্যোগে গারাতি ছিটমহলে দিনব্যাপী কর্মসূচি গ্রহণ করব। ঢাকা থেকে শিল্পী এনে দিনভর সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান করব। সেই সঙ্গে ছিটমহলে শুরু হয়ে যাবে উন্নয়নমূলক কাজ।




রাইজিংবিডি/৩১ জুলাই ২০১৫/শফিক/হাসিবুল করিম/নওশের/কমল কর্মকার

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়