ঢাকা     শুক্রবার   ২৬ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৩ ১৪৩১

রাহাত খানের গল্পে জীবনজিজ্ঞাসা

মোহাম্মদ নূরুল হক || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ২৩:১০, ২৮ আগস্ট ২০২০   আপডেট: ১৫:১১, ২৯ সেপ্টেম্বর ২০২০
রাহাত খানের গল্পে জীবনজিজ্ঞাসা

রাহাত খানের গল্প মানুষের যাপিত জীবনের দিনপঞ্জি নয়, বিশেষ মুহূর্তের ঘাত-প্রতিঘাতের প্রতিচ্ছবি।  ব্যক্তিগত রুচিবোধ গল্পের ভেতর চারিয়ে দিয়ে লেখকও খানিকটা স্বস্তিবোধ করেন।   তার গল্পে মানবজীবনের জটিল ঘূর্ণাবর্তের যেমন বর্ণনা রয়েছে, তেমনি রয়েছে তুচ্ছাতিতুচ্ছ বিষয়েরও বিবরণ।  অনেক সময় তাকে শ্রেণিসংগ্রামের শিল্পী বলেও মনে হয়।  খুব সাধারণভাবে গল্প বলতে বলতে পাঠককে নিয়ে যেতে পারেন গভীরতর কোনো চিন্তার জগতে।  যেখানে মানুষ নিজের সত্তার অস্তিত্ব টের পায়।  নিজেকেই নিজের অস্তিত্বের বিষয়ে প্রশ্নের প্রশ্নে জর্জরিত করে।

মানুষ নিজের জীবনের চেয়ে কারও জীবনকে গুরুত্বপূর্ণ মনে করে না। মানুষের বিবেচনার কাছে নিজের জীবনই সবচেয়ে মূল্যবান। এ প্রস্তাবনার সমর্থন মিলবে জীবনমৃত্যুর সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে থাকা কয়েকজন মানুষের জীবনযুদ্ধের দৃশ্য পর্যবেক্ষণ করার মধ্য দিয়ে। রাহাত খানের ‘ইমান আলীর মৃত্যু’ জীবনযুদ্ধে প্রায় পরাজিত একটি পরিবারের প্রেম-প্রেমহীনতা, আসক্তি-নিরাসক্তি ও ক্ষুধার কাছে প্রাণপাতের গল্প।  বন্যাকবলিত অঞ্চলের বাসিন্দাদের মধ্যে ত্রাণবিতরণে জনপ্রতিনিধির শঠতা, গ্রামে খাদ্যাভাবে ও চিকিৎসার অভাবে নারী-পুরুষ, আবাল-বৃদ্ধ-বনিতার অপমৃত্যুর ভেতরও কিছু মানুষের বেঁচে থাকার ব্যাকুলতার গল্প এটি।  এ গল্পে বন্যাকবলিত একটি গ্রামের বৃদ্ধ ইমান আলী যেদিন প্রায় মৃত্যুর মুখ থেকে প্রথমবার বেঁচে উঠেছিলেন, সেদিন বিবদমান দুভাই নিজেদের ক্রোধ ভুলে গিয়েছিল।  তখন পিতা হারানোর বেদনা ও আশঙ্কা বড় হয়ে দেখা দিয়েছিল। অথচ বন্যার পানি শুকিয়ে যাওয়ার পরও যখন ঘরে খাবারের চাল-ডাল নেই, তখন ইমান আলীকে ফেলে রেখেই তার ছেলে, ছেলের বউ, নাতি-নাতনিরা কিশোরগঞ্জের উদ্দেশে ঘর ছাড়ার সিদ্ধান্ত নিলে ইমান আলী বেঁকে বসে ঠিকই।

কিন্তু তাকে ফেলে যখন ছেলেরা চলে যাওয়ার উপক্রম করে, তখন সেও প্রস্তুত হয়ে থাকে।  ছেলে ফকিরচানের উদ্দেশে বলে ‘পুত আমারে থুইয়া তোমরা কই যাও? আমি কার কাছে থাকতাম?’ তার এই মিনতিতে মন গলে সন্তানের।  আদিম মানুষের মতো কেবল খাদ্যের সন্ধানে বের হওয়া অভিযাত্রী দল কিছুদূর যাওয়ার পর দুদিনের উপোসে ক্লান্ত হয়ে পড়ে।  দুপুরের রোদে ক্লান্ত পরিশ্রান্ত দল গাছের ছায়ায় বসে বিশ্রাম নেয়। সেখানে ইমান আলী অসুস্থ হয়ে পড়ে। ইমান আলী উঠে দাঁড়াতে পারে না। ইমান আলীকে তার ছেলেরা ফেলে রেখে আসতে চেয়েছিল। কিন্তু ইমান আলীর ‘পুত আমারে থুইয়া তোমরা কই যাও? আমি কার কাছে থাকতাম?’ কাতর নিবেদনে ছেলেরা তাকে সঙ্গে নিতে বাধ্য হয়। কিন্তু শেষ দিকে তাকে রেখে যখন রহীম চান আর মেন্দি অনেকটা দূর চলে যায়, তখন তার কোনো সাড়া পাওয়া যায় না। সবাই ধরে নেয়, এখানে শেষ।  কিন্তু না, আবু চান যখন উঠতে যায়, তখনই সমস্যা দেখা দেয়। আবু চানের পিরানের খুট ধরে রাখে ইমান আলী।   একদিকে আবু চান নিজের জীবন বাঁচানোর জন্য প্রাণান্তকর চেষ্টা করে, অন্যদিকে পিতা নিজের জীবনের মোহে শেষবারের মতো তাকে আঁকড়ে ধরে রাখতে চায়।  আবু চান হিতাহিত জ্ঞানশূন্য হয়ে পড়ে। তবু সে উঠে দাঁড়ায়। বড় ভাইয়ের উদ্দেশে চিৎকার করে, ‘ভায়ু গো, ভায়ু গো, মল্লাম, মল্লাম’।  তার সে চিৎকারে আকাশ চৌচির হয়ে যায়।  আবু চান পিতাকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিয়ে রুদ্ধশ্বাসে ছোটে। ইমান আলী চোখ মেলে দেখে সে একা। তার মনে হতে লাগলো প্রকৃতিতে যেন তারই বন্দনাগীত ধ্বনিত হচ্ছে ‘ওগো মিয়া, তোমার বাড়ি কোন গাঁও, বাড়ি অইছে জাওয়ার গাঁও, ইমান আলীর নাও।’

আপাতত এ উপলব্ধির ভেতর অস্তিত্ববাদী চেতনার তীব্র আকুতি প্রকাশ পায়।  চূড়ান্তরূপেও।  যে সন্তান পিতার রক্তেমাংসে নিজের দেহকে শক্ত মজবুত করে গড়ে তোলার সুযোগ পায়, সেও সময়ে প্রাণ বাঁচাতে গিয়ে পিতাকে নিশ্চিত মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিয়ে ছোটে। আপাতত এই গল্প নিষ্ঠুর, অবিশ্বাস্য ও নির্মম মনে হতে পারে, কিন্তু একটি দেশের শাসকগোষ্ঠীর চাতুর্য বেনিয়ামনোবৃত্তির বিষয়টি চিন্তা করলে, সেদেশের বন্যা-উপদ্রুত অঞ্চলের সহায় সম্বলহীন মানুষের বেঁচে থাকার অনিশ্চয়তার কথা বিবেচনায় আনলে এ গল্প অবিশ্বাস্য মনে হয় না।

চরম দারিদ্র্যের ভেতর মানুষের শরীরও উপার্জনের একমাত্র কৌশল হয়ে ওঠে। শরীরের চাহিদা মেটানোর জন্য বিত্তবানদের প্রয়োজন হয় বহুশরীরের। বহুগামী উচ্চবিত্তের তাতে সমস্যা হয় না। কিন্তু মধ্যবিত্তের জন্য প্রয়োজন হয় টাকা বিনিময়ের।  না হলে শরীরের বিনিময়ে শরীর পাওয়া যায় না। উচ্চবিত্ত বহুগামীরা যেখানে বামাচারিতাকে জীবনের একটি স্বাভাবিক চাহিদা মেটানোর প্রসঙ্গ মনে করে, সেখানে মধ্যবিত্ত সংশয়ীচিত্তের হয়। নিম্নবিত্ত শরীরের বিনিময়ে অর্থোপার্জন ছাড়া অন্য কিছু কল্পনা করতে পারে না। শরীরই তাদের পুঁজি হয়ে ওঠে। ব্যতিক্রমে অস্তিত্বের সংকট হয়ে ওঠে প্রকট ।  এ অস্তিত্ববাদী চেতনার গল্প ‘চুড়ি’।  এখানে স্বয়ং স্বামী বৈদর স্ত্রী জৈগুনকে প্ররোচিত করে বিত্তবান মানুষের সঙ্গে বিছানায় যেতে।  প্রথম দিকে জৈগুন এসব প্ররোচনায় ঘৃণায় অনীহা প্রকাশ করলেও শেষদিকে জৈবিক ক্ষুধার বৈচিত্র্যপূর্ণ উপচার ও আর্থিক সুবিধার কথা বিবেচনা করে স্বামীর প্রস্তাবে রাজি না হওয়ার কোনো কারণ দেখে না। কথকও এ গল্পের একটি অন্যতম চরিত্র। সে-ই পাঠককে জৈগুনের চুড়ির আওয়াজের কথা জানায়। জৈগুন যখন গভীর রাতে স্বামীর কণ্ঠলগ্ন হতো, তখন তার চুড়ির রিনিঝিনি শব্দে কথকেরও ইচ্ছে জেগে উঠতো। কিন্তু চৌকির বিচিত্র ধ্বনি শোনার পরও যৌনকর্মের সময় জৈগুনের চুড়ির আওয়াজ শোনা যায় না।  ‘চৌকির ক্যাঁচ ক্যাঁচ আওয়াজ শুনলাম, ভারী একটা দমের হাঁসফাঁস শুনলাম। তারপর সব থামল। কিন্তু আরে আরে, আরে...জৈগুনের তো হাত-ভরা রেশমি চুড়ি, চুড়ির আওয়াজ শুনলাম তো।’ এতদিন স্বামীর কণ্ঠলগ্ন হওয়ার সময় শীৎকার ও চুড়ির আওয়াজ একাকার হয়ে যেতো। অথচ অন্যের সঙ্গে সে চুড়ির আওয়াজ শোনা যায় না। কারণ কী? এ কারণ অনুসন্ধান করতে গেলে পেয়ে যাব, সে পরিবারের অর্থনৈতিক দৈন্যদশার কিঞ্চিৎ ইতিহাস। যে পরিবারে নুন আনতে পান্তা ফুপুরায়, সে পরিবারে শরীর যখন উপার্জনের মোক্ষম অস্ত্র সে অস্ত্র ব্যাবহার করে অর্থপ্রাপ্তির চেষ্টা করা যেতে পারে, কিন্তু সে অনিচ্ছাকৃত পরিশ্রমলব্ধ কর্মযজ্ঞে আনন্দ আসে না। বেঁচে থাকার তাগিদে যেখানে স্বামীই তার স্ত্রীর শরীর অন্য পুরুষকে ভোগ করাতে বাধ্য করে, সেখানে স্ত্রীর কী করার থাকে? এ তো সত্য, শরীর বিলিয়ে দেওয়ার মধ্যে সে স্ত্রী সামাজিক ও মানসিক দ্বন্দ্বে পড়লেও তার শরীর অন্য পুরুষের শরীরে বিলীন হতে প্রতিবাদ করে না। শরীরের ক্ষুধা শরীর মেটায়, সেটা যার শরীরের সঙ্গেই হোক। আমাদের ভুলে গেলে চলবে না ‘শরীরের ক্ষুধা যত বাড়ে, তত কমে পাপপুণ্য ভয়’।  সুতরাং নৈতিকতার প্রসঙ্গ এখানে অবান্তর। ক্ষুধাই যেখানে মানুষের যাবতীয় সভ্যতা, সংস্কৃতি নিয়ন্ত্রণ করে, সেখানে মেকি নৈতিকতার প্রসঙ্গ টেনে এনে মানুষকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেওয়ার মধ্যে কোনো মহৎ উদ্দেশ্য নেই। বরং সেখানে অস্তিত্ববাদী চেতনার বিপরীতে একটি স্ববিরোধী চেতনাকে প্রশ্রয় দেওয়া হয় মাত্র। যা মানব সভ্যতার চাকাকে গতিশীল না রেখে স্থবির করে দিতে চায়।

আবার অর্থের প্রয়োজনে শরীর থেকে শরীরে কোনো পার্থক্য তারা নির্ণয় করতে পারে না। এভাবেই এই গল্পের শুরু থেকে পরিণতি।  এ গল্পে একইসঙ্গে বিভিন্ন গল্প ঢুকে পড়ে।  ফলে গল্পটি কোনো ব্যক্তি মানুষের জীবন জিজ্ঞাসায় পর্যবসিত হয়ে যায়নি।

‘মধ্যিখানে চর’ মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী মুক্তিযোদ্ধাদের মানসিক প্রতিক্রিয়াজনিত বিভিন্ন ঘটনাবলির বিশেষ দিক নিয়ে লিখিত। এ গল্পে তিন মুক্তিযোদ্ধা বন্ধুর বেঁচে থাকার জন্য বিভিন্ন অনৈতিক কর্মকাণ্ডে যুদ্ধোপরাধীদের সঙ্গে তাদের আচরণের মনোসংকটের বিবরণ রয়েছে। ‘উদ্বেল পিপাসা’ চরম দারিদ্র্যের সঙ্গে লড়াই করে বেঁচে থাকা মানুষের গল্প। অসুস্থ স্বামীকে রেখে স্ত্রী খালেদা হাসানের সঙ্গে শারীরিক সম্পর্কে মেতে ওঠে। স্বামী দরোজার ফাঁকে চোখ রেখে সে দৃশ্য দেখে। কিন্তু তার কিছু করার থাকে না। বেঁচে থাকাই বড় সত্য যেখানে, সেখানে নৈতিকতার দোহাইয় অবান্তর। তাই হয়তো স্বামী খালেদাকে হাসানের সঙ্গে অবৈধ সম্পর্ক নিয়ে অশ্লীল ভাষায় গালিগালাজ করে সত্য; কিন্তু বাধা দিতে পারে না। কারণ হাসানের দেওয়া টাকায়ই তার চিকিৎসা, দুটো ডালভাতের ব্যবস্থা করে দেয় খালেদা। বিনিময়ে হাসান খালেদার শরীর নিয়ে খেলে। কিন্তু মনের সন্ধান সে কি পায়? হয়তো পায়। না হলে শেষ পর্যন্ত খালেদা মৃত্যুপথযাত্রী স্বামীকে রেখে হাসানের সঙ্গে ঘর ছাড়লো কেন? এখানেও বাঁচার তাগিদে এতদিনের সমস্ত মোহ, অধিকার, দায়িত্ববোধ মুহূর্তে তুচ্ছ হয়ে যায়। কোনোই মূল্য পায় না অর্থশক্তির কাছে।

‘মধ্যরাতে’ সংলাপের আদলে রচিত একটি অসাধারণ গল্প।  এ গল্পে মানবচরিত্রের বহুকৌণিক জটিল বিকার স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। ক্রস কানেকশানে পরিচিত দুজন নিঃসঙ্গ নরনারীর অন্তরঙ্গ সংলাপের ভেতর দিয়ে গল্পের শুরু এবং শেষ। নারী-পুরুষের আকাঙ্ক্ষার যে মৃত্যু, তারই হৃদয়সংবেদী বর্ণনা রয়েছে এ গল্পে। উপলব্ধির ভেতর রয়েছে ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবোধ ও আত্মমর্যাদাবোধের তীব্র দহনও। উভয়েই উভয়কে মেলে ধরেন। কিন্তু সে মেলে ধরা আত্মোন্মোচনের ভদ্রসীমাকে লঙ্ঘন করে নয়। মনোবিকারের সীমারেখাকে রুচিবোধের সীমারেখায় বৃত্তাবদ্ধ করেই তাদের সংলাপ শুরু এবং শেষ। শেষ থেকে পুনরায় আশা ব্যক্ত করা মাঝে-মধ্যে তাদের কথা হতে পারে। সে আশ্বাসের ভেতর সংশয় ও পরিহাসের ছোঁয়াও স্পষ্ট হয়ে ওঠে। শেষ পর্যন্ত দুজনের কেউই আপন মনের অচরিতার্থ জীবনের গোপন অর্গল খুলতে না পারার বেদনাবোধ নিয়ে সংলাপের সমাপ্তি টানেন। হয়তো জীবনের কোনো ক্রান্তিলগ্নে কিংবা শুভলগ্নেও আর তাদের কথা বলার সুযোগ হবে না। তবু কেউ কারও ফোন নম্বর টুকে নেওয়ার প্রয়োজন বোধ করেনি।  কিন্তু প্রকাশ করতে চায়নি, পাছে অন্যপ্রান্ত থেকে লাইন কেটে দেয় এ ভয়ে।  হয়তো বা।  তাহলে পাঠক হিসেবে লেখকের সঙ্গে একমত হতে পারি ‘মানুষের সব গল্পই এ রকম। জীবনভরে বহু রং নাম্বার। কখনোই খুব বেশি আশা করতে নেই’?

‘বিষবৃক্ষ’ তার শ্রেষ্ঠ গল্পগুলোর একটি। তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার শুরু, সে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার ভেতরও বন্ধুত্বের টান বড় হয়ে দেখা দেয়।  একদিকে বন্ধুত্বের অপার টান, অন্যদিকে সাম্প্রদায়িক বিষ, দুয়ের সংমিশ্রণে বিষবৃক্ষ গল্পের প্রাণ গতি পায়। সেখানেও অস্তিত্বের প্রশ্নে মানুষের কাক্সক্ষায় ভাস্বর।  যে রায়হান, আতাউররা মাখনলালকে সাম্প্রদায়িক মনোবৃত্তির বশে মারতে যায় বস্তির ভেতর সে মাখন লালের রক্তাক্ত ছবি দেখে রায়হান হঠাৎ ‘মাখনরে মাখন’ বলে চিৎকার করতে থাকে।  তখন মাখন তার মর্মোন্তুদ যন্ত্রণার কথা বেমালুম ভুলে গিয়ে রায়হানকে প্রশ্ন করে ‘কানতাছস কেন রায়হান?’ জবাবে রায়হান মর্মছেঁড়া উত্তর দেয়, ‘তোরে আমরা মারতে আইছিলাম’।  এই গল্প এখানেই শেষ হতে পারতো।  কিন্তু রাহাত খান পাঠককে নিয়ে যান দাঙ্গাকবলিত মানুষের শেষ পরিণতি পর্যন্ত। তাই এ গল্পে দেখি রায়হান, আতাউররা আপন সম্প্রদায়ের কথা বিবেচনা না করে কেবল বন্ধুত্বের জোরে ভিন্ন সম্প্রদায়ের কজন মানুষকে তাদের বিপৎসীমা পার করে দিয়ে আসে। মানুষের ভেতরও চরম দুর্দিনে দুই ধরনের সত্তা বিরাজ করে। এ গল্পে সে-ই স্বাক্ষর উজ্জ্বল হয়ে আছে।

‘শরীর’ মধ্যবিত্তের নিস্তরঙ্গ জীবনে হঠাৎ উচ্চবিত্তের বল্গাহীন স্বভাবের ছায়া এবং সে পরিস্থিতিতে কর্মচারী সংগ্রামের মিছিলে আনন্দের ভেতর বিষাদের ছায়ার ছবি।  ‘ভালো মন্দের টাকা’ গল্পের রহীমদাদের ভাড়াটে গল্প লেখক হিসেবে প্রতিভার অপচয় ও উদ্দেশ্যহীন জীবনের ঘেরাটোপে পড়ে নারী-টাকা-মদ কী এক দুর্মর নেশায় সবই একই স্রোতে ভেসে যায়।  বন্ধুর মৃত্যুতেও সে দুঃখ পায় না বরং কিছু পাওয়ার অন্যায় লোভের বশে সে মোহান্ধ হয়ে পড়ে।  রায়হানার খোলা শরীর দেখে উত্তেজিত হওয়ার পরিবর্তে বন্ধু জামিলের ক্যানসারের বিষয় মনে করে ভেঙে পড়ে রহীমদাদ।  তাকে জাগিয়ে তুলতে রায়হানাকে বিভিন্ন রকমের কসরত করতে হয়। তবেই তার কামভাব জেগে ওঠে।  অথচ রহীমদাদই বন্ধু জামিলের মৃত্যুতে শোকাহত না হয়ে উৎফুল্ল হয়ে ওঠে। যেন এ মৃত্যু স্বাভাবিক ও কাঙ্ক্ষিত।  এ গল্পের প্রতিটি চরিত্রই স্বার্থপর ও আত্মকেন্দ্রিক।  ভোগবাদীও।  

আবার অর্থের প্রয়োজনে শরীর থেকে শরীরে কোনো পার্থক্য তারা নির্ণয় করতে পারে না। এভাবেই এই গল্পের শুরু থেকে পরিণতি।  এ গল্পে একইসঙ্গে বিভিন্ন গল্প ঢুকে পড়ে।  ফলে গল্পটি কোনো ব্যক্তি মানুষের জীবন জিজ্ঞাসায় পর্যবসিত হয়ে যায়নি।  হয়ে উঠেছে সমাত্মজীবনীর নির্যাসও।  ‘প্রতিদ্বন্দ্বী’ গল্পে সন্ত্রাসী তুতু শেষ পর্যন্ত অতিপ্রাকৃত শক্তির কাছে আত্মসমর্পণ করে।   ‘অন্তহীন যাত্রা’ গল্পের কমর উদ্দিনের বাউণ্ডুলে জীবনের ভেতর ঢুকে পড়ে অনৈতিকতার প্রসঙ্গও। গল্পের শেষে সে কমর উদ্দিন হেঁটে চলে শবযাত্রীদলের সঙ্গে।  তার মনে হয়, হয়তো মৃত্যুই মানবজীবনের মুক্তির শেষ ঠিকানা।

রাহাত খানের গল্প মানুষের কঠোর বাস্তবিক অবস্থার চিত্রায়ণ।  সেখানে মায়া-মমতা তেমন স্থান পায় না।  তার গল্প পাঠে মানুষের ভেতরের মানুষকে মানুষ সন্দেহ করার দীক্ষা নেয়। পতিঅন্তঃপ্রাণ স্ত্রীর চরিত্রের অন্য পিঠে পরক্রিয়ার গন্ধ লেগে থাকে। আবার স্ত্রীপ্রেমে একনিষ্ঠ স্বামীও কেবল অর্থের মোহে স্ত্রীর বিছানায় অন্যকে সুযোগ করে দেয়। রাহাত খান স্বপ্নচারী-বাস্তববাদী লেখক।  তার গল্পে অস্তিত্বের সংকট যেমন বড় হয়ে ওঠে, তেমনি মানবজীবনের বহুকৌণিক দিকও ডালপালাসমেত বিস্তার লাভ করে।  তাই ‘মধ্যরাতে’ গল্পের উপলব্ধি—‘মানুষের সব গল্প এক রকম’ কিংবা ‘জীবন ভরে বহু রং নাম্বার’ কিংবা ‘মানুষ তার চিবুকের কাছে ভীষণ অচেনা ও একা’।  সে সঙ্গে ‘কখনোই খুব বেশি আশা করতে নেই’ বলে যে উপলব্ধি লেখকের, সে চরম সত্য তো মানবজীবনের প্রতিটি ইচ্ছাকে নিয়ন্ত্রণ করে। 

তার শিল্পোত্তীর্ণ গল্পগুলোর পরতে পরতে জীবনের অব্যক্ত প্রশ্নগুলো গুমরে-গুমরে ওঠে। যে প্রশ্নের উত্তর সচরাচর মানুষ দিতে সমর্থ নয়—যে সব প্রশ্নের উত্তর লেখকও তার গল্পের চরিত্রের জন্য, নিজের জন্য এবং মানুষের জন্য সাজিয়ে রাখেন না ইচ্ছে করেই।

রাহাত খান জীবনকে চেখে দেখেছেন জহুরির মতো। তাই তার কলমে কাঁচা প্রেমের গদগদ সংলাপ নয়, মেকি আভিজাত্যের বানানো কাহিনি নয়, সরেজমিনে তদন্তসমেত জীবনের অকৃত্রিম রূপটি ফুটে উঠেছে।  বিশেষ বিশেষ মুহূর্তে জীবনের ঘাত-প্রতিঘাতকে শিল্পসুষমায় ঋদ্ধ করতে রাহাত খান সিদ্ধহস্ত।  সে হিসেবে রাহাত খানকে জীবনের শিল্পী বলাই সঙ্গত। 

কল্পনার ফানুস উড়িয়ে মানুষকে রূপকথার গল্প কিংবা উপকথা শুনিয়ে মোহমুগ্ধ করে ধরে রাখা তার লক্ষ্য নয়।  তার উদ্দেশ্য—মানবজীবনের কদর্য রূপকে রাষ্ট্র করে দেওয়া। যা থেকে মানুষ দীক্ষা লাভ করে জীবনকে নতুনরূপে সাজিয়ে তোলার চেষ্টা করবে। কেবল স্বাপ্নিকস্বভাবে বিভোর হতে অনীহ তিনি। স্বপ্নহীন মানবজীবন অকল্পনীয় সত্য; কেবল স্বপ্নচারিতাও মানবজীবনের জন্য সমূহ বিপদ ডেকে আনতে পারে।  মুক্তিযুদ্ধ ও দেশপ্রেম বিষয়ক তাঁর গল্পের নাম ‘এই বাংলায়’, ‘মুক্তিযোদ্ধার মা’।

এ গল্পগুলো তার ‘ইমান আলীর মৃত্যু’ ও ‘ভালো মন্দের টাকা’ থেকে অতিক্রম  তো করতে পারেইনি, বরং এসব গল্পের মুক্তিযুদ্ধ কিংবা দেশপ্রেমের বিষয়টি আরোপিত বলেই মনে হয়। আবার ‘প্রতিদ্বন্দ্বী’ গল্পও অনেকটা থ্রিলার ঢংয়ে লিখিত হওয়ায় গল্পের বাস্তবতাও কিছুটা ম্লান হয়ে যায়।  ফলে গল্প যেন বিশ্বাসযোগ্যতা হারায়।  যে জীবন লেখক যাপন করেননি, চেষ্টা করে সে জীবনের গল্প বলতে গেলে বানানো কাহিনির অবতারণা ছাড়া কিছুই লেখা সম্ভব হয় না।  কিন্তু সে জীবনকে কাছ থেকে অবলোকন করেও সে জীবন সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা লাভ করা সম্ভব।  তবে যেভাবেই রাহাত খান গল্প বুনুন, তার গল্পের মূল বিষয় জীবনজিজ্ঞাসাই।

সে জীবনজিজ্ঞাসার পথে কখনো-কখনো একধরনের ধাঁধার সৃষ্টি হয়। ফলে মানবিক সংকট বড় হয়ে ওঠে। যেমন ‘ভালো মন্দের টাকা’য় মৃত্যু পথযাত্রী জামিলের অসুস্থতার সংবাদ ভেতরে ভেতরে রহীমদাদকে কুরে কুরে খায়। কিন্তু সে জামিলের মৃত্যুর সংবাদ রহীমদাদকে বিচলিত করে না, বরং কিছু পাওয়ার ও নিজের জীবনকে উপভোগ করার এবং সে সঙ্গে প্রচুর ভোগের তৃষ্ণা জাগে। জীবনকে উপেক্ষা করে নিছক শিল্পবিলাস তার গল্পে অবান্তর।  এসব বিষয় পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে বিশ্লেষণ করে এমন সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া অসঙ্গত হবে না যে, রাহাত খান শ্রেণীসচেতন জীবনশিল্পী।

তার শিল্পোত্তীর্ণ গল্পগুলোর পরতে পরতে জীবনের অব্যক্ত প্রশ্নগুলো গুমরে-গুমরে ওঠে। যে প্রশ্নের উত্তর সচরাচর মানুষ দিতে সমর্থ নয়—যে সব প্রশ্নের উত্তর লেখকও তার গল্পের চরিত্রের জন্য, নিজের জন্য এবং মানুষের জন্য সাজিয়ে রাখেন না ইচ্ছে করেই। এভাবে রাহাত একজন লেখক থেকে হয়ে ওঠেন জীবনশিল্পী।

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়